বহুদিন পর মানবজমিনে গিয়েছিলাম। মানবজমিনের প্রাণপুরুষ মতিউর রহমান চৌধুরী আমার খুবই প্রিয়। তার পত্রিকা আর আমার দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের জন্ম একসঙ্গে। ’৯৯-এ সখিপুরের উপনির্বাচনে ব্যক্তিগতভাবে তিনি গিয়েছিলেন। এক অসাধারণ লেখা লিখেছিলেন, ‘ফাতেমার মানত পূরণ হলো না।’ তিনি যখন বাংলাবাজার পত্রিকা চালাতেন শত্রুপক্ষ তার পত্রিকা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল। সেখানেও গিয়েছিলাম। তিনি ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিনিধি। অনেকবার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বাংলাভিশনে টেনে নিয়েছেন বহুবার। আমাদের প্রিয়নেতা, জননেতা আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুসংবাদ স্টুডিওতে অনুষ্ঠান চলার সময় তিনি দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে কতো শত মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে যা বলে শেষ করা যাবে না। অন্যদিকে মানবজমিনের মতো পত্রিকা বাংলাদেশে আর খুব একটা নেই। পত্রিকাটি আমার স্ত্রী নাসরীনের খুবই পছন্দ। প্রতিদিন সকালে ৮-১০টি পত্রিকার মধ্যে তার সবার আগে মানবজমিন চাই। ইদানীং আমিও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। নাসরীন এসে পাশে বসলেই মানবজমিন তার হাতে তুলে দেই। সেই মানবজমিনে আমিও মাঝেসাজে লিখি। মানবজমিনে লিখে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। সেই মানবজমিনের প্রাণভোমরা মতিউর রহমান চৌধুরী সেদিন চা খেতে খেতে বলেছিলেন, ‘আমি একটা ম্যাগাজিন বের করেছি। প্রতি শনিবারে বের হবে। পুরোটাই রাজনৈতিক। আপনার লেখা নিয়ে শুরু করতে পারলে ভালো লাগবে।’ অন্যান্য অনেকের মতো মতিউর রহমান চৌধুরীর কোনো কথা ফেলি নাই। তাই তার নতুন ম্যাগাজিন ‘জনতার চোখ’-এ সানন্দে কলম ধরেছি।
এক সময় শুনেছিলাম কথাই কর্তৃত্ব করে- কথাই নেতৃত্ব করে। বহু বছর আগেই ব্যাপারটা হৃদয়াঙ্গম করেছি। পাকিস্তান আমলে বঙ্গবন্ধুর চাইতে বহু মানুষ শারীরিক শক্তিতে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধে তার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের কাছে সবাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। তার ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম অস্ত্র, দিকনির্দেশনা। ঠিক তেমনি লেখার যে কতো শক্তি সেটা এখন বুঝতে পারি। জীবনে প্রায় ৩০ বছর বইয়ের দিকে ফিরেও দেখিনি। বই সম্পর্কে কোনো আকর্ষণ ছিল না। সবকিছুতেই গুরু লাগে। কিন্তু আমার জীবনটাই গুরুহীন শুরু। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ায় জীবনের সবকিছু হারিয়ে গেছে। হৃদয় স্পন্দনের গতি কেমন যেন বেসামাল হয়ে গেছে। তারপরও তার হত্যার প্রতিবাদে নির্বাসিত বেকার জীবনে দিল্লির এসি সেনের কল্যাণে বই পড়তে আগ্রহী হয়েছিলাম। এরপর আনন্দবাজার পত্রিকার অভীক সরকার, তার বাবা অশোক সরকার, যুগান্তরের অমিতাভ চৌধুরী, দেশের সাগরময় ঘোষ, গতিবেগ চঞ্চল, বাংলাদেশ-এর অমিতাভ গুপ্ত, এলাহাবাদের আলোকপাতের রমাপ্রসাদ ঘোষাল, আনন্দবাজারের বরুণ সেনগুপ্ত, টাইমস অব ইন্ডিয়ার দীপ্ত সেন, যুগান্তরের পরেশ সাহা, দিল্লির পট-এর রাজেন্দ্র সারীন, হিরণ্ময় কার্লেকার, আনন্দবাজারের সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত, কলকাতার আমার রূপসী বাংলার পঙ্কজ কুমার দত্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়- এসব নানাজনের নানা চাপে লেখায় হাতে খড়ি, বিশেষ করে দে’জ পাবলিকেশনের সুধাংশু শেখর দে। এ ছাড়া কবি রফিক আজাদ, বুলবুল খান মাহবুব, মাহবুব সাদিক, সায্যাদ কাদির, বাবর, আবু কায়সার, কবি সামাদ আরও বেশ কিছু হিতৈষীর কল্যাণে মূলত লেখালেখির শুরু। ইদানীং লিখতে ভালোই লাগে। না লিখলেই বরং কেমন একটা শূন্যতা বোধ হয়। মাঝেসাজে ৩০-৪০ বছর আগের লেখা যখন পড়ি তখন বিস্মিত হই। কেমন যেন অতীতে চলে যাই। ‘স্মৃতিময় দিনগুলি’ নামে প্রায় ৩৫ বছর আগে একটা বই লিখেছিলাম। তাতে আমাদের ছেলেবেলার অনেক কথা ছিল। এই কয়েকদিন সেটা পড়তে গিয়ে ২-১টি শব্দ ওলটপালট করে বেশ অভিভূত হয়েছি। মনে হয়েছে এসব আমি লিখেছি?
লেখার স্থায়িত্ব কথার চাইতে হাজার গুণ, লক্ষ গুণ বেশি। তাই মানবজমিনের প্রাণপুরুষ মতিউর রহমান চৌধুরীর ‘জনতার চোখ’ প্রকাশের কথা শুনে যারপরনাই খুশি ও আনন্দিত হয়েছি। এখন সত্য কথা বলার লোকের যেমন অভাব, তেমনি লেখালেখিরও অভাব। পাকিস্তানের সময় পত্র-পত্রিকা ছিল পাঠকের মতামতের উপর নির্ভর। মাত্র কয়েকটি পত্রিকা ছাড়া আর সবই এখন ব্যবসায়ীদের। তাতে মানুষের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার খুব একটা প্রতিফলন ঘটে না। বিগত সরকারের আমলে সত্য লিখলে সেটা সরকারের মনঃপূত না হলে পত্র-পত্রিকার কণ্ঠ রোধ করা হতো। যারা এখনো এখানে সেখানে আছেন, রাষ্ট্র চালান, আইন-আদালত যাদের হাতে তারা এখনো অনেকেই ঠিক হননি। মাত্র ২-৪ জন এদিক ওদিক হয়েছেন। মানুষের মতামত যদি প্রাধান্য পায়- সাধারণের মান-সম্মানের প্রতি যদি প্রশাসনের শ্রদ্ধা থাকে তাহলে অনেক জটিলতা কেটে যাবে।
যুগে যুগে কিছু না কিছু পরিবর্তন আসে। শেখ হাসিনা সরকারের পতন সেও এক যুগের দাবি। রাজনৈতিক দলগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়ায় এবং স্বার্থের পেছনে ছুটায় মানুষের সাড়া পায়নি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্র- জনতার আহ্বানে এক সময় অসন্তুষ্ট সাধারণ মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যারা এই গণজাগরণে নেতৃত্ব দিয়েছে তারা তেমন একটা সুসংগঠিত ছিল না, এখনো না। কিন্তু তারা যে অসাধ্য সাধন করেছে তার মূল্য অপরিসীম। এই মহা জাগরণ থেকে জাতি যে একটা অসাধারণ সাফল্য অর্জন করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু স্বাভাবিক অবস্থাটাই ধরে রাখতে পারলে জাতির জন্য অনেক মঙ্গল হবে। অনেকদিকে অনেক কথা শুনছি, একে মারো, ওকে ধরো। এখনো আন্দোলনকারীরা সত্য কথা হজম করতে পারে না, অন্যেরা তো পারেই না। গত ১৫-১৬ বছর শেখ হাসিনার আশেপাশের লোকেরা যা করেছে বিএনপি অনেকটাই তা করতে চলেছে বা করছে। এক সময় বিএনপি ভেবেছিল সব জয় তাদের। কথাটা তেমন নয়, জয় তাদের নয়। জয় হয়েছে জনতার, জয় হয়েছে দেশের। গত দুই মাসে তারেক রহমানের কথাবার্তায় সাধারণ মানুষ যথেষ্ট খুশি। কিন্তু তার কথা দলীয় নেতাকর্মীরা অনেকেই শুনছে না। তাতে বিএনপি’রই ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে এই প্রথম জামায়াতে ইসলামী দারুণ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। অন্যান্য দলের তো কথাই নেই, নামও নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপে আমাদের কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নাম করেনি, আমন্ত্রণ জানায়নি। গত ২৫ বছর শেখ হাসিনার স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আমার দল, আমাদের নেতাকর্মীরা যে পরিশ্রম করেছে তা অনেক বড় বড় দল করেনি বা করতে পারেনি। জানি সবই সময়ের ব্যাপার। এ নিয়ে আমাদের কোনো শোক-আফসোস্ নেই। আমরা মানুষের সঙ্গে থাকতে চাই, মানুষের কথা বলতে চাই। যতক্ষণ বেঁচে থাকবো ততক্ষণ সেটা নির্বিবাদে করে যাবো। বাধা আসলে যতটা সম্ভব বাধা অতিক্রমের চেষ্টা করবো- লড়াই করবো। তবু মাথা নুইয়ে দিবো না।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশে একটা মারাত্মক অস্থিরতা চলছে। খুব সহজে যে সেটা দূর হবে তেমন নয়। তবে দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে এগুতে পারলে এই সমস্যা কাটিয়ে ওঠা কোনো কঠিন নয়। আমরা বহুবার এমন অসুবিধায় পড়েছি, সমস্যায় পড়েছি। সেখান থেকে পেরিয়েও এসেছি। একটা বিষয় না বলে পারছি না, সেদিন এক নারী বিসিএস অফিসার তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি নিজেকে বড় বেশি প্রগতিবাদী অথবা সংগ্রামী চেতনার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়। একজন সরকারি কর্মচারীর চাকরিতে ইস্তফা না দিয়ে সরকার বৈধ, না অবৈধ- এ কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। তার উপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পতনের কাউনডাউন শুরু হয়ে গেছে। সত্যিকারে এসব বলা রাষ্ট্রদ্রোহিতা। এর চাইতে বড় সংবিধানবিরোধী জঘন্য কাজ আর হতে পারে না। সরকারের বৈধতা জনগণের ইচ্ছার উপর। যদি অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে তাহলে যে সময়, যে অবস্থায় তাকে সরকার প্রধান করা হয়েছে এরকম বৈধ সরকার খুব একটা হয় না। সমগ্র জাতির ইচ্ছার প্রতীক হিসেবে অধ্যাপক ইউনূস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হয়েছেন। অধ্যাপক ইউনূসের বৈধতা না থাকলে আমার বোনের বৈধতা ছিল কী করে? পর পর ৩টি নির্বাচনে কোনো ভোটার সঠিকভাবে ভোট দিতে পারেনি। আমার তো অবাক লাগছে এখন পর্যন্ত এরকম একজন সরকারি কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়নি কেন? তার তো শুধু গ্রেপ্তার নয়, সরকারি বিধি ভঙ্গের দায়ে তার একটা শাস্তি হওয়া উচিত। আমি খুবই অবাক হয়েছি, গোলাম মওলা রনির মতো একজন মানুষ এরকম একটি একেবারে জঘন্য অপরাধীর সাথী হয়েছেন। অন্যজন আবার মারাত্মক পোড় খাওয়া আইনবিদ, যাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, সম্মানের চোখে দেখি জেড আই খান পান্নাকে। তিনি সাহসী সংগ্রামী মানুষ হিসেবে ঊর্মির পক্ষ নিতে চেয়েছেন। তা নিতেই পারেন। তিনি যদি সরকারি চাকর হিসেবে ইস্তফা দিয়ে ঐ একই কথা বলতেন তাহলে হয়তো আমারও কিছুটা সমর্থন পেতেন। বিয়ে ছাড়া একটা মেয়ের পেটে বাচ্চা এলে যেমন দুর্নামের হয়, চাকরিতে বহাল থেকে অধ্যাপক ইউনূসের পতনের কাউনডাউন শুরু হয়েছে একথা বলে ঊর্মি তেমনটাই করেছেন। এর যথাযথ বিচার না হলে, শাস্তি না হলে পরবর্তীতে আমরা আরও ব্যাপক পরিমাণে কলঙ্কিত হবো। সময় থাকতে সাবধান হওয়া উচিত।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা শরিক হয়েছিলেন, যারা জীবন দিয়েছেন- তারা অনেকেই কোনো স্বার্থের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। দেশকে স্বৈরশাসকের হাত থেকে, দুঃশাসনের হাত থেকে বাঁচাতে যখনই দেশের ডাক এসেছে তখনই তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জীবন পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দান, তিনিই জীবন দেন আবার নেন। এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। জন্মের পর মৃত্যু অবধারিত সত্য। কারও মৃত্যু হয় কাপুরুষের মতো, কারও মহান মৃত্যু চিৎকার করে বলবার মতো। তেমন একটি মৃত্যু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বীর-মহাবীর রংপুরের আবু সাঈদের। আমাদের দেখতে হবে, ভাবতে হবে- বুঝতে হবে। সে যখন গুলি খায় তখন তার অবস্থান কেমন ছিল? পুলিশের সামনে সম্পূর্ণ একা। হাতে ছিল ছোট্ট একটা লাঠি। ওটা যদি দা হতো, বল্লম হতো, তরবারি হতো সেটা হতো ভিন্ন কথা। পুলিশ কর্মকর্তাদের হাতে যে ব্যাটন থাকে সেটা ছিল তার চাইতেও ছোট। কেমন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিশ্ববিজয়ী নেপোলিয়ন বোনাপাট অথবা আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট কিংবা মহাবীর সালাউদ্দিন আইয়ুবী আরও আরও পৃথিবীর মহা মহা বীরদের মতো বা তার চাইতেও তাকে শৌর্যে বীর্যে আকাশসম উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। বাঙালি জাতি কখনো কখনো অমন করেই বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা যেমন দাঁড়িয়ে ছিলাম, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যদিয়ে এগিয়ে আসা একজন নেতা কীভাবে স্বৈরশাসক হতে পারেন যার উজ্জ্বল প্রমাণ নেত্রী হাসিনা। তার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কেমন হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলেন আবু সাঈদ। ক’হাত দূরে ছিল জঘন্য পুলিশ? ওরকম একা মানুষকে কেন গুলি করবে? তারা তাকে জাপটে ধরে নিয়ে যেতে পারতো। কেন অমনভাবে গুলি করতে হবে? পুলিশের তো অমন নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি করার কোনো আইনসিদ্ধ সুযোগ নেই। নিরস্ত্র কাউকে কোনোমতেই পুলিশ গুলি করতে পারে না। আবু সাঈদ সশস্ত্র ছিল- এটা কোনোভাবেই প্রমাণ করা যাবে না। আবু সাঈদের হাতের লাঠি ওটা ছিল বাঙালি জাতির শৌর্য বীর্য গৌরবের প্রতীক, গৌরবের চিহ্ন। যা দুর্নাম নয়, বদনাম নয়- প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আবু সাঈদকে হত্যা করা হয়েছিল গণঅভ্যুত্থানের বেশ কয়েকদিন আগে। যেমন ’৬৯-এর গণআন্দোলনে বহু মানুষ জীবন দিয়েছে, কিন্তু দেশ জ্বলে উঠেনি, ২০শে জানুয়ারি ’৬৯ আসাদ শহীদ হলে দেশ উতলা হয়ে উঠে, অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠে। ’৯০-এও কতোজন জীবন দিয়েছে, কিন্তু ডা. মিলনের জীবন দানের পর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আর গদিতে থাকা সম্ভব হয়নি। তার পতন হয়েছে। ঠিক তেমনি শেখ হাসিনার শ্বশুরবাড়ির দেশে আবু সাঈদের রক্তদান সারা দেশকে জাগিয়ে তুলে। কিন্তু সেই সময়ও স্বৈরশাসক আবু সাঈদের সেই নির্মম নিষ্ঠুর হত্যা ভিন্ন খাতে চালাবার চেষ্টা করেছে। অপরাধীদের ধরতে চায়নি। যারা এই হত্যার সঙ্গে জড়িত তারা যে অপরাধী সরকার তাও স্বীকার করতে চায়নি। বরং নিহত আবু সাঈদকেই অপরাধী করার চেষ্টা হয়েছে। এমনই হয় পতনের আগে নিষ্ঠুর অত্যাচারী শাসকরা, সত্যকে মিথ্যা, মিথ্যাকে সত্য আখ্যায়িত করার চেষ্টা করে। রংপুরের আবু সাঈদের হত্যা তা থেকে ভিন্ন নয়। এত বড় একটি সফল বিপ্লবের পর যদি আবু সাঈদের হত্যাকারীদের যথাযথ বিচার না হয় তাহলে ভবিষ্যতের জন্য সেটা একটা কু-নজির হয়ে থাকবে। আবু সাঈদকে যে গুলি করেছে শুধু সেই অপরাধী নয়, যে বা যারা ইন্ধন জুগিয়েছে, আদেশ দিয়েছে- তাদেরও এই হত্যায় শাস্তি পাওয়া উচিত। পুলিশি আইনে কোথাও হাঁটুর উপর গুলি চালাবার বিধান নেই। আর ওরকম সামনাসামনি অতটা কাছ থেকে একজন নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালানো সভ্য সমাজে সব থেকে বড় অপরাধ।
যে যাই বলুন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানকে আমি বিশ্বাস করি, ভালোবাসি। একজন পোড় খাওয়া ধৈর্যশীল মানুষ হিসেবে মনে করি। আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং গ্রহণযোগ্যতায় বাংলাদেশে এখন তার ধারেকাছে আর কেউ নেই। তাকে নিয়ে যে যাই বলুন, তাদের তেমন কোনো ক্ষমতা নেই। অধ্যাপক ইউনূসকেই যতটা সম্ভব ধৈর্য নিয়ে সুন্দরভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রশাসন পরিচালনার সুযোগ দেয়া উচিত। কারও গায়ের জোরে কোনো কিছু হওয়া উচিত নয়। বর্তমান উপদেষ্টারা প্রায় সবাই অভিজ্ঞতাহীন। তারপরও তাদের যদি সততা থাকে, সদিচ্ছা থাকে আর ব্যক্তি স্বার্থের প্রতি যদি তারা অন্ধ না হোন তাহলে অবশ্যই ভালো করবেন। ইতিমধ্যেই উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সত্যিই ভালো করছেন। আবার কেউ কেউ তেমন কিছু করতে পারছেন না। একজন উপদেষ্টাকে নিয়ে না বলে পারছি না। তিনিও একজন পোড় খাওয়া মানুষ। নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। অনেক লেখালেখি করেছেন, এখনো করেন। একটি গবেষণা করতে গিয়ে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীর কাছে গিয়েছিলেন। সেখানে আমি তাকে সামান্য সাহায্য করেছিলাম। ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জীও একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। সেই তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন আওয়ামী লীগের অতীত এবং ঐতিহ্য নিয়ে বলেছিলেন। যে কারণে মুহূর্তে তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাট ও নৌ-মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সত্য বলা অপরাধ নয়। শেখ হাসিনাকে অস্বীকার করা যায়, তাকে শাস্তিও দেয়া যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ সংগ্রাম করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে- এটা অস্বীকার করা যায় না। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন হয়েছি এটাকে অস্বীকার করলে আমাদের অস্তিত্ব টিকে না। অতীত সে যত নির্মমই হোক তাকে স্বীকার করার সৎ সাহস থাকতে হয়। জানি সেটাও হয়ে যাবে শুধু কিছুটা সময়ের দরকার।