ভালোবাসার পানের খিলি/মুখে দিবো তুইলে/আমার বাড়ি আইসো বন্ধু/ প্রেমের বাক্স দেবো খুইলে...।
প্রিয় হাসু আপা,
গীতিকবির এমন ভাষ্য আমাকে উদ্বেলিত করেছিল। তাই আপনার মুখে যেমন পানের খিলি তুলে দিয়েছি, তেমনি খুলে দিয়েছি প্রেমের বাক্সও। শুধু আমি কেন গোটা দেশবাসী আমার মতো আপনাকে প্রেম, ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছিল। এ প্রেমে কোনো খাদ ছিল না। কোনো প্রতারণা ছিল না। ছিল না কোনো ছলনা। তারা আপনাকে হৃদয়ের মণিকোঠায় জায়গা দিয়েছিল। আর এ কারণেই আপনার আদরের ছাত্রলীগ দেশের প্রাইভেট ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসের গোডাউন করে তুলেছিল। হলে হলে টর্চার শেল গড়ে তুলেছিল। তাদের প্রতিও আপনার প্রেম এমন ছিল যে, আপনি এসব কর্মকাণ্ডকে সব সময় উৎসাহিত করেছেন। আপনার প্রেমের নমুনার কথা লিখতে এই হতভাগা কলম তুলে নিয়েছে। আপনাকে সেসব কথা মনে করিয়ে দিতে।
আপা, আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী দীর্ঘ প্রায় ষোল বছর একটানা ক্ষমতার মসনদে বসে বহু নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছেন। ইতিহাস সাক্ষী দেয়- যে ঘষেটি বেগম নিজের বোনের ছেলেকে ক্ষমতা থেকে সরাতে কতো না ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘষেটি বেগম সফলও হয়েছে। কিন্তু ঘষেটি বেগমকেও নৌকায় করে আত্মগোপনে পালাতে হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আপনার ষড়যন্ত্র ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েই যে শুরু করেছিলেন তা প্রেমের বাক্স খুলে দেয়া দেশের মানুষগুলো হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। আপনার রাজসিংহাসনের প্রতি এত লোভ তা তারা বুঝতে পারেনি। আপনি যেদিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত কমিটির সঙ্গে বৈঠকে বসে বলে দিলেন তত্ত্বাবধায়ক কিসের? সেদিনই দেশের বারটা বেজে যায়। গণতন্ত্র বঙ্গোসাগরের জলে তলিয়ে যায়। আপনি তখন সুর তুলেছিলেন উন্নয়নের গণতন্ত্রের। কী উন্নয়ন করেছেন গো আপা? একটি পদ্মা সেতু আর মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে? এসব উন্নয়ন ধুয়ে কি মানুষ পানি খাবে? আপনার ভালোবাসার মানুষগুলো বুঝে গেছে বড় বড় প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বড় অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য। লাখ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে ব্যাংকগুলো থেকে। এসব নাকি আপনার ইঙ্গিতে হয়েছে? সত্যিই বিশ্বাস করতে মন চায় না। কিন্তু বিশ্বাস না করেও যে উপায় নেই। জুলাই আগস্টের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতাকে হত্যার জন্য আপনার তহবিল থেকে শুধুমাত্র একজনকে ২৫ কোটি টাকা দিয়েছেন আপনি। আপনার এমন ভালোবাসায় ধন্য জাতি। গর্বিত জাতি। প্রেমের বাক্স খুলে দেয়ার প্রতিদান এভাবে দিলেন? ছিঃ। লজ্জা হয় বলতে আপনি এ দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কি বলবো বলুন তো? এটা তো আপনার শেষ দিনের কথা। শুরু তো করেছেন ক্ষমতায় এসেই। বিডিআর বিদ্রোহ নিজে ঘটিয়ে ৫৭ জন সেনা অফিসারকে হত্যা করে প্রতিশোধ নিয়েছেন। আপনার তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আপনার ভূমিকার কথা। আপনি তো আবার ভালো গানও জানেন বলে সোহেল তাজ জানিয়েছেন। কি গান জানেন? ওহ্ ‘আমি তোমাকে ছাড়বো না/আমি কাউকে ছাড়ি না।’ কথা আর কাজে খুব মিল আপনার। আপনি এ দেশটাকে বিভক্ত করে রেখেছেন। স্বাধীনতার পক্ষে আর স্বাধীনতার বিপক্ষে। কিছু হলেই বলতেন রাজাকার। দেখেছেন তো এই রাজাকার শব্দই আপনার জন্য কাল হলো। এখন দেশের যুবক- যুবতীরা নিজেদের রাজাকার বলে নিজেরা গর্ববোধ করে। একটু ভাবেন তো দেখি-রাজাকার শব্দকে আপনি কোথায় নিয়ে গেছেন। কাল বাসে যাচ্ছিলাম যাত্রাবাড়ী। সেই বাসে দুই ভদ্রলোক সিটে বসা নিয়ে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়। একসময় একজন অন্যজনকে গাল দেয় এই বলে ‘তুই মানুষ না, তুই আওয়ামী লীগ’। এখন মানুষ আওয়ামী লীগকে কোথায় নিয়ে গেছে একটু জানুন। আপনি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর বিভিন্ন সময় আপনার নেতাকর্মীদের সঙ্গে ফোনে কথা বলার রেকর্ড ফাঁস হচ্ছে। একবার শুনলাম আপনি সীমান্তের কাছেই আছেন বলে একজনকে আশ্বস্ত করছেন। আরেকটি ফোন কলে বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আর একমাসও টিকতে পারবে না। আর এসব শুনে আপনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় বলছেন, ‘আমার মা ক্ষমতা হারিয়ে পাগল হয়ে গেছেন। তার কথা কেউ ধরবেন না।’ আমি বলি কি এসব আপনার পুরনো খেলা। সেই আদিকালের খেলা। মনে পড়ে কী ইলিয়াস আলী গুমের কথা। দেশ জুড়ে চলছে তোলপাড়। কিন্তু আপনি নির্বিকার। কৌশলে আপনি ইলিয়াসপত্নীকে আপনার রাজদরবারে নিয়ে গেলেন। আশ্বাস দিলেন। সেই আশ্বাস আশ্বাসই থেকে গেল। আপনার রাজনীতির কূটকৌশলের নমুনার একটি উদাহরণ দিতেই হয়। আপনি যখন শুনলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো মারা গেছে তখন আপনার উত্তর ছিল- ইস আসলটা তো মরে নাই। তখন সঙ্গে আপনারই দলের একজন নেতা ছিলেন। তাকে বললেন, আমি খালেদা জিয়াকে দেখতে যাবো। কিন্তু গেইট যেন খোলা না হয়। কি নোংরা রাজনীতি। আপনি ঠিকই গেলেন। কিন্তু গেইট আর খোলা হলো না। আপনি গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। এরপর ফিরে এলেন। দেশবাসীকে দেখালেন আপনার মমতার উদাহরণ। কী চমৎকার আপনার অভিনয়। এখন বলতে হচ্ছে-একজন মানুষ হইয়া তুমি/কয়জনারে বিলাও মন/ উপর উপর দেখাও ভালা/ ভেতরে কয়লার মতন/ মুখের ভালোবাসা দেখাও/ অন্তর দিয়া বাসনা/বন্ধু তোমার ভালোবাসার ধরন ভালা না।
আপা, আপনার এই ষোল বছরের শাসন ইতিহাসে ঠাঁই হয়ে গেল এক কালো অধ্যায় হিসেবে। সেদিন এক সিএনজি দিয়ে যাচ্ছিলাম। সিএনজি চালক ষাটোর্ধ্ব বয়সের। কথার এক পর্যায়ে বলছিলেন- ‘আমি নমরুদ দেখিনি। ফেরাউন দেখিনি। তবে হাসিনা দেখেছি।’ বললাম, এ কি বলছেন চাচা? ক্ষেপে গিয়ে তিনি একে একে আপনার কর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরতে থাকলেন। এক পর্যায়ে বললেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ছাত্রলীগ ছাড়া কোনো যুবকই নির্ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারতো না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেত ভয়ে ভয়ে। কখন শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী শিবির ট্যাগ দিয়ে তাদের ধরে নিয়ে যায়। একদিনের উদাহরণ দিয়ে বললেন, আমার ছেলে ফার্মগেট সরকারি বিজ্ঞান কলেজে পড়ে। সেদিন কলেজ থেকে রায়েরবাগ বাসস্ট্যান্ডে নামামাত্র পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। প্রথমেই তার কাছ থেকে পুলিশ মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়। কদমতলী থানায় কিছুক্ষণ রেখে তাকে যাত্রাবাড়ী থানায় পাঠিয়ে দেয়। ওদিকে ছেলে সময়মতো বাসায় ফিরে না আসায় আমরা সবাই অস্থির। এমন সময় তার এক বন্ধু বাসায় এসে জানায় পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে তাকে। দৌড়ে কদমতলী থানায় যাই। অনুনয়-বিনয় করি আমার ছেলেকে ছেড়ে দিতে। থানা থেকে জানানো হয়- সে শিবির করে। তাকে যাত্রাবাড়ী থানায় পাঠানো হয়েছে। দৌড়ে যাত্রাবাড়ী থানায় যাই। তারা জানালো ছাড়ার সুযোগ নেই। কাল আদালতে পাঠানো হবে। সেখান থেকে জামিন নিয়ে ছাড়িয়ে আনবেন। সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। পরদিন সকালে আবার যাত্রাবাড়ী থানায় যাই। গিয়ে শুনি ভ্রাম্যমাণ আদালত বসেছে। যাত্রাবাড়ী থানায় শিবির সন্দেহে যাদের ধরে নিয়ে এসেছে তাদের একে একে সাজা দেয়া হচ্ছে। আমার ছেলেকেও তিন মাসের সাজা দেয়া হলো। আচ্ছা বাবা বলেন তো দেখি ভ্রাম্যমাণ আদালত তো তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনার জন্য তাৎক্ষণিক সাজা দেয়। আগের দিন ধরে নিয়ে পরেরদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে সাজা দেয়ার নজির হাসিনার আমলেই দেখলাম। আর এ ভ্রাম্যমাণ আদালতের সাজায় আমার নির্দোষ ছেলে তিন মাস সাজা ভোগ করে ফিরে আসে। এরপর সে প্রতিজ্ঞা করে শিবির ট্যাগ দিয়ে যখন আমাকে সাজা দেয়া হলো আজ থেকে আমি শিবিরের রাজনীতিই করবো। সে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। হিসাব করে দেখলাম এভাবে হাজার হাজার ছাত্র-যুবককে শেখ হাসিনা শিবিরের শিবিরে ঠেলে পাঠিয়েছেন। যাদের অনেকের পরিবার জন্মগতভাবে আওয়ামী পরিবার। আচ্ছা আপা, বলুন তো এসব কাজ কি হিতে বিপরীত হয়নি?
আজকে এ পর্যন্তই থাক। আগামী চিঠিতে মনে করিয়ে দেবো আপনার আরও সর্বনাশা খেলার কথা। সে পর্যন্ত ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।