ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ-সংগ্রামের অবিস্মরণীয় বিস্ফোরণের সামনে পড়ে পরাক্রমশালী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নেন। ফ্যাসিবাদী সরকার উচ্ছেদের মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থায় একটি রাজনৈতিক মৌলিক রূপান্তরের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।
জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সশস্ত্র মুক্তি-সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র আত্মপ্রকাশ করে। সশস্ত্র মুক্তি-সংগ্রামে বীর শহীদদের প্রাণোৎসর্গ করতে যে সকল আদর্শ উদ্বুদ্ধ করে, তার বিবেচনায় ’৭২ সালে প্রথম সংবিধান রচিত হয়। ২০২৪-এ ছাত্র-জনতার দুনিয়া কাঁপানো অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে প্রচলিত সংবিধান- পরিবর্তন, সংযোজন, বিয়োজন, পুনঃলেখন বা পুনর্গঠনের দাবি উঠেছে। গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এই রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশে সংগঠিত গণঅভ্যুত্থান ইতিহাসে বিস্ময়কর কীর্তি হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় রাষ্ট্র এবং সমাজনীতি বা প্রক্রিয়া খুব দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে যায় না। তা বড় বেশি চ্যালেঞ্জিং। আমরা অভ্যুত্থানের রণকৌশলে তাৎক্ষণিক জয়লাভ করেছি কিন্তু সংবিধান ও রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কার- দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। গণতান্ত্রিক বিপ্লব যেমন এক লাফে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হয়ে যায় না, তেমনি গণঅভ্যুত্থানেও রাতারাতি রাষ্ট্রের পরিবর্তন সাধিত হয় না। সে স্বপ্ন দেখাও যথার্থ নয়। এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই সংবিধানের বিকাশ সাধনের প্রয়োজনে এবং স্বাধীনতার স্বপ্নের সার্থক রূপায়ণে, সংবিধান সংস্কার কমিটির প্রধান আলী রীয়াজ সাতটি প্রস্তাবনা বা উদ্দেশ্য উপস্থাপন করেছেন। যা খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত।
প্রস্তাবনা-০১: দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতিশ্রুত উদ্দেশ্য- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার এবং ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আলোকে বৈষম্যহীন জনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
পর্যালোচনা: স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার- এই ত্রয়ী আদর্শকে প্রজাতন্ত্রের দার্শনিক ভিত্তি ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু তা ধারণ, লালন না করায় জাতীয় চেতনা এক ভয়াবহ ভিন্নপথে প্রভাবিত হয়েছে এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করেছে। অথচ এই ভাবাদর্শকে নিয়েই রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি প্রণয়ন করতে পারলে, মানুষের আকাঙ্ক্ষা সমূহ সার্থক বিকাশ ও চরিতার্থ লাভ করতে পারবে।
প্রস্তাবনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে:-
১) ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক সুবিচার’-এই ত্রয়ী দার্শনিকভিত্তিকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ঘোষণা।
২) জাতির দীর্ঘ লড়াইয়ের মহান অর্জনগুলো বিশেষ করে- ভাষা আন্দোলন, রক্তঝরা মার্চ-এর ঐতিহাসিক ঘটনাসহ ’৭১-এর গণহত্যা ও ’২৪ গণহত্যা।
৩) প্রজাতন্ত্র বিনির্মাণের আইনগত ও প্রজাতন্ত্রের দার্শনিক নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ১০ই এপ্রিলকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ ঘোষণা।
৪) রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি হবে গণতন্ত্র অর্থাৎ ‘সাম্য’, ‘মানবিক মর্যাদা’ এবং ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’। অর্থাৎ Democracy is a Government of the People by the People and for the People.
৫) মানবাধিকার অর্থাৎ রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিক বা ব্যক্তির জীবন ষরভব-এর সুরক্ষা দিতে হবে। জুলাই ’২৪-এর গণহত্যার মধ্যদিয়ে রাষ্ট্রের জনগণের ‘জীবন সুরক্ষার’ প্রশ্নটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার নির্দেশনা বা রাষ্ট্রের বিশেষ দায়বদ্ধতার কথা উল্লেখ করতে হবে।
৫) সকল ধর্ম-বর্ণের পারস্পরিক সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ব এবং সামাজিক সমপ্রীতি রক্ষা করা হবে মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
৬) প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: মানুষের উপর প্রভুত্ব বিস্তারে স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্র কখনো ফিরে আসবে না- এই ঘোষণা ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণ।
৭) দৃঢ়প্রতিজ্ঞ: শুধুমাত্র জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে, কোনো বাইরের শক্তি দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনায় আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
৮) মানবিক মর্যাদা: রাষ্ট্রের সকল আইনের উৎস হবে মানবিক মর্যাদা সুরক্ষা। রাষ্ট্র সকল মানুষের পূর্ণ মর্যাদা নিশ্চিত করবে।
৯) জাতীয় ঐক্য: স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলার মৌলিক নিশ্চয়তা হবে জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয়তাবাদ হবে সকল অপশক্তি মোকাবিলা করার প্রেরণা।
প্রস্তাবনা-০২: ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে প্রকাশিত অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো।
পর্যালোচনা: এই প্রস্তাবনায় রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক প্রশ্ন হাজির করা হয়েছে। এটি বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিকল্প রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দেবে। যেখানে সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ বা দলীয়স্বার্থ নয়, বৃহত্তর সামাজিকস্বার্থ রক্ষার ভিত্তিভূমি রচনা করবে। ব্যক্তি, দল এবং প্রভুত্বকেন্দ্রিক রাজনীতি দিয়ে রাষ্ট্রকে আইনগত ও নৈতিকভাবে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলকেন্দ্রিক বা রাজনৈতিক দলনির্ভর প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা বাংলাদেশে কোনোক্রমেই সকল জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পারে না। ফলে রাষ্ট্র গণ-আকাঙ্ক্ষা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না। রাজনৈতিক দলে শুধুমাত্র দুই/তিন শতাংশ জনগোষ্ঠী সম্পৃক্ত। রাজনৈতিক দলের বাইরে উৎপাদন উন্নয়ন, প্রযুক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে জড়িত জনগোষ্ঠীর অভিপ্রায়- রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে প্রকাশ পায় না। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র পরিচালনায় বা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বাইরে রেখে কোনো কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন বা স্থিতিশীলতা অর্জন কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
রাষ্ট্র ক্রমাগত বিপজ্জনক বৈষম্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যেমন ঔপনিবেশিকব্যবস্থা এবং সংস্কৃতির প্রভাব বিদ্যমান তেমনি আধুনিক গণমানুষের আকাঙ্ক্ষাভিত্তিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনাও অনুপস্থিত। প্রস্তাবিত নতুন এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত সমাজের তীব্র শোষণ-বঞ্চনা ও নিপীড়নে জর্জরিত জনগোষ্ঠীর মুক্তির পথকে প্রশস্ত করবে। পুঁজি, শ্রম ও মেধার সমন্বয়ে নতুন এক রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটবে। এই অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার দার্শনিকভিত্তি গভীর অর্থবহ। সকলের অংশগ্রহণে বা সকলের সমন্বয়ে যে-ন্যায়বোধ ও মূল্যবোধ গড়ে ওঠবে, তা হবে সমাজ বিকাশের উপযোগী। সবার জন্য একই ধরনের আইন, প্রশাসন ও সমতা প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে জাতীয় ঐক্য ও সৌহার্দ্যের বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠবে। সুতরাং সংসদ, স্থানীয় সরকার এবং উৎপাদনের নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় পেশাজীবী সমাজশক্তির- সাংবিধানিকভাবে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করলেই শাসন ব্যবস্থার রূপান্তর ঘটবে। মানুষ রক্ত দেবে আর পরিশেষে শুধুমাত্র শাসনব্যবস্থার হস্তান্তর হবে, এটা কোনোভাবেই গ্রহণীয় নয়। অগণিত মানুষের আত্মত্যাগের পরও রাষ্ট্রের রূপান্তর না হলে রাষ্ট্র গভীর সংকটে নিপতিত হতে হতে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এই মৌলিক প্রশ্নটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় মৌলিক পরিবর্তন আনতে না পারলে সংবিধানের ভালো ভালো বয়ান কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে; নাগরিকদের প্রাত্যহিক জীবনে তা কোনো প্রভাব ফেলবে না।
প্রস্তাবনা-০৩: রাজনীতি এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বস্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা।
পর্যালোচনা: সামগ্রিক রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণ যত বেশি স্বতঃস্ফূর্ত ও অংশগ্রহণমূলক হবে, ততবেশি তাদের মেধা ও দক্ষতাকে সৃষ্টিশীল রূপ দিতে সক্ষম হবে এবং সমাজ-জীবনকে আরও সুসংবদ্ধ করে তুলবে। এতে রাষ্ট্র যে সমষ্টিগত ইচ্ছের ফলশ্রুতি, তার প্রমাণ মিলবে। বাংলাদেশের শ্রমজীবী-কর্মজীবী এবং পেশাজীবী জনগোষ্ঠীকে বিভাজিত করে রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে বিচ্ছিন্ন রাখলে, রাষ্ট্র বা সমাজের ঐতিহাসিক প্রয়োজন অস্বীকার করা হবে। সর্বস্তরের জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ একটি মতাদর্শ। সমাজ-চিন্তার ইতিহাসে এইভাবে সমাজের চাহিদা ও ঐতিহাসিক সম্ভাবনার উদ্ভব ঘটে। নতুন পদ্ধতি প্রয়োগের বাস্তব ভিত্তি তৈরি হয়। আমরা বাংলাদেশকে বিনির্মাণের ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছি। জুলাই গণহত্যার মধ্যদিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানে সমাজের সকল অংশের ছাত্র-জনতা ও নারীর অংশগ্রহণে ঐতিহাসিক যে-গণচরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়েছিল, তার ভিত্তিতেই সকল জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিকব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। প্রভুত্ব ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সকল মত-পথ এবং শ্রেণি- নির্বিশেষে যে ইতিহাসবোধের জন্ম দিয়েছে তা থেকে আমাদের শিক্ষা নিয়েই নতুন অংশীদারিত্বের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রণয়ন করতে হবে। এটাই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের বিকল্প দর্শন। সকল মানুষের রাষ্ট্র নির্মাণের ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকতত্ত্ব বিবেচনায় নিয়েই সংবিধান সংস্কারের কর্তব্য আমাদের সম্পাদন করতে হবে। সমাজের মৌলিক রূপান্তর ঘটানো সময়ের মৌলিক দায়িত্ব। এসব প্রশ্নে আমাদের চিন্তার অস্পষ্টতা এবং অস্বচ্ছতা দ্রুত দূর করতে হবে।
প্রস্তাবনা-০৪: ভবিষ্যতে যেকোনো ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার উত্থান রোধ।
পর্যালোচনা: স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর পরিবর্তন ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ করতে হবে। রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের গণতান্ত্রিক মনস্কতা এবং গণতন্ত্রের প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে।
ফ্যাসিবাদ সৃষ্টির অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনতে হবে। শাসকদের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষমতা ও লুণ্ঠনের অপরাজনীতি বন্ধে, সমাজ পরিবর্তনের বাস্তবভিত্তিক অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
’৭২ সালের সংবিধানে অনেক গণমুখী ও গণতান্ত্রিক নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্র ক্রমাগত দুর্বৃত্ত বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পুরনো রাজনৈতিকব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে নতুন রাজনৈতিকশক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে। সামগ্রিকভাবে ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করতে হলে আরও বড় ধরনের সামাজিক বিপ্লবের মধ্যদিয়ে কাঙ্ক্ষিত প্রজাতন্ত্র নির্মাণ করতে হবে।
ফ্যাসিবাদবিরোধী রাষ্ট্রক্ষমতার দর্শন বা ডিস্কোর্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, নৈতিক ও মানবিক সমাজ নির্মাণের মতাদর্শ বা সংস্কৃতির লড়াইকে সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই এবং সমাজে তা বেশ জোরালোও নয়।
তথাকথিত গণতন্ত্রের বিপরীতে মানুষের স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সমগ্র জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র এবং সমাজের সকল ক্ষেত্রে সৃজনশীল সংস্কৃতির প্রভাব-বলয় সৃষ্টি করার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের উত্তরাধিকার থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিগুলোকে সবসময় ধারাবাহিকভাবে সক্রিয় থাকতে হবে, জনগণের ইচ্ছে এবং আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে হবে। অগণতান্ত্রিক অপশক্তির যেকোনো অপতৎপরতাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। তাহলেই দুনিয়া কাঁপানো এই গণঅভ্যুত্থানের মর্ম বস্তু বা অন্তর্নিহিত দর্শন- বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।
প্রস্তাবনা-০৫: রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ- ‘নির্বাহীবিভাগ’, ‘আইনসভা’ এবং ‘বিচারবিভাগ’র পৃথক্করণ ও ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন।
পর্যালোচনা: রাষ্ট্রের তিনটি মৌলিক অঙ্গ থাকলেও গত ১৫ বছর একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করেছে, তা হচ্ছে ‘নির্বাহীবিভাগ’। ‘বিচারবিভাগ’ এবং ‘আইনবিভাগ।’ ক্রমাগতভাবে ‘নির্বাহীবিভাগ’র ইচ্ছে পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের ক্ষমতার বিভাজন বা ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সংবিধান সুনির্দিষ্ট করে দিয়েছে। অথচ ‘নির্বাহীবিভাগ’ কর্তৃক সংবিধান উপেক্ষা বা লঙ্ঘন কিংবা অতিক্রম করার ইচ্ছেকে ‘বিচারবিভাগ’ নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। ‘বিচারবিভাগ’র জুডিশিয়াল রিভিউ করার ক্ষমতা থাকলেও তা প্রয়োগ করেনি, ‘নির্বাহীবিভাগ’র অভিপ্রায় পূরণে। ‘আইনবিভাগ’ ও ‘নির্বাহীবিভাগ’-এর কাজের সাংবিধানিকতা যাচাই করবে ‘বিচারবিভাগ’। ‘বিচারবিভাগ’ সাংবিধানিক সার্বভৌমত্বকে নিশ্চিত করবে- ১) বিচার বিভাগীয় বলবৎ করণের মাধ্যমে (by judicial enforcement) এবং ২) বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে (by judicial reviwe).
রাষ্ট্রপতি, সংসদ-সহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ হবে চার বছর। ‘বিচারবিভাগ’র পৃথক্করণসহ বিচারক নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়ন এবং ‘বিচারবিভাগ’র সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এখন নিকটবর্তী বিষয়।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন গোপন ব্যালটের মাধ্যমে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিশন-সহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ দলীয় একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিচ্ছে। তা যুগোপযোগী করতে হবে। বাংলাদেশে সংবিধান মোতাবেক সংসদীয়ব্যবস্থা শুধু কাগজে আছে কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তার কোনো প্রকাশ নেই। ‘আইনসভা’ নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ দ্বারা গঠিত হলে, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অধিকতর পর্যালোচনার সুযোগ থাকবে।
প্রস্তাবনা-০৬: রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যাপ্ত ক্ষমতায়ন।
পর্যালোচনা: কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রক্ষমতা অবশ্যই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বিশ কোটি মানুষকে একটি কেন্দ্র থেকে সকল ধরনের সেবা নিশ্চিত করা যায় না। সুতরাং বাংলাদেশে কয়েকটি প্রদেশ গঠনের প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য স্থাপন করতে হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে অধিকতর শক্তিশালী ও পর্যাপ্ত ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। স্থানীয় সরকারে এমপিদের কর্তৃত্ব বিলোপ করতে হবে। দলীয় প্রতীকবিহীন স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার সাংবিধানিক নির্দেশনা দিতে হবে।
প্রস্তাবনা-০৭: রাষ্ট্রীয়, সাংবিধানিক এবং আইন দ্বারা সৃষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যকর স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা।
পর্যালোচনা: রাষ্ট্রীয় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যেমন- নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, ন্যায়পাল, অডিটর জেনারেল, সরকারি কর্মকমিশন ইত্যাদিকে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং সরকারের অযাচিত হস্তক্ষেপ মুক্ত রাখতে হবে। রাষ্ট্র তাদের হাতে উপযুক্ত ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রদান করবে।
একটি ট্রুথ কমিশন (truth and accountability commission) গঠন করতে হবে, সত্য ও জবাবদিহিতা প্রকাশের উপায় হিসেবে। আমাদেরকে পুরনো নিষ্ঠুর সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশের জনগণ তীব্রভাবে অনুভব করছে বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের। নির্ভীক ছাত্র-জনতার অকুতোভয় সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ প্রমাণ করে যে, অত্যাচার-নির্যাতন ও অবিচারে জর্জরিত মানুষ আরও বৃহত্তর সামাজিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত।
অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন-‘কমিশন সংস্কারের সুপারিশ তৈরিতে বিভিন্ন অংশীজনদের মতামত ও প্রস্তাব গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ এতে সমাজের সকল অংশের অভিপ্রায় ও ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটবে, অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হবে।’ সংস্কার কমিশনের সাত প্রস্তাবনাভিত্তিক সংবিধান সংশোধিত হলে, গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক বিনির্মাণের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর জনগণের বিকল্প রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আশা করছি, সংবিধান সংস্কারে জাতীয় ঐক্য স্থাপনের মধ্যদিয়ে জনগণের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের অভিপ্রায়ভিত্তিক প্রজাতন্ত্র নির্মাণ করা সম্ভব হবে। এটাই হবে অগণিত শহীদের প্রতি আমাদের নৈবেদ্য।
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক
faraizees@gmail.com