চব্বিশের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের ৫ মাসের মাথায় দ্বান্দ্বিক অবস্থানে চলে যায় বিএনপি-জামায়াত। তখনো বিষয়টি পুরোপুরি খোলাসা হয়নি, বাকযুদ্ধের সূচনা হয়েছে মাত্র। তাদের এই অবস্থান নিয়ে ১লা ফেব্রুয়ারি ’২৫ ছিল জনতার চোখ-এর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। শিরোনাম ‘মুখোমুখি বিএনপি-জামায়াত’। অভ্যুত্থানের প্রধান দুই শক্তির ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা নিয়ে সম্ভবত এটাই ছিল প্রথম এবং বিস্তারিত প্রতিবেদন। দেড় যুগ আগে ৫ বছর একসঙ্গে সরকারে ছিল দল দু’টি। চারদলীয় জোট সরকারে প্রধান ছিল জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। জামায়াত দ্বিতীয়। তৃতীয় এবং চতুর্থ দল দু’টি সরকারে অন্য সুবিধা পেলেও জামায়াত ভাগ পেয়েছিল দু’টি মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু ২০০৬ সালে সেই জোট সরকার বিতর্কের মুখে পড়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন প্রশ্নে নিজেদের ক্ষমতায় ফেরার ছক কষতে গিয়ে। যদিও পরবর্তীতে ভারত-চীন, সুশীল সমাজ, পুলিশ আর সেনা নেতৃত্বের ওপর ভর করে টানা ১৫ বছর ক্ষমতা ধরে রাখা শেখ হাসিনা সেই তত্ত্বাবধায়কই গিলে খেয়েছেন!
যাক, হাসিনা তথা আওয়ামী শাসনের জাঁতাকলে কতোটা পিষ্ট ছিল বিএনপি-জামায়াত উভয়ে, তা তাদের চেয়ে ভালো আর কে জানে? কিন্তু দুর্ভাগ্য, ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে হাসিনার বিদায়ের পর মুক্তভাবে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেয়েই তারা আজ সব বেমালুম ভুলতে বসেছে। তারা শক্তি প্রদর্শন তথা ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এই অভ্যুত্থানে তাদের চেয়ে সাধারণের অংশগ্রহণ যে বেশি ছিল সেটি আগস্টের দিনগুলোতে দল দু’টির নেতাদের বয়ানে শর্তহীন স্বীকারোক্তি রয়েছে। কিন্তু ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই নয়া নয়া বয়ান হাজির করছেন দল দু’টির নেতারা। তারা একে অন্যকে ঘায়েল করতে মরিয়া।
’২৪-এর বিপ্লবে বিএনপি-জামায়াত উভয়ের শক্তি সমর্থন ছিল। এক সময় এটাকে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন বলে কামান-এপিসি দিয়ে ধূলিসাৎ করে দেয়ার নির্দেশও ছিল। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণে। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এটা মানতে হবে যে, ওই আন্দোলন সফলতা না পেলে ইতিহাস ভিন্নভাবে লেখা হতো। কতো মায়ের বুক খালি হতো, কতো লাশ বেওয়ারিশ দাফন হতো, কতো লোকের জীবন আয়নাঘর, কারাগার কিংবা বিদেশে ফেরারি অবস্থাতেই শেষ হতো তা ভবিষ্যৎবেত্তা একমাত্র স্রষ্টাই ভালো জানেন।
কিন্তু আজ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলো বিভক্ত! বিপ্লব হাতছাড়া হওয়ার পথে। প্রতিবিপ্লবের আশঙ্কা প্রতিনিয়ত। এ জন্য অনেকে ধাম করে ‘যড়যন্ত্র’ খুঁজবেন! বলবেন দেশি-বিদেশি যড়যন্ত্রে কাবু আমরা। তারা কখনোই নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার করবেন না।
আওয়ামী লীগের পতনের পর সঙ্গতকারণেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি। তিনবার সরকার গঠন করা দলটি ফের ক্ষমতায় যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোথায় যেন গোলমাল! সব কিছুই যেন ওলটপালট। বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের তাড়াহুড়ো লক্ষণীয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, আওয়ামী লীগ এবং তাদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা ভারতবিরোধী কার্ডের বড় স্টেইক বিএনপি’র। জামায়াতও সেই কার্ডের দাবি করতো। কিন্তু এখন বিএনপি’র ভারতবিরোধিতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। পতিত স্বৈরশাসনের সমালোচনার সঙ্গে তাদের বয়ানের বড় অংশ জুড়ে আছে জামায়াতবিরোধিতা। অন্যদিকে জামায়াতও বিএনপিকে টার্গেট করে মাঠে নেমেছে। তাদের বয়ানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ‘যেমন আওয়ামী লীগ তেমন বিএনপি’ এই ধারণাটি জনমনে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলছে। এসবই হচ্ছে ভোটের হিসাব মাথায় রেখে। কিন্তু বাস্তবতা কি? ভোটের হিসাবনিকাশ তো দিনে দিনে জটিল হচ্ছে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি তো আছেই। সঙ্গে ট্রাম্পের শুল্কনীতি বাংলাদেশকে বাড়তি চাপে ফেলেছে। যদিও জোট নিরপেক্ষ সব দেশগুলোর ওপরই এই খড়্গ কমবেশি নামবে। ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি’র ভূমিকাও আলোচনায়। আদৌ তারা নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা? অংশ নিলে ভোটের আগে তারা কতোটা নিজেদের গোছাতে পারবে? কার সঙ্গে জোটবদ্ধ হবে ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস নিয়ে নতুন কোনো রাজনীতি আছে কিনা? পিআর পদ্ধতি শেষ পর্যন্ত প্রয়োগ হবে কি না? গোপালগঞ্জে এনসিপি’র ওপর হামলা এবং দলটির নেতাদের রক্ষায় সেনাবাহিনীর এপিসি’র গাড়িতে তোলার ছবি ভাইরাল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি নানা ঘটনা যেনো নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে যাচ্ছে।
পরিশেষে: রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। তাপ-উত্তাপ আছে, থাকবে। কিন্তু সেই উত্তাপ সাধারণের সহ্য ক্ষমতার মধ্য থাকলেই ভালো। এটি মানুষকে হয়রানি কিংবা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ওপর আঘাত হিসেবে নাজিল না হলেই হয়। আগেও বলছি- এখনো বলবো- আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ওয়াকওভার দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে পরাজিত দলটিকে নিয়ে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি’র নিজস্ব চিন্তা রয়েছে। তাদের কেউ রিফাইন আওয়ামী লীগ চান কেউবা তাদের অস্তিত্বই রাখতে চান না। বাস্তবে এসবের কোনোটাই সম্ভব নয়। ৭৫ বছর বয়সী দলটির নিজস্ব রাজনীতি রয়েছে। তারা নিজেদের মতো করে তাদের আগামীর রাজনীতি ঠিক করবে। এজন্য অন্তত বিএনপি, জামায়াত কিংবা এনসিপি’র পরামর্শের প্রয়োজন হবে বলে অনেকেই মনে করেন না। তারা আগামী নির্বাচনে প্রার্থী দিলে এক, আর দূরে থাকলে বা রাখলে হিসাব হবে অন্য।