মহাকালের চাকা কখনো কখনো খুব দ্রুত ঘুরে। কিছু দিনে এমন ঘটনা ঘটে যা হয়তো একশ’ বছরেও ঘটে না। ১৪ই জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট। বাংলাদেশ এমন একটি সময়ই পার করে এসেছে। তবে স্থিরতা যে ফিরেছে এমনটা নয়। গুঞ্জন-গুজব চারদিকে। অনলাইন-অফলাইনে নানা কথা। সে আলোচনা হয়তো অন্যদিন করা যাবে। এখনো অনেকে বিস্মিত চোখে যে প্রশ্নটি করেন তা হলো কী করে সম্ভব হলো? ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী শাসকদের একজনের পতন কীভাবে হলো-একসময় যা অসম্ভব মনে হয়েছিল? এ আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট কোনটি? মাস্টার মাইন্ডইবা কে? নানা আলোচনা, প্রশ্ন। কোন সব ইস্যু মুখ্য ভূমিকা রেখেছিল এ আন্দোলনে- একনজরে দেখার চেষ্টা করি আমরা।
হাসিনার সংবাদ সম্মেলন
১৪ই জুলাই, ২০২২। বিকালটা অন্য দশটা দিনের মতোই। গণভবনে সংবাদ সম্মেলন। স্বভাবসুলভ, স্বতঃস্ফূর্ত শেখ হাসিনা। বিপুল সাংবাদিকের উপস্থিতি। যদিও তাদের মূল পরিচয় স্তাবক। সংবাদ সম্মেলনের ইতিহাসে এক নতুন সংযোজন। আমার এক শিক্ষিকা লিখেছিলেন, ‘কোনো ক্লাসে এ সাংবাদিকতা শেখানো সম্ভব নয়।’ প্রশ্নের নামে চলতো দীর্ঘ বক্তৃতা। এমনই এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। বলেন, ‘মানে কি? মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা মেধাবী না, যতো রাজাকারের বাচ্চা, নাতিপুতিরা মেধাবী।’ তার এ মন্তব্যের প্রতিবাদে রাতেই ক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। দেড় দশকের শাসনামলে প্রথম এমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন শেখ হাসিনা। সে রাতেই আসলে আন্দোলন একটি নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগ লেলিয়ে দেয়া বিগত শাসকদের একটি বড় ভুল ছিল বলে অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন। এ ছাড়া, শুরুতে সমঝোতার চেষ্টা না করে নির্বিচারে শক্তি প্রয়োগও বিপর্যয় নিয়ে আসে।
মাস্টারস্ট্রোক
৪ঠা আগস্ট, ২০২৪। অসহযোগ চলছে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা নির্বিচারে হামলা চালাচ্ছেন আন্দোলনকারীদের ওপর। গুলি চলছে সমানে। মুহূর্তে মুহূর্তে আসছে মৃত্যুর খবর। সর্বত্র আতঙ্ক। এরইমধ্যে পরবর্তী দুই দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন সমন্বয়করা। ৫ই আগস্ট শ্রমিক সমাবেশ। ৬ই আগস্ট মার্চ টু ঢাকা। কিন্তু একপর্যায়ে একটি বার্তা পান সমন্বয়করা। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি এগিয়ে আনা হয় একদিন। আদতে যেটি ছিল গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি। বার্তা দেয়া হয় সারা দেশে। বলা হয়, হয় কাল, না হয় কোনোদিনই নয়। আদতে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি এগিয়ে আনাই ছিল আন্দোলনে সবচেয়ে বড় মাস্টারস্ট্রোক। খবর বেরিয়েছে, ওই দিনই সার্বিক পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন দিল্লিকে জানিয়ে দেয়, শেখ হাসিনার সময় শেষ হয়ে গেছে।
শহীদের মিছিল, আবু সাঈদের বুক
আবু সাঈদের ঝাঁঝরা বুক যেন বাংলাদেশের হৃদয়। কী অসীম সাহসের সঙ্গে বুক পেতে দিয়েছিল এক তরুণ। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। অনেকে অবশ্য বলেন, আবু সাঈদের বিশ্বাস হচ্ছিলো না! স্বাধীন দেশের পুলিশ নিরস্ত্র কোনো যুবকের বুকে এভাবে গুলি চালাতে পারে। আবু সাঈদের বুক এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান পোস্টার। তারপর প্রায় প্রতিটি দিনই ছিল রক্তাক্ত। লাশের কাউন্ট ডাউন করতে গিয়ে নিউজরুমে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বাংলাদেশের ইতিহাসে আগে কখনো এমন ঘটনা ঘটেনি। কবরে অজ্ঞাত লাশের সারি। কতো মানুষ মারা গেলেন তার সুনির্দিষ্ট হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি। দেড় হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। পঙ্গু হয়ে গেছেন অনেকে। চোখ হারিয়েছেন ছাত্র-জনতা। এইসব নিষ্ঠুর ঘটনা মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
ঐক্যবদ্ধ, সাহসী ছাত্র-জনতা
এমন গুলির মুখেও মানুষের রাস্তায় অনড় থাকা বাংলাদেশের ইতিহাসেরই এক নজিরবিহীন ঘটনা। ‘গুলি করে করে লাশ নামানো লাগছে স্যার। গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না। এইটা হলো স্যার সবচেয়ে বড় আতঙ্কের এবং দুশ্চিন্তার বিষয়।’ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে বলা এক পুলিশ কর্মকর্তার এই কথাগুলো আসলে পুরো আন্দোলনের চরিত্র বুঝতে যথেষ্ট। এমন সাহসী, অনড় মানুষেরা এসেছিলেন সমাজের সব শ্রেণি-পেশা থেকেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা, মাদ্রাসা ছাত্র, শ্রমিক, পথশিশু, রাজনৈতিক কর্মী সবাই যোগ দিয়েছিলেন এ আন্দোলনে। সেকুল্যার-ইসলামিস্ট, হিজাব পরা, ওড়না না পরা সব নারী-পুরুষই ছিলেন এই মিছিলে। সেদিন এক সাংবাদিক বলছিলেন, ২রা আগস্টের ঘটনা। জুমার পর বায়তুল মোকাররম থেকে মাদ্রাসা ছাত্ররা একটি মিছিল বের করে। এক পর্যায়ে শাহবাগ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে তারা। ক্যাম্পাস এলাকায় উদীচীর একটি কর্মসূচি চলছিল। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা সেখানে যোগ দেন। সেদিন শহীদ মিনারে দিনভর কর্মসূচিতে ছিলেন হাজার হাজার মাদ্রাসা শিক্ষার্থী। মঞ্চ থেকে গাওয়া হচ্ছিলো নানা উদ্দীপনাময় গান। বিদেশে নির্বাসিত সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীরাও আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছেন। ফেসবুক-ইউটিউবে সবসময় মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন তারা।
বিরোধী নেতাকর্মীদের বলিষ্ঠ ভূমিকা
আওয়ামী লীগ এবং জোটভুক্ত দলগুলো ছাড়া সব দলই জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে শক্ত ভূমিকা রাখে। যদিও শুরুর দিকে তাদের কারও কারও মধ্যে দ্বিধা ছিল। তবে যতো সময় ঘরিয়েছে রাজপথে সর্বশক্তি নিয়ে অবস্থান নেন নেতাকর্মীরা। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক্ষেত্রে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন। তার নির্দেশনায় বিএনপি নেতাকর্মীরা এতে অংশ নেন। দলটির অনেক কর্মী-সমর্থক নিহতও হয়েছেন এ আন্দোলনে। জামায়াতও এ আন্দোলনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। দলটির নেতাকর্মীরা অনেক ত্যাগও স্বীকার করেছেন। এ আন্দোলনের নীতি কৌশল নির্ধারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক ও বর্তমান নেতারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।
ছাত্রনেতাদের কৌশল
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতারা বা সমন্বয়করা অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকা রেখেছেন। বিশেষত তারা নেতৃত্বের একাধিক সেট তৈরি করেছিলেন। যাতে একদল নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পরও অন্যরা নেতৃত্ব দিতে পারে। আন্দোলনের কর্মসূচি ও ভাষা প্রণয়নেও তারা নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাড়াও ছাত্রনেতারা দীর্ঘদিন ধরেই লড়াইয়ের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছিলেন।
শেষ কথা
এটা সবসময়ই হয়ে এসেছে। সফলতায় সবাই ভাগ বসাতে চান, ব্যর্থতার দায় কেউ নিতে চান না। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান এক মহাকাব্য। এখানে নাম জানা-অজানা বহু মানুষ ভূমিকা রেখেছেন। সশস্ত্র বাহিনীর গুলি না চালানোর সিদ্ধান্তও আন্দোলনে একটি নিয়ামক ঘটনা ছিল। এই আন্দোলনে এমন বহু মানুষ ভূমিকা রেখেছেন, যাদের অনেকের নাম হয়তো কখনোই প্রকাশ্যে আসবে না। মানুষের কাছে দানবিক শক্তির পরাজয় হয়েছে। তবে শেখ হাসিনা রেজিমের পতন মনে হয় নিয়তি নির্ধারিতই ছিল।