সম্প্রতি সংঘটিত দু’টি ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। একটি ঢাকার ‘পঙ্গু’ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত রোগীদের নজিরবিহীন প্রতিবাদ ও অন্যটি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে হেনস্তা চেষ্টা। দায়িত্ব নিয়ে একশ’ দিন পার করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য বিশেষ বার্তাবহ এই দুই ঘটনা।
বুধবার দুপুরে শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের দেখতে গিয়েছিলেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তার সঙ্গে ছিলেন বৃটিশ দূত সারাহ কুক। আহতদের দাবি তাদের একটি অংশকে না দেখেই স্বাস্থ্য উপদেষ্টা হাসপাতাল ত্যাগের চেষ্টা করায় তারা আহত ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। প্রতিবাদ করেছেন। পরে তাদের সঙ্গে প্রতিবাদে যুক্ত হয়েছিলেন পাশের জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রোগীরাও। নূরজাহান বেগম ওই হাসপাতালে আহতদের দেখতে যাননি।
আহত রোগীদের প্রতিবাদ গড়িয়েছিল সড়ক পর্যন্ত। ‘পঙ্গু’ হাসপাতালের সামনের সড়কে গভীর রাত পর্যন্ত অবস্থান নিয়ে তারা প্রতিবাদ দেখান। উপদেষ্টাদের হাজির হয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলার আল্টিমেটাম দেন। দুপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার সূত্র ধরে চলা এই প্রতিবাদ থামাতে প্রায় শেষ রাতে সেখানে ছুটে যেতে হয় চার উপদেষ্টাকে। তাদের আশ্বাসে আপাতত আহতরা হাসপাতালে ফিরে যান। কিন্তু এদিনের এই ঘটনা ভয়াবহ এক দুঃখ বা বেদনার ছবি তৈরি করে রেখে গেছে।
গত ১৬ বছর স্থায়ী স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অপসারণে ছাত্র- জনতা যে নজিরবিহীন আন্দোলন গড়ে তুলেছিল, বুক পেতে জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি সেই আন্দোলনকারীদের যারা আহত হয়েছেন তাদের উপযুক্ত চিকিৎসা না দিতে পারা, পুনর্বাসনের উদ্যোগ না নিতে পারার এই ছবি বলে দেয়, সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দায় এবং দায়িত্বের প্রতি কতোটা উদাসীন। একদিকে হাসপাতালে শত শত আহত রোগী নামমাত্র চিকিৎসা পেয়ে অবর্ণনীয় কষ্টের সময় পার করছেন। অন্যদিকে প্রায় দেড় হাজার পরিবার সময় পার করছে স্বজন হারানোর নিদারুণ কষ্ট নিয়ে। গণআন্দোলনে বয়ে যাওয়া রক্তের ধারা শুকানোর আগেই কিছু রাজনৈতিক দল সর্বত্র দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। দ্রুত নির্বাচন আদায়ে সরকারের প্রতি চাপ তৈরি করার চেষ্টা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, গণআন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হওয়াদের এ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করতে না পারা সম্মিলিত ব্যর্থতা। এখানে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কারণ শুরুতে হাসপাতালে কয়েক হাজার মানুষ চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের পুরো শৃঙ্খলায় আনাটা কঠিন ছিল। তাদের তালিকা করা কঠিন ছিল। কিন্তু এখন তো হাতেগোনা মানুষ চিকিৎসা নিচ্ছেন। যাদের আরও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন। এই রোগীদের বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে পারছে না এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এটি স্রেফ গাফিলতি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা এ পর্যন্ত ক’দিন হাসপাতালে গেছেন আহতদের খোঁজ নিতে- এ প্রশ্নও সামনে এসেছে। আর তিনি যখন ‘পঙ্গু’ হাসপাতালে গেলেন তখন সব আহতকে দেখে আসতে অসুবিধা কী ছিল। তিনি সময় নিয়ে পাশের চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে ভর্তি আহতদের দেখতে গেলেন না কেন? যখন আহতরা ক্ষুব্ধ হয়ে নিচে নেমে এলেন তখন তিনি সেখান থেকে চলে আসলেন কেন? তাদের সঙ্গে কথা বললে তো ঘটনাটা সেখানেই থেমে যেতে পারতো। এই আহতরা তো কেউ সরকারবিরোধী না। বরং তাদের আন্দোলনের ফল, তাদের আত্মত্যাগের ফল এই সরকার। তাহলে কেন উপদেষ্টাকে ভয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করতে হয়েছে? আহতদের সঠিক চিকিৎসা দিতে না পারার ভয়টাই কি উপদেষ্টাকে তাড়া করেছিল?
উপদেষ্টা নিজের গাড়ি ছেড়ে অন্য গাড়িতে করে হাসপাতাল ত্যাগের পর সেখানে অবশ্য ছুটে গিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি আহতদের বুঝিয়ে হাসপাতালে ফেরানোর নানা চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাজ হয়নি। সে সময় হাসনাত বলেছিলেন, চিকিৎসার দাবিতে আহতদের বিক্ষোভ আর সড়ক অবরোধের চিত্রটি বড় বেদনার এক চিত্র। এটি কারও কাম্য ছিল না। কিন্তু দেখতে হচ্ছে। এর চাইতে কষ্টের আর কিছু হতে পারে না। হাসনাত আব্দুল্লাহরা যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তারই জেরে প্রবল পরাক্রমশালী সরকারের পতন হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিতে পেরেছে। এই সরকার আন্দোলনকারী আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে না পারাটা হাসনাতদের জন্য কষ্টের কারণ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের নিয়ে বৃহস্পতিবার অবশ্য বৈঠক করেছেন সরকারের উপদেষ্টারা। এখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করাও ছিলেন। বৈঠকে চিকিৎসা ঘাটতিসহ নানা বিষয় উঠে এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দ্রুতই আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে একটি গাইডলাইন প্রকাশ করা হবে। এ ছাড়া তাদের জন্য আজীবন চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আমরা আশা করবো সরকারের এই প্রতিশ্রুতি যেন দ্রুত পূরণ হয়। আহতদের পূর্ণাঙ্গ ও সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়।
‘পঙ্গু’ হাসপাতালের ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা গেছে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। সেখানে সরকারি কাজে সফরে গিয়েছিলেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। দেশে ফেরার পথে বিমানবন্দরে তাকে হেনস্তার চেষ্টা করেন একদল লোক। ঘটনার ভিডিওতে দেখা যায়, বিমানবন্দরে প্রবেশের পথে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলকে ঘিরে রাখেন একদল লোক। তারা উপদেষ্টার সঙ্গে উত্তেজিত ভাষায় কথা বলছেন। তর্ক করছেন। বারবার তার দিকে তেড়ে আসছেন। ঘিরে ধরছেন। সামনে এগুতে দিচ্ছেন না তাকে। বলছেন, আপনি মিথ্যা বলছেন। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, বিমানবন্দরে আইন উপদেষ্টাকে হেনস্তাকারীরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। সেখানে সুইজারল্যান্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নজরুল ইসলাম জমাদার ও সাধারণ সম্পাদক শ্যামল খান উপস্থিত ছিলেন। বলা হচ্ছে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে উপদেষ্টার তথ্য নিয়েই বিমানবন্দরে তারা হাজির হয়েছিলেন। এই তথ্য যে সঠিক ছিল তা প্রমাণ হলো দূতাবাস কর্মীদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেয়ার ঘটনায়।
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে হেনস্তার ঘটনায় সেখানকার বাংলাদেশ মিশনের শ্রম কাউন্সেলর মুহাম্মদ কামরুল ইসলামকে ‘স্ট্যান্ড রিলিজ’ করা হয়েছে। ওই মিশনে স্থানীয়ভাবে নিয়োগ পাওয়া এক কর্মীকেও চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তৌফিক হাসান এই তথ্য নিশ্চিত করেন। মানবজমিন অবশ্য আগেই এই তথ্য প্রকাশ করে।
জেনেভা বিমানবন্দরে ড. আসিফ নজরুলের সঙ্গে ছিলেন জেনেভা মিশনের শ্রম কাউন্সেলর কামরুল ইসলাম ও মিশনের স্থানীয়কর্মী হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত মিজান। উপদেষ্টার প্রতি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চড়াও হলেও তারা দু’জনই চুপ ছিলেন। জেনেভার এই ঘটনাটিকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে যে নানা অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্র চলছে তার অংশ বলেই মনে করছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন, এ ঘটনায় ষড়যন্ত্রকারীরা সফল হয়ে অট্টহাসি হেসেছে। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীর যেকোনো দেশে যেকোনো সময় ঘটতে পারে। কারণ মিশনগুলোতে এখনো আগের কর্মীরাই রয়ে গেছে। যে রদবদল হয়েছে তা নামমাত্র। বিদেশ সফরে যাওয়া সরকারের উপদেষ্টা ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের যাতে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে না হয় সেজন্য এখনই কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য জানিয়েছে, মিশনগুলোতে জরুরি বার্তা পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে জেনেভার মতো ঘটনা না ঘটে। সরকার এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এটিও মনে রাখা দরকার, যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা ভিন্নভাবে, ভিন্ন কৌশলে তাদের চেষ্টা করেই যাবে।