একটি গল্প দিয়েই শুরু করি। এক চোর চুরি করতে এসে বাড়ির গেইট ভাঙতে যাবে অমনি দেখে লেখা- ‘আপনি ডিজিটাল সুইচ চাপুন গেইট আপনাতেই খুলে যাবে।’ চোর মহা আনন্দিত। কষ্ট কমে গেল ভেবে সুইচ চাপতেই গেইট খুলে গেল। ভেতরে প্রবেশ করে মালপত্র নিতে যাবে দেখে পুলিশ বসে আছে। হাতে হাতকড়া পরিয়ে হাজতে নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশ জিজ্ঞেস করলো, ‘কিছু বলার আছে তোমার?’ চোর বিমর্ষ বদনে বললো, ‘স্যার, আমার বিশ্বাসটাই ভেঙে গেল।’ নির্বাচন নিয়ে যতরকম কথা ভাবছি ততবার এ কথাটিই মনে ভাসছে। নির্বাচনের রোডম্যাপ নিয়ে রাজনীতির মাঠে যত ধরনের বক্তব্য চাউর হয়েছে তাতে দিনকে দিন অবিশ্বাসের পারদ বাড়ছে।
ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, লন্ডন বৈঠকে এটি স্পষ্ট হয়ে যায়। লন্ডনের হোটেল ডরচেস্টারে দুই নেতার বৈঠকটি দেশের রাজনীতির ইতিহাসে মাইলফলক। বলা হয়ে থাকে, এ বৈঠকের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাঁক বদলের সূচনা হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন আয়োজনের রোডম্যাপ এখনো স্পষ্ট হয়নি তা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট দ্বিধা রয়ে গেছে। যতই দিন যাচ্ছে সংশয়ও বাড়ছে। যদিও ইসি শিগগিরই তফসিল দেয়ার প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব নেয়ার বর্ষপূর্তিতে ফের জানিয়েছেন ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন। সবশেষ মালয়েশিয়া সফরে গিয়েও বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে তিনি সরে যাবেন। একই সঙ্গে তিনি এও বলেছেন, বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে পুরনো সমস্যা ফিরবে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক চ্যানেল নিউজ এশিয়াকে (সিএনএ) দেয়া টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন তিনি।
ড. ইউনূস সাক্ষাৎকারে বলেছেন, গণ-অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচার ও সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে বাংলাদেশে আবার পুরনো সমস্যাগুলো ফিরে আসবে। তিনি বলেন, আমরা নিজেরা যে লক্ষ্যগুলো নির্ধারণ করেছিলাম, সেগুলো আমরা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছি। আমাদের অঙ্গীকার ছিল গণ-অভ্যুত্থানের সময় জাতির যে আকাঙ্ক্ষা, তা নিশ্চিত করা। এগুলো তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। যদি আমরা নির্বাচন দিয়ে শুরু করি তাহলে আমাদের সংস্কারের প্রয়োজন নেই, বিচারের প্রয়োজন নেই। কারণ, আমাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন হলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। তাহলে সবকিছু নির্বাচিতদের হাতে চলে যাবে। কল্পনা করুন, অন্য দু’টি কাজ না করে নির্বাচন হয়েছে। তখন আপনি আবার সেই পুরনো সমস্যায় ফিরে যাবেন।
একইরকম সুরে কথা বলেছেন নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিও। জামায়াতে ইসলামীর সুরও অভিন্ন। কুয়ালালামপুরে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের আগেই এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। যদি ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হয়, আমার যে ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিল, রক্ত দিয়েছিল সংস্কারের জন্য, তাহলে কবরে গিয়ে তার লাশটা ফেরত দিতে হবে এই সরকারকে। আমার যে ভাইয়ের হাতটা চলে গিয়েছিল, যদি সংস্কার কাজ শেষ না করে নির্বাচন হয়, তাহলে এই সরকারকে আমার ভাইয়ের হাতটা ফিরিয়ে দিতে হবে। যে মায়ের বুক খালি হয়েছিল, ওই মায়ের বুকের সন্তানকে ফেরত দিতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না যে ‘শব্দবন্ধে’ তিনি বলেছেন তা কতোটা তার বলার এখতিয়ার। নির্বাচন কবে হবে বা হবে না, এটা বলা তো সরকারের দায়িত্ব। এনসিপি নেতাদের এ ধরনের বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা বেড়েছে বহুগুণ। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পরও জনমনে প্রশ্ন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে তো! সাধারণ মানুষ নির্বাচন নিয়ে অবিশ্বাসের দোলাচলে দুলছে। নাসীরুদ্দীনের এমন বক্তব্যে সেই সংশয়কে আরও ঘনীভূত করলো। প্রধান উপদেষ্টা ও এনসিপি নেতাদের বক্তব্য একই সুরে হওয়ায় এ নিয়ে আরও সংশয় বাড়বে বলেই মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বক্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপি’র একাধিক নেতা বলেছেন, আরেকটি স্বৈরাচারের পদধ্বনি দেখতে পাচ্ছেন তারা। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. জাহিদ হোসেন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, কেউ কেউ হুমকি দেন যে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে দেবেন না। মনে হচ্ছে, সেই স্বৈরাচারের যে আচরণ ছিল, সেই স্বৈরাচারের যে কথা ছিল- সেই ধরনের কথার পদধ্বনি আমরা শুনতে পাচ্ছি। বিএনপি’র একাধিক সিনিয়র নেতার প্রতিক্রিয়া একই।
এদিকে, নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই রাজনীতিতে বিতর্ক চলছে, কোন পদ্ধতিতে হবে নির্বাচন তা নিয়ে। জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু ইসলামী দল পিআর (সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে) পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবিতে মাঠে নেমেছে। কিন্তু দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি প্রথম থেকেই এ পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিরোধিতা করে আসছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রের কথাও বলেছেন। নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে- এ নিয়ে এখনো সরকার বা নির্বাচন কমিশন কিছুই স্পষ্ট করেনি। অথচ পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবিতে মাঠ তাতানো শুরু করেছে বেশ কিছু দল।
কথা হচ্ছে, সংস্কার, বিচার, নির্বাচন- এই তিনটি অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীতে এই তিনটি বিষয়ই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ তা নিয়ে বিতর্ক নেই। তবে সংস্কার ও বিচার চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কার চূড়ান্ত বাস্তবায়নে দরকার একটি নির্বাচিত সরকার। আর বিচার চলমান প্রক্রিয়া এবং সময়সাপেক্ষ। নির্বাচনের আগে এই দু’টি বিষয়ের সুরাহা করতে হলে ঘোষিত সময়ে নির্বাচন সম্ভব কিনা তা নিয়ে নিয়ে জনমনে সংশয় বাড়ছেই।
সিনিয়র সাংবাদিক নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর ফেব্রুয়ারিতে যেনো নির্বাচন না হয় বহু রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয়- এমন আশঙ্কা করে বলেছেন, সরকারের মেয়াদ কতোদিন? এই সরকারের যত সময় যেতে থাকে তখন তারা কখনো যৌক্তিক সময়ের মধ্যে, কখনো দ্রুততর সময়ের মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছেন। তবে নির্বাচনটা যাতে তাড়াতাড়ি, মানে ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন না হয়, তার জন্য বহু ধরনের রাজনৈতিক শক্তি এর মধ্যে সক্রিয় ছিল, এখনো আছে। তিনি বলেন, সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন নিয়ে নানা তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে সরকারের মধ্যে। কিন্তু প্রত্যেকটি জায়গায় কথার সঙ্গে কাজের তেমন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। হতাশাটা আসলে সে কারনেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।
সংস্কার ও বিচার সম্পন্ন না করে নির্বাচন হলে দেশ ফের আগের পথেই হাঁটবে- ড. ইউনূসের এ বক্তব্য আমলে নিলে জনমনে নির্বাচন নিয়ে সংশয় বাড়বে- এটাই স্বাভাবিক। ড. ইউনূস প্রতিশ্রুত সময়ে নির্বাচনের আর মাত্র পাঁচ মাস বাকি। এখনো রোডম্যাপ আসেনি নির্বাচনের, হয়নি চূড়ান্ত ভোটার তালিকা, কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে তা নিয়ে বিতর্ক চলমান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সূচক ক্রমাগত নিম্নমুখী, চলছে মবোক্রেসি, জুলাই সনদ এখনো চুড়ান্ত হয়নি, সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে যাওয়া নিয়েও বিতর্ক চলছে আর এরমধ্যেই চলছে নির্বাচন বিলম্বের নানা আওয়াজ। সার্বিক পরিস্থিতিতে চোখ রাখলে মনে হয়, এ যেনো সরকারের ভেতরে আরেক সরকার কাজ করছে। বলছে একটা- কিন্তু করছে আরেকটা। উল্লিখিত বিষয়গুলো স্পষ্ট করার দায়িত্ব সরকারের। জনমনে সন্দেহ দূর করার দায়িত্ব সরকারের এবং কেবল সরকারেরই। বলাবলি আছে, নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে তৃতীয় পক্ষ ততই সুযোগ নিতে পারে। যা দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।
সার্বিক পরিস্থিতিতে ড. জেকিল ও মি. হাইডের সেই বিখ্যাত গল্পের কথা মনে পড়ছে। ড. জেকিল একজন বিজ্ঞানী। অন্যদিকে মিস্টার হাইড বিপজ্জনক ব্যক্তি। একই চরিত্রের দু’টি দিক। গল্পের মূল বিষয় হলো মানুষের দ্বৈত চরিত্র। যেখানে ভালো এবং মন্দ উভয় দিকই বিদ্যমান। ড. জেকিল একটি ওষুধ তৈরি করে নিজেকে হাইডে রূপান্তরিত করেন। মিস্টার হাইড অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত। একটা সময় ড. জেকিল মিস্টার হাইডের রূপে এতটাই আটকা পড়েন যে, আর নিজের রূপে ফিরতে পারেন না। ভালো ও মন্দের উভয় চরিত্রের দ্বন্দ্ব সবসময়ই লড়াই করে। শেষ বিচারে ভালোর জয় না হলেই বিপদ।
Politics hates a vacuum. If it isn’t filled with hope, someone will fill it with fear-Naomi Klen.
রাজনীতি শূন্যতাকে ঘৃণা করে। আশার ঘাটতি থাকলে সুযোগ সন্ধানীরা জায়গা দখল করে নেয়-নাওমি ক্লেনের এ বক্তব্যের সত্যতা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হোক এমনটি আমরা কেউই চাই না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত জনপ্রতিনিধির হাতে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেবেন এমনটিই প্রত্যাশা।