কলকাতার চিঠি

বিশ্বের গণমাধ্যমে হাসিনার সাক্ষাৎকার দেয়ার নেপথ্যে

পরিতোষ পাল | বিশেষ রচনা
নভেম্বর ৮, ২০২৫
বিশ্বের গণমাধ্যমে হাসিনার সাক্ষাৎকার দেয়ার নেপথ্যে

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশ্বের তিনটি প্রধান সংবাদ আউটলেটকে দেয়া তিনটি পৃথক সাক্ষাৎকার নিয়ে বাংলাদেশ তো বটেই ভারতেও প্রবল কৌতূহল তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে আলোচনায় এসেছে ভারতের ভূমিকাও। দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট (যুক্তরাজ্য), রয়টার্স (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) এবং এএফপি (ফ্রান্স)কে দেয়া ই-মেইল সাক্ষাৎকারগুলো একই দিনে প্রকাশ হয়েছিল। সাক্ষাৎকারগুলোতে অবশ্য মোটামুটি একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন শেখ হাসিনা।  


দিল্লিতে অবস্থানরত সাংবাদিকদের সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বের বহু সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি ভারতেরও বিভিন্ন গণমাধ্যম শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের জন্য চেষ্টা করেও সফল হয়নি। তবে সবাই মুখোমুখি সাক্ষাৎকারের প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু গত এক বছরের মধ্যে সেই চেষ্টা সফল না হলেও হঠাৎ কেন হাসিনা সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হলেন? কলকাতায় আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতার ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর নজর রেখে এতদিন শেখ হাসিনা রেকর্ডেড বা লাইভ ভাষণ দিয়েছেন সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন চ্যানেলকে ব্যবহার করে। সেই সব ভাষণের প্রধান লক্ষ্যই ছিল দেশের মধ্যে টিকে থাকা দলীয় সমর্থক ও কর্মীদের উজ্জীবিত রাখা। পরবর্তী স্তরে তিনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আন্দোলন জারি রেখে অওয়ামী লীগের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বার্তা দিয়েছেন। এই বার্তা পাওয়ার পরই বাংলাদেশের ঢাকা সহ বিভিন্ন শহরে আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকরা নানাভাবে মিছিল করছেন। এই সব ঝটিকা মিছিলে লোক সমাগমও বেশ নজর কেড়েছে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য সর্বত্র আওয়ামী লীগের কর্মী ও সমর্থকদের ব্যাপক হারে গ্রেপ্তার অব্যাহত রেখেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের বৃহত্তর মানুষকে অগ্রাহ্য করে এবং আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে ভোট করতে দেয়া হবে না জানিয়ে সোমবার ১০ই নভেম্বর বাংলাদেশ জুড়ে পথে নামার ডাক দেয়া হয়েছে শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে। আর এই সব প্রচেষ্টাকেই সরকার ও সক্রিয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ফ্যাসিস্টদের নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। 
বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কয়েকজন অবশ্য বলেছেন, গত বছরের ৫ই আগস্ট বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে আশ্রয় নেয়ার পর কিছুদিন চুপ ছিলেন তিনি। সেই সময় অন্য সিনিয়র নেতারা ভারতের গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা নিজের সক্ষমতা প্রমাণ করতে নিয়মিত বার্তা দিতে শুরু করেন। তবে গত ঈদের সময় হাসিনাপুত্র জয়ের দিল্লিতে এসে মায়ের সঙ্গে দেখা করার সময়ই পরবর্তী কার্যক্রমের রূপরেখা তৈরি হয় বলে মনে করা হচ্ছে। শেখ হাসিনার বিভিন্ন পদক্ষেপের নেপথ্যে রয়েছে জয়ের সক্রিয় ভূমিকা বলে জানাচ্ছেন অনেকে। সমাজমাধ্যমের বিভিন্ন চ্যানেলে একটি বড় টিমকে সক্রিয় করার পেছনেও রয়েছেন জয়। সক্রিয় রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ। আর  সব সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন প্রাক্তন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত। কলকাতার বেশ কয়েকজন অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ কোনোভাবেই যে সম্ভব নয় সেটা বুঝে গিয়েছেন শেখ হাসিনাসহ দলের নেতা ও কর্মীরা। আইনগতভাবেই সেটি ঠেকিয়ে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধে  বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল হাসিনা এবং অন্যদের বিরুদ্ধে ১৩ই নভেম্বর রায় ঘোষণা করতে চলেছে। সেই রায় যে কঠোর থেকে কঠোরতম হবে সেটাই প্রত্যাশিত। 


এই ঘটনা পরম্পরায়  শেখ হাসিনা  নতুন করে পরিকল্পনা সাজান।  আন্তর্জাতিক আদালতে  এবং জাতিসংঘের কাছে আবেদনের পাশাপাশি বিশ্বের কাছে তার মতামত পৌঁছে দিতে তিনি বহুল পরিচিত আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ভারতে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতারাও তাকে অনুরোধ করেছিলেন যে, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ঘোষণার আগেই শেখ হাসিনা তার বক্তব্য বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিন। 


এরপরেই তিনি সাক্ষাৎকার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।  রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহলের মতে, এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কূটনৈতিক নানা হিসাব-নিকাশ,  রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সময় এবং কৌশলগতভাবে  মিডিয়ার ব্যবহারকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে। সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থকদের ভোট বয়কটের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি যে বাংলাদেশে কোনো না কোনো সময় ফিরে যাবেন সেই আশ্বাসও দিয়েছেন। তার দলের অংশগ্রহণ ছাড়া গঠিত যেকোনো সরকার প্রত্যাখ্যান করেন বলেও তিনি জানিয়েছেন। 


একই কথা তিনি বলেছেন দীপ হালদার, জয়দীপ মজুমদার এবং শহিদুল হাসান খোকনের প্রকাশিতব্য ‘ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ: দ্য স্টোরি অব অ্যান আনফিনিশড রেভ্যুলুশন’-এ।  জনগণের কাছে ন্যায়বিচার পৌঁছে দিতে তিনি বাংলাদেশে ফিরে আসবেন বলে জানিয়েছেন। ভারতের নিউজ ১৮ সংবাদমাধ্যম সূত্রে এই তথ্য জানানো হয়েছে।


শেখ হাসিনা এবারই প্রথম নিজের মুখে জানিয়েছেন যে, তিনি ভারতে রয়েছেন এবং এখানেই থাকছেন। ভারতে আসার পর থেকে হাসিনাকে ভারত সরকার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় গোপন স্থানে রেখেছেন। তার গতিবিধিও অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত। আওয়ামী নেতাদের সঙ্গে তার  বৈঠকও হয়েছে অন্যত্র। ভারতে বসে হাসিনার রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালানো নিয়ে বাংলাদেশ সরকার নানা সময়ে আপত্তি জানিয়েছে। বাংলাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা বলেও জানিয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ভারত জানিয়েছে যে, হাসিনা ব্যক্তিগত ভাবে যে কথা বলছেন তাতে বাধা দেয়ার কোনো কারণ নেই। এমন কি হাসিনাকে  প্রত্যর্পণের দাবি নিয়েও ভারত চুপ করে রয়েছে। ব্যাংককে এক বৈঠকে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছেও বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। সেখানেও মোদি জানিয়েছিলেন, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে কাউকে চুপ করা সম্ভব নয়।


তবে হাসিনার সর্বশেষ পদক্ষেপ নিয়ে ভারত সরকারের মনোভাব জানতে সকলেই আগ্রহী। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রক এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে কূটনীতিকরা মনে করেন, ভারত সরকারের সবুজ সংকেত না পেলে হাসিনা এই ভাবে সাক্ষাৎকার দিতে পারতেন না। তাহলে ভারত সরকারের মনোভাবে কি কোনো পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে? 
ভারত সব সময়ই বাংলাদেশে “অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং অংশগ্রহণমূলক” নির্বাচনের কথা বলেছে। ইঙ্গিতটা স্পষ্ট ছিল। কিন্তু বাস্তবে তা আর সম্ভব নয় বলেই কি অবস্থানের বদল ঘটেছে? অবশ্য এর মধ্যে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল শুনিয়েছেন যে, বাংলাদেশে দুর্বল শাসনের কারণেই সরকার বদল ঘটেছে। সেক্ষেত্রেও ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। এটাকে ভারতের ভারসাম্যের কৌশল বলে অনেকে মনে করছেন। আগামী দিনে বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক তার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক গড়ে তুলতেই হবে। আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষায় সেটাই জরুরি হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে ইসলামী তৎপরতা বৃদ্ধি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সখ্যতার কারণে ভারত চিন্তিত। আবার বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সক্রিয়তা বজায় থাকুক সেটাও ভারতের লক্ষ্য বলে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন। আর তাই শেখ হাসিনার কার্যকলাপে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। আগামী দিনে হাসিনা তার তৎপরতা আরও প্রকাশ্যে করার পথে যেতে পারেন ভারত সরকারের অনুমোদনের ভিত্তিতে। 

বিশেষ রচনা'র অন্যান্য খবর