সা ফ ক থা

রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে পুরনো ঘূর্ণাবর্ত আর নয়

মোজাম্মেল হোসেন | বিশেষ রচনা
অক্টোবর ২৬, ২০২৪
রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে পুরনো ঘূর্ণাবর্ত আর নয়

গত রোববার ২০শে অক্টোবর হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়ের মতো ‘রাষ্ট্রপতি ইস্যু’ এসে দেশের রাজনৈতিক বাতাস গরম করে দিলো। বলা যায়, নানা ঘটনার ঘনঘটার সময়ে এই লেখা যখন লিখছি তখন রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিন বহাল আছেন; লেখা যখন পাঠকরা পড়বেন তখন থাকবেন কি-না জানা নেই। 
 

তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের তিন দিন পরে প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্বে যে উপদেষ্টারা একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন তাদের শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি। তারা রাষ্ট্রপতিরই উপদেষ্টা, যিনি বিগত সরকারের সময় সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত। এই রাষ্ট্রপতি শেখ হাসিনার একান্ত বশংবদ বলে পরিচিত। নতুন ক্ষমতাসীনরা তাকে ‘হাসিনার ফ্যাসিবাদের একজন প্রতিভূ’ বলছেন, আবার তার কাছেই শপথ নিয়েছেন। এই বৈপরীত্যের উৎস কী, যার ফাঁকে পড়ে অন্তর্বর্তী সরকার এখন অস্বস্তি বোধ করছেন? 
 

জুলাই-আগস্টের রক্তাক্ত তুমুল পরিবর্তনকে আন্দোলনের ছাত্রনেতারা ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নোবেল বিজয়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তি প্রফেসর ড. ইউনূসসহ বিভিন্ন মহল ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’, ‘বিপ্লব’ ইত্যাদি অভিহিত করলেও রাজনৈতিক শাস্ত্রের বিচারে অনেকেই এটাকে বিপ্লব বলে মানতে নারাজ। যেমন, এই সরকারের কাছে উচ্চ মূল্যায়িত আমেরিকা প্রবাসী রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও দেশে সংবিধান বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান আলী রীয়াজ মিডিয়াকে বলেছেন, তিনি এই ঘটনাধারাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা ও বিপ্লব না বলে গণঅভ্যুত্থান বলতে চান। কারণ বিপ্লবের পরে নেতৃত্বদানকারীরা সরকার গঠন করে, এখানে তা হয়নি (সাক্ষাৎকার, দি ডেইলি স্টার, ১৪ই সেপ্টেম্বর ২০২৪)।
 

জুলাইতে ছাত্র নেতৃত্ব হঠাৎ করেই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্র হত্যার কারণে শেখ হাসিনার পদত্যাগের ‘একদফা’ দাবি উত্থাপন করে। আবার প্রফেসর ড. ইউনূস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গিয়ে গত ২৫শে সেপ্টেম্বর ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ নামক সংস্থার সদর দপ্তরে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সামনে বলেন যে, আন্দোলনটি হঠাৎ করে হয়নি, এটি  ছিল অত্যন্ত সুচারুভাবে পূর্ব পরিকল্পিত। 
 

পূর্ব পরিকল্পিত আন্দোলনের ফলে হাসিনা সরকারের পতনের পরে দেশ সাংবিধানিক পথে না-কি সংবিধান অগ্রাহ্য করে বিপ্লবী পথে চলবে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। প্রকৃতপক্ষে দু’ভাবেই হয়েছে। বলা যায়- আধা সাংবিধানিক, আধা বিপ্লবী। আর ঠিক এই কারণেই সরকার পতনের আড়াই মাস পরে অনাহূতভাবে ‘রাষ্ট্রপতি ইস্যু’ এসে উপস্থিত হলো। ইস্যুটি এলো একজন প্রখ্যাত সাংবাদিকের একটি প্রকাশিত রিপোর্টে রাষ্ট্রপতিকে উদ্ধৃত করা উক্তির সূত্র ধরে। ‘মানবজমিন’-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী কিছুদিন বিরতি দিয়ে দৈনিকটির জনপ্রিয় সাপ্তাহিক রাজনৈতিক ম্যাগাজিন ‘জনতার চোখ’-এর পুনরাবির্ভাব সংখ্যায় ২০শে অক্টোবর প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে লিখেন, রাষ্ট্রপতি তাঁকে বলেছেন, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কিন্তু তাঁর কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। নিজের অফিস ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ অফিসের কোথাও পদত্যাগপত্রের কপি পাওয়া যায়নি।   
 

এই রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বোমা ফাটে, সরকারের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বক্তব্যে যে, ৫ই আগস্ট রাষ্ট্রপতি তিন বাহিনী প্রধানের টিভি পর্দায় উপস্থিতিতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন। এখন বলছেন তিনি পদত্যাগপত্র পাননি, এটা মিথ্যাচার এবং রাষ্ট্রপতির শপথ ভঙ্গের শামিল। রাষ্ট্রপতির পদে থাকার যোগ্যতা আছে কি-না তা উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হবে বলে তিনি জানান। 
 

অবশ্য ২১শে অক্টোবরই বঙ্গভবন থেকে দেয়া বিজ্ঞপ্তিতে রাষ্ট্রপতি উক্ত পদত্যাগকেন্দ্রিক মীমাংসিত বিষয় নিয়ে নতুন করে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি ও অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত না করার আবেদন জানান। 
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারাও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং শহীদ মিনারে সমাবেশ করে সময় বেঁধে আল্টিমেটাম দিয়েও রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করেন, এমনকি বঙ্গভবনের সামনে কিছু লোক বিক্ষোভ করেন, ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন- যা সেনাসদস্যদের সহায়তায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে শক্তি প্রয়োগে মোকাবিলা করতে হয়। পরের দিন উপদেষ্টা পরিষদও বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে রাষ্ট্রপতি ইস্যু সমাধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে সবচেয়ে বড় দল বিএনপি মত দেয় যে, রাষ্ট্রপতি এখন পদত্যাগ বা তাঁকে অপসারিত করা হলে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। জটিলতা বাড়বে। 
 

প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের পর সাংবিধানিক পথে চলার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও বাস্তবক্ষেত্রে সংবিধান পুরোপুরি মানাও সম্ভব হয়নি, সংবিধান উড়িয়ে দিয়ে বিপ্লব করাও সম্ভব হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে সংসদীয় গণতন্ত্রে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের যে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া চলার কথা তা না হয়ে সংসদ বাতিল করে দেয়া হয়। সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার বা উপদেষ্টা বলে কোনো পদ নেই, উপদেষ্টাদের শপথবাক্য বলেও কিছু নেই, তবু সেগুলো হলো। আইনের একমাত্র সুতা হলো রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে করণীয় জানতে চেয়ে সুপ্রিম কোর্ট বরাবর রেফারেন্স পাঠালে সর্বোচ্চ আদালত এই কাজগুলো করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দিয়েছেন। 
 

এখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে স্পিকারের কাছে করতে হবে। স্পিকার আগেই পদত্যাগ করেছেন। ডেপুটি স্পিকার কারাগারে। সংবিধান অনুসারে পরবর্তী স্পিকার দায়িত্ব না নেয়া পর্যন্ত বর্তমান স্পিকার অবশ্য বহাল থাকেন। কিন্তু তাঁকে রাজি করাতে হবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার দায়িত্বটি পালন করতে। এটা জটিল। আবার রাষ্ট্রপতি যদি পদত্যাগ করতে রাজি না হন? আরও জটিল। তাঁকে অপসারিত করতে হবে। তাঁকে অপসারণের কোনো সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নেই। সেটা পারে সংসদ ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে। সংসদ তো নেই। 
 

বৈষম্যবিরোধী যুবক নেতারা এখন চরমপন্থি সব পদক্ষেপ নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। তাঁদের দাবিতে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার আলোচনা চলছে। তথ্য-সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ একেবারেই সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। জনগণের অভিপ্রায়ে বিপ্লব হলে বিপ্লবী সরকার সবকিছুই করতে পারে যতক্ষণ জনগণের সমর্থন থাকে। বৈষম্যবিরোধী নেতারা এখন সেই পথ পুরোপুরি ধরতে চান? তাঁরা সর্বশেষ ২২শে অক্টোবর যে ৫-দফা দিয়েছেন তার একটিতে সম্পূর্ণ নতুন দাবি সংবিধান বাতিল করে প্রক্লেমেশন অফ রিপাবলিক গ্রহণ। 
 

এই না-সাংবিধানিক, না-বিপ্লবী অবস্থায় দেশের বিজ্ঞ ও সাংবিধানিক আইন বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন তাও আমাদের ইতিহাসে নতুন নয়। সেটা হচ্ছে এখন যা প্রয়োজন তা করে ফেলো। পরে জনগণের নির্বাচিত সংসদে সেগুলো পাস করাতে হবে। এমন কথা আইনের শিক্ষক শাহদীন মালিক বলে আসছেন। সর্বশেষ বলা হয়েছে ২৩শে অক্টোবর ‘প্রথম আলো’য় খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এমএ মতিনের অভিমতে।
 

অসাংবিধানিকভাবে গৃহীত পদক্ষেপগুলো সংসদে পাস না করালে বৈধতার সংকট দেশকে নৈরাজ্য ও রাষ্ট্রকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবে আমাদের দেশে আগে এমন পাস করানো বা রেটিফিকেশনের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা সামরিক অভ্যুত্থানের পরে, সামরিক একনায়কদের উর্দি ছেড়ে রাজনৈতিক শাসক হয়ে বসার পরে। সামরিক শাসন জনপ্রিয় কিছু নয়। প্রতিটি সামরিক শাসকেরই গণআন্দোলনে পতন হয়েছে। এবং তাদের কীর্তিকলাপ পাস করানোর জন্য অবশ্যই নিজের রাজনৈতিক দল লাগে যাকে পরবর্তী নির্বাচনে উপযুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংসদে জিতিয়ে আনতে হয়।
 

আমরা স্মরণ করতে পারি পাকিস্তানে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক ক্যু করেন এবং পুরনো মুসলিম লীগের একটি কনভেনশন ডেকে সেটিকে তাঁর দল বানান। ১৯৬২ সালে সামরিক আইন তুলে নিলেও এই দলকে ছলে-বলে-কৌশলে জিতিয়ে শাসকদল বানাতে হয়েছে। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতন ঘটে। 
 

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে নিহত হলে অল্প কয়েকদিনের জন্য আওয়ামী লীগেরই মন্ত্রী বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশ্‌তাক ক্ষমতায় আসেন, সামরিক আইন জারি করেন এবং বিভিন্ন ঘটনার মধ্যদিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। ক্যান্টনমেন্টে বসেই তিনি জন্ম দেন প্রথমে জাগো দল ও পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। সেটাকে তাঁর জিতিয়ে আনতে হয়।  
রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হওয়ার কিছুদিন পরে ১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান এরশাদ সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতায় আসেন। জিয়ার কৌশল কার্বনকপি করে তিনি গঠন করেন জাতীয় পার্টি। ন্যক্কারজনক ভোট ডাকাতির মাধ্যমে তাঁকে ঐ দল জেতাতে হয়। ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনে তাঁর পতন ঘটে। 
 

সামরিক শাসন নয় বরং জনপ্রিয় ‘আগস্ট বিপ্লব’ যাঁরা নেতৃত্ব দিয়ে সম্পন্ন করলেন তাঁরা কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করেননি। তবে আওয়াজ আছে। সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে। সমন্বয়ক নামের ছাত্রনেতারা কেউ কেউ উপযুক্ত সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী দল গঠন করার আভাসও দিয়েছেন। 
 

এখন যদি ‘ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভিপ্রায়’ বা ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত’ হিসেবে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বাইরে অনেক নীতি-পদক্ষেপ নেয়া হয় অথবা ১৯৭২-এর সংবিধান বাতিল করে, ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নতুন মূল্যায়নের নামে গৃহীত কিছু পদক্ষেপের মতো আরও পদক্ষেপ গ্রহণ ও নতুন সংবিধান লেখা হয় তবে সে সবকিছু পরবর্তী সংসদে পাস করাতে কি নতুন একটি দল গঠন করে সেটিকে উপযুক্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতিয়ে আনতে হবে? সেই দলটি কী অতীতের মতো ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে গড়ে তোলা হবে? আমাদের দেশ কি আইয়ুব-জিয়া-এরশাদের মতো ভিন্ন কায়দায় একই চক্রাবর্তে ঘুরতে থাকবে? না জনগণের আকাঙ্ক্ষা মতো সত্যিকার গণতান্ত্রিক ও কল্যাণ রাষ্ট্র আমরা করতে পারবো? সেটা করতে হলে ক্ষমতায় বসে কোনো রাজনৈতিক দল গঠন নয়, মুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে মুক্ত গণতন্ত্রের পথেই আমাদের হাঁটতে হবে। তখন জনগণই ঠিক করবে আমরা কীরকম দেশ চাই।

 

বিশেষ রচনা'র অন্যান্য খবর