নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে যাতে না হয় এজন্য বহু রাজনৈতিক শক্তি সক্রিয়। গভর্ন্যান্সের প্রশ্নে সরকারের কোনো কার্যকারিতা আমরা দেখি না বলে মন্তব্য করেছেন সাংবাদিক নূরুল কবীর। তিনি বলেন, আটজন উপদেষ্টার দুর্নীতির প্রমাণগুলো সমাজের সামনে উপস্থিত করা সেই সাবেক সচিবের নৈতিক দায়িত্ব। তার মতে, ড. ইউনূস ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দিয়েই একটা সম্মানজনক বিদায় নেয়ার জন্য আগ্রহী। নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করার জন্য যে প্রস্তুতি, তা সরকার সদ্য শুরু করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো অতীতে যেভাবে দমন-পীড়ন করেছে, গণ-অভ্যুত্থানের পরে বেশ কয়েক বছর আর করা সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, অবৈধভাবে চাঁদা দিতে হয়, তাহলে আপনাদের সিট সংখ্যা কমে যাবে। নিউ এজ সম্পাদক বলেন, সংস্কার, বিচার, নির্বাচন নিয়ে তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে; তবে কথার সঙ্গে কাজের তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সর্বোপরি তিনি বলেন, সরকার-রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের আশা জাগানিয়া কিছু করতে পারছে না।
গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে বাংলাদেশ। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশ গঠনের কাজ চলছে। বিচার-সংস্কার এখন প্রায়োরিটি লিস্টে। শঙ্কা থাকলেও বেজে গেছে নির্বাচনের ঢোল। আওয়ামী লীগ পরবর্তী কোন দল চালাবে দেশ? কেমন হবে পরিস্থিতি? কতোটা সজ্জিত হচ্ছে নির্বাচনের ট্রেন? কতোটা নিরাপদ হবে যাত্রা? এসব নানা বিষয়ে কথা বলেন ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীর। জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় চ্যানেল আই’র তৃতীয় মাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি।
নূরুল কবীর বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার পেছনে যে শক্তিসমূহ রাজনৈতিক ন্যায্যতা জুগিয়েছিল পরে যারা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) হিসেবে সংগঠিত হয়। ইনডিভিজ্যুয়াল হিসেবে যে তরুণরা গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে ছিলেন। বিএনপিসহ অপরাপর রাজনৈতিক দল এবং তাদের সমর্থনই, গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে প্রস্তাবেই বর্তমান সরকারের প্রধান নিযুক্ত হন। তিনি পরে অন্যদেরকে তার ক্যাবিনেটে অন্তর্ভুক্ত করেন। এই ঘটনাটা মসৃণভাবে সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী নেতৃত্ব ফ্যাসিলিটেট করেছিল। ফলে এই সরকারের রাজনৈতিক ন্যায্যতার পেছনে এই ফ্যাক্টরগুলো এবং আমরা জনগণেরও কোনো অংশ, কোনো গোষ্ঠী বা সমপ্রদায়কে এটার বিরোধিতা করতে দেখি নাই। এই সরকারের একটা সর্বজনীন রাজনৈতিক ন্যায্যতা তৈরি হয়েছিল। তার ভিত্তিতেই এই সরকার তাত্ত্বিক অর্থে প্রতিষ্ঠিত আছে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সরকার তিনটি কাজের কথা বলেছিল। তারা কী করবেন? ১. গণতান্ত্রিক সংস্কার; রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে গভর্ন্যান্স যেটা। ২. এই গণ-অভ্যুত্থানের সময়, বিশেষত যত ধরনের রাষ্ট্রের দিক থেকে, আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে যে খুন-খারাবি হয়েছে, আহত-নিহত হয়েছেন, তাদের, ওই অপরাধীদের বিচার নিষ্পন্ন করা। ৩. এই দুটো কাজ এগিয়ে গেলে, একটা নির্বাচনের মাধ্যমে, যথার্থ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চলে যাবেন।
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে জনগণের আবেগ-উচ্ছ্বাস এ পর্যন্ত পৌঁছেছিল যে, এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোও সেদিন এটা মনে করার বা বোঝানোর কেউ ছিল না যে, এই সরকারের মেয়াদ কতোদিন। মেয়াদের ব্যাপারটা তখন উহ্য থেকে যায়। দিন যত যেতে থাকে, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় যাওয়ার কথা তত মনে পড়ে। তখন তারা নানান পর্যায়ে কখনো যৌক্তিক সময়ের মধ্যে, কখনো দ্রুততর সময়ের মধ্যে এই সমস্ত দাবির প্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছেন। এই নির্বাচনটা যাতে এত তাড়াতাড়ি, মানে ফেব্রুয়ারির মধ্যে সম্পন্ন না হয়, তার জন্য বহু ধরনের রাজনৈতিক শক্তি এর মধ্যে সক্রিয় ছিল, হয়তো এখনো আছে।
নূরুল কবীর বলেন, কিন্তু সরকারের কতোগুলো গভর্ন্যান্স ফেইলিউরের জন্য সরকারের ভেতরেও যারা বিরোধিতা করতেন তারা বুঝতে পেরেছেন নির্বাচন হয়তো দূরবর্তী পর্যায়ে টেনে নেয়া সম্ভব না। কারণ, কতোগুলো লক্ষণ আমরা দেখি যে, তেমন কোনো কিছুই পরিবর্তন হয় নাই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরং গভর্ন্যান্সের প্রশ্নে বলছি, সরকারের কোনো কার্যকারিতা আমরা দেখি না। ভয়াবহভাবে অন্যায় এবং অবৈধভাবে চাঁদাবাজি চলছে। প্রায় এই কয়েক মাসে ১০০-এর বেশি লিঞ্চিং-এর ঘটনা ঘটেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড পাবলিকের মধ্যে। সরকারি রাষ্ট্র-প্রশাসন এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগ আমলের মতন সেই উত্তেজনা-উৎসাহ তাদের কমেছে। কিন্তু সামাজিকভাবে ল’ অ্যান্ড অর্ডার না থাকবার কারণে এই ধরনের রাস্তাঘাটে পিটিয়ে মারা, মব সৃষ্টি করে পিটিয়ে মারার ঘটনা অসংখ্য ঘটছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকার তুলনামূলকভাবে একটা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল। এর বাইরে এই সমাজের মধ্যে ঘুষ-দুর্নীতি বেড়েছে।
সাবেক সচিব এ বি এম আব্দুস সাত্তার আটজন উপদেষ্টার দুর্নীতির কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি মনে করি আটজনের কথা বলেছেন যিনি তিন নিজে জাতীয়তাবাদী দলের একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তার মতো মানুষের আবার প্রমাণ ছাড়া ঢালাওভাবে কতোগুলো নাম উচ্চারণ করা ঠিক হয়নি বলে আমি মনে করি। সেই প্রমাণগুলো সমাজের সামনে উপস্থিত করা তার নৈতিক দায়িত্ব। নতুবা আমরা এটা একটা রাজনৈতিক দায়িত্বহীনতা হিসেবে দেখবো।
তিনি বলেন, গভর্ন্যান্সের দিক থেকে কোনো গুণগত উত্তরণ সংঘটিত হয় নাই। এজন্য যারা অতি উৎসাহী ছিল যে, এই সরকারকে আরও প্রলম্বিত করে, সরকারের ভেতরে যারা ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে চান, তাদের উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়েছে। ড. ইউনূস ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন দিয়েই একটা সম্মানজনক বিদায় নেয়ার জন্য আগ্রহী আছেন বলে আমার ধারণা।
রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকে জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপি, তারা আরও সময় পেলে তাদের দুটো উপকার হতো বলে তারা বিশ্বাস করতেন। একটা হচ্ছে, বিএনপি’র রাজনৈতিক দল হিসেবে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে কিছু উদ্যোগ এবং নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও, সারা দেশের বিভিন্ন জায়গায় তারা যে অন্যায় চাঁদাবাজি, জবরদখলের মধ্যে গেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর, রাজনীতির জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু সেই ক্ষতিগুলোতে জামায়াত এবং বিএনপি’র যারা রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, নেক্সট নির্বাচনে যাদেরকে দেখা যাবে। তারা উচ্চবাচ্য করলেও মনে মনে তারা খুশি ছিলেন। কারণ বিএনপি যত অজনপ্রিয় হবে, তাদের আসন সংখ্যা তত বৃদ্ধি পাবে। এই ধারণা থেকে এবং আরও নিজেদেরকে সংগঠিত করার সময় পাবেন। এই দু’টি রাজনৈতিক সংগঠন তাদের এরকম একটা আকাঙ্ক্ষা বরাবরই ছিল এবং থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, নির্বাচনটাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য সরকারের যে ধরনের ব্যাপক প্রস্তুতি থাকা দরকার, সেই প্রস্তুতি তারা সদ্য শুরু করেছেন বলে মনে হয়। বিচার প্রসঙ্গে বলেন, রাজনৈতিক দল এবং সংগঠন হিসেবে রাষ্ট্রীয় তৎপরতার নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের ওপর। যদি ১৫ই আগস্ট উপলক্ষে তারা কোনো কর্মসূচি গ্রহণ করে, সেটা বেআইনি হিসেবে সম্ভবত প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বাংলাদেশ বারবার নানা ধরনের বড় বড় সংগ্রামে আত্মাহুতি দানের মধ্যদিয়ে একটা গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার দিকে যেতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে কয়েকজন মিলেমিশে তাদের সংগঠিত শক্তি রয়েছে বলেই সেগুলোকে ইগনোর করতে পারবে, আমি মনে করি তাহলে তাদের ইতিহাসবোধের দিক থেকে হীনতা আছে। হয়তো আমরা এই পর্যায়ে একটা সত্যিকার অর্থে ইস্যুগুলো নিয়ে আলাপ করলাম, একটা গুণগত গণতান্ত্রিক সংস্কার পরিপূর্ণভাবে আমরা করতে পারবো না। কিন্তু তাদের বোঝা দরকার যে, এই ধরনের গণ-অভ্যুত্থানের পরে তারা ইচ্ছা করলেই অতীতে যেভাবে সরকার চালিয়েছেন, বিরোধী দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে, ভিন্নমতকে দমন করবার ক্ষেত্রে যেই পদ্ধতি বিভিন্ন মাত্রায় অতীতের রাজনৈতিক দলগুলো ব্যবহার করেছে, অবলম্বন করেছে, সেগুলো তাদের পক্ষে বেশ কয়েক বছর আর করা সম্ভব হবে না। সুতরাং তাদের নিজেদেরকে, নিজেদের দলকে এবং নিজেদের মন এবং মননকে, মননের ভেতরে একটু গণতান্ত্রিক সংস্কার আনয়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরের কথার সারমর্ম তুলে ধরে জিল্লুর রহমান বলেন, তার একটা খুবই প্রণিধানযোগ্য বাক্য দিয়ে আমি আলোচনাটা জাস্ট শেষ করতে চাই। অবৈধ চাঁদা আদায় করে বৈধ ভোট আশা করা ঠিক নয়। রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে এখন ক্রিয়াশীল যে বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক-আদর্শিক বিভ্রান্তির মধ্যে ঘুরপাক খাওয়ার যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, সেটা দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। ওই দলটির জন্যও কল্যাণকর নয়। সরকারের মধ্যেও নানা তৎপরতা, উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিশেষ করে সংস্কার ও বিচার। এমনকি নির্বাচন নিয়ে। কিন্তু প্রত্যেকটা জায়গায় কথার সঙ্গে কাজের তেমন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সরকার-রাজনৈতিক দল, যারা আসলে দেশ পরিচালনার সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত; যাদের উপরে মানুষের আস্থা রাখতে হয়। তারা কোনোভাবেই মানুষের মধ্যে আশা জাগানিয়া কিছু করতে পারছে না। হতাশাটা আসলে সে কারণেই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। যে কারণে মানুষ কাকে ভোট দেবে আর কাকে ভোট দেবে না সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে যাচ্ছে। এটাও দেশের জন্য কোনো অবস্থাতেই শুভ লক্ষণ নয়।
গ্রন্থনা: পিয়াস সরকার