সা ম্প্র তি ক

বিনা ভোট, রাতের ভোট, ডামি এবং সার্চ কমিটি

লুৎফর রহমান | বিশেষ রচনা
নভেম্বর ২, ২০২৪
বিনা ভোট, রাতের ভোট, ডামি এবং সার্চ কমিটি

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বড় চাওয়া একটি জাতীয় নির্বাচন। যে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরবে দেশ। তার আগে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরিতে যেসব প্রয়োজনীয় সংস্কারের দরকার তার দাবি আন্দোলন জয়ী ছাত্র-জনতা শুরুতেই জোরালো করেছিলেন। এ দাবির প্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে ১০টি সংস্কার কমিশন করা হয়েছে। অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সময় যত গড়াচ্ছে সংস্কারের সঙ্গে নির্বাচনের দাবি এখন জোরালো হয়ে উঠছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের বিষয়টিকে মুখ্য হিসেবে দেখছে। তারা মনে করছে টেকসই সংস্কারের জন্য নির্বাচিত সরকার দরকার। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের রূপরেখা, সুপারিশ রেখে যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের সূচনা করে যেতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন এবং এর সব কাজ কিন্তু সরকারকে শেষ করে যেতে হবে। এজন্য নির্বাচন আয়োজনই তাদের সামনে এখন প্রধান কাজ। যদিও নির্বাচন নিয়ে সরকার এখনো কোনো পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা প্রকাশ করেনি। 

 

বলা হচ্ছে, নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচন ব্যবস্থাকে ভেঙেচুরে শেষ করে যাওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া আইনেই সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হবে। যে কমিশন বহুল প্রত্যাশিত আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবে। যার মাধ্যমে দেশ দেড় দশক পর পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে পারে- এমনটা আশা করছে মানুষ। এখন প্রশ্ন হলো আগামী নির্বাচনটি কেমন হবে? কোন প্রক্রিয়ায় হবে। এই প্রশ্নের উত্তর এবং তার আলামত অবশ্য বোঝা যাবে নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর। 

 

অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ের রাজনীতি এখনো স্থিতিশীল হয়নি। চরম ফ্যাসিবাদী শাসনের জন্ম দেয়া আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে রাখার দাবি এখন জোরালো। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এমন অবস্থায় আগামী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখনো বলা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হলে, তাদের সহযোগী দলগুলোকে নির্বাচনের বাইরে রাখলে সেই নির্বাচন কেমন হবে  সে বিষয়েও আগাম কিছু বলা যাচ্ছে না।

 

নির্বাচন কমিশন গঠনে যে সার্চ কমিটি হয়েছে তার প্রক্রিয়া নিয়েও ভেতরে নানা আলোচনা ছিল। বিদ্যমান আইনে করা হবে নাকি সরকারের নির্বাহী আদেশে হবে- এ নিয়ে আলোচনা ছিল। পরামর্শ এসেছিল আগের সরকারের রেখে যাওয়া পদ্ধতি অনুসরণ না করে গ্রহণযোগ্য ছয় জনকে দিয়ে কমিটি গঠন করা। এতে বিশিষ্টজন, পেশাজীবী, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব রাখার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু এই প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। 

অবশ্য বিদ্যমান আইনে করা সার্চ কমিটিতে দু’জন বিশিষ্ট নাগরিককে রাখা হয়েছে। তারা দু’জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক। এই কমিটির মাধ্যমে যে কমিশন হবে তার সামনে দেশের মানুষের ১৬ বছরের  ভোট দিতে না পারার আক্ষেপ ঘোচানোর দায়িত্ব পড়বে। সূত্রের দাবি কমিশন গঠন হলে এ সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে তাদের কার্যপরিধি ঠিক করবে। এ ছাড়া সব দলকে নির্বাচনে আনাসহ আরও কিছু বিষয় নির্ভর করবে সরকারের সিদ্ধান্তের উপর।


সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার এ বিষয়ে বলেছেন, আমাদের প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশন গঠিত হোক সৎ, সাহসী ও যোগ্য মানুষ দ্বারা। যারা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করতে তাদের দায়িত্বটা সুচারুভাবে পালন করবেন। যার মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটা কার্যকর হয়। একই সঙ্গে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের দেয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তারা যথাযথ ভূমিকা রাখবে। 
আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত সার্চ কমিটি এমন কমিশনই খুঁজে বের করবে- তা প্রত্যাশা করছে দেশের মানুষ। 


আগের নির্বাচন কমিশনগুলোও কিন্তু সার্চ কমিটির মাধ্যমেই হয়েছিল। তবে ইসি গঠনে ক্ষমতাসীন দলের পছন্দই ছিল শেষ কথা। তারা যাদের অনুমোদন দিয়েছে প্রেসিডেন্ট তাদের দিয়ে কমিশন গঠন করে দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের পছন্দের নির্বাচন কমিশনের কারণে অতীতে যা হওয়ার তার চেয়ে বেশি হয়েছে। সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের শপথ নিয়ে নির্বাচন কমিশন দলের চেয়ে বেশি দলীয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে। দল নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের প্রথম নমুনা ছিল ২০১৪ সালের নির্বাচনটি। এটি ছিল অনেকটা বিনা ভোটের নির্বাচন। কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশনের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বিরোধী দলবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে উঠেছিল, তা এই কমিশন ধ্বংস করে দেয়। একদলীয় ও বিনা ভোটে বেশির ভাগ এমপি নির্বাচিত হওয়া এই নির্বাচন চাইলে রকিব কমিশন আটকে দিতে পারতো। কমিশন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা চালাতে পারতো। তখন তারা তা করেনি। কারণ বিরোধী দলের তখনকার দাবি ছিল নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। আওয়ামী লীগ বিরোধীদের এই দাবির প্রতি পাত্তা না দিয়ে নিজেদের অধীনে একতরফা নির্বাচন আয়োজনে যে উদ্যোগ নিয়েছে নির্বাচন কমিশন তাতে সহযোগিতা ছাড়া নিজের সাংবিধানিক ক্ষমতার কোনো প্রমাণ দেয়ার চেষ্টাই করেনি। করলে হয়তো দেশের পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ভিন্ন হতে পারতো। আওয়ামী লীগ যে চরম ফ্যাসিবাদী চরিত্র প্রকাশ করতে পেরেছে তাও হয়তো সম্ভব হতো না ’১৪ সালের বিনা ভোটের ওই নির্বাচন বৈধতা না পেলে। ওই নির্বাচনে পাঁচ কোটির বেশি ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাননি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৩৪টি আসন পায়। যার ফলে পরবর্তী সংসদে তারা ইচ্ছামতো সবকিছু করতে পেরেছে। সংবিধান সংশোধনসহ নানা আইন প্রণয়ন করেছে যা মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ছিল না। 


২০১৪ সালের মতো ২০১৮ সালেও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় ছিল। নির্বাচনের আগে বিএনপি’র সঙ্গে আরও কিছু দল যুক্ত হয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে রাজনৈতিক জোট গঠন করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টসহ অন্যান্য দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এমন প্রেক্ষাপটে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাই ২৫৮টি আসন পায়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টভুক্ত বিএনপি পায় মাত্র ৬টি আসন। ওই নির্বাচনটি রাতের ভোটের নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি পায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে রাতেই নির্ধারিত ভোট বাক্সে ভরা হয়েছিল ওই নির্বাচনে। ফলে দিনে ভোটারদের দেয়া ভোট আর নির্বাচনী ফলাফলে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। রাতের ভোট কোথাও কোথাও এমন অস্বাভাবিক পরিসংখ্যান তৈরি করেছিল যা বিজয়ী হওয়া এমপিদেরও অবাক করেছিল। দক্ষিণাঞ্চলের এমন একজন এমপি ভোটের পর এক আড্ডায় প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, তার নিজস্ব যে ভোট পাওয়ার কথা তার চেয়ে এক লাখের বেশি ভোট তিনি পেয়েছিলেন। অতিরিক্ত এই ভোট কারা দিয়েছে এই প্রশ্নটি তিনি তখনকার পুলিশ সুপারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু ওই কর্মকর্তা মুচকি হাসি দেয়া ছাড়া আর কোনো উত্তর দিতে পারেননি। 


২০২২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি সিইসি হিসেবে নিয়োগ পান সাবেক আমলা কাজী হাবিবুল আউয়াল। নিয়োগ পাওয়ার পরই তিনি বলেছিলেন, তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বিএনপি’র মতো বড় রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য দলকে নির্বাচনে আনা। যদিও শেষ পর্যন্ত বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আনতে ব্যর্থ হন তিনি। এক পর্যায়ে আরওপিও সংশোধন করে নিজেদের ক্ষমতা খর্ব করে আউয়াল কমিশন। নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহ করার আইন কঠিন করা হয়। যোগ্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধন না দিয়ে ভুঁইফোঁড় কয়েকটি দলকে নিবন্ধন দেয় ইসি। ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি বিরোধী দলগুলো ছাড়াই একতরফাভাবে নির্বাচন আয়োজন করে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখাতে বিভিন্ন আসনে বিরোধী প্রার্থী হিসেবে ডামি প্রার্থী দেয় আওয়ামী লীগ। এজন্য ডামি ও একতরফা নির্বাচন হিসেবে খেতাব পায় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন।  


এবার আসি আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে। আগের মতোই সার্চ কমিটি করে নির্বাচন কমিশন গঠন হচ্ছে। তবে এবার নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের হাতে। সরকার এবং সম্ভাব্য নির্বাচন কমিশনের সামনেও আগের মতোই চ্যালেঞ্জ এসে দাঁড়িয়েছে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন ও নির্বাচনটিকে অংশগ্রহণমূলক করা। দেশের মানুষ আশা করছে সরকার, নির্বাচন কমিশন এমন একটি নির্বাচন করবে যাতে ওই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দল বা জোট আগের মতো ফ্যাসিবাদী শাসন ফিরিয়ে আনতে না পারে। নিজেরা ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠতে না পারে। 

বিশেষ রচনা'র অন্যান্য খবর