শহীদ সন্তানের ছবি ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছেন মা। হাত হারানো ছেলেটি ভাবে একটি স্বাধীনতার কাছে এই ক্ষতি খুব সামান্য।
মাকে নাস্তা রেডি করতে বলা ছেলেটি আর কোনোদিন ফিরবে না।
একই মহাকাব্যের নানা ছোট ছোট অংশ। একটি দেশ, জাতি এবং পরিবারের অপূরণীয় ক্ষতি। অন্যদিকে শহীদের মর্যাদা। ছিন্নভিন্ন এসব দৃশ্য এক করতে পারি না। সম্ভবত এটা নিজস্ব অক্ষমতা। এসব গল্প আর ছবি নিতে পারি না। বিকালে বিস্তারিত কথা বলছিলাম আমাদের ফটো সাংবাদিক জীবন আহমেদের সঙ্গে। নিরন্তর ছুটে চলা এক তরুণ। অসামান্য প্রাণশক্তিতে ভরপুর। বুলেট শরীরে নিয়েও কাভার করে গেছেন জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতিটি দিন। তার তোলা হৃদয়ভেঙে দেয়া একটি ছবি এরইমধ্যে তাবৎ দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
ছবিটি অবশ্যই আপনি দেখেছেন। মাথায় বাঁধা লাল-সবুজের পতাকা। রিকশার পাদানিতে ঝুলছে এক তরুণের নিথর দেহ। বুঝার উপায় নেই বেঁচে আছে না মারা গেছে? এ ছবি প্রকাশিত হয় মানবজমিনে। ছবির সূত্র ধরেই পিতা-মাতা খোঁজ পান তাদের সন্তানের। তবে জীবন তাদের করুণা করেনি। মর্গ থেকে সন্তানের লাশ বুঝে নেন তার।
এই ছবি ৪ঠা আগস্টে তোলা। ফার্মগেট ওভারব্রিজের নিচ থেকে। ছবির নেপথ্যের পুরো কাহিনী বুঝার চেষ্টা করি জীবন আহমেদের কাছ থেকে। শুনি সেদিনের পুরো ঘটনা। এ নিয়ে তার একটি লেখাও শেয়ার করেন আমার সঙ্গে। দৃশ্যগুলো জোড়া লাগানোর চেষ্টা করি। এরইমধ্যে নজরে আসে একটি ভিডিও। দেখার চেষ্টা করলাম। অজান্তে চোখের পানি ঝরতে থাকলো। শহীদদের গল্প। পা হারানো তরুণের গল্প। বারবার লেখার চেষ্টা করি। লেখা আসে না। মাকে চিঠি লিখেছিল আনাস। ‘একদিন তো মরতেই হবে। তাই মৃত্যুর ভয় পেয়ে স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকার চেয়ে গুলি খেয়ে বীরের মতো মৃত্যু অধিক শ্রেষ্ঠ। আমি যদি বেঁচে না ফিরি তাহলে কষ্ট না পেয়ে গর্বিত হইও।’ আনাস মায়ের কাছে আর ফিরতে পারেনি। এই মায়ের হাহাকার কি কোনোদিন শেষ হবে!
শুরুতে এক মায়ের কথা লিখেছিলাম। সন্তানের ছবি ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছিলেন যিনি। তিনি শহীদ গোলাম নাফিজের মা। রিকশার পাদানিতে পড়ে থাকা সেই তরুণের মা। ৪ঠা আগস্ট দিনটি ছিল রক্তাক্ত। সেদিনের পুরো ঘটনাপ্রবাহ বুঝার চেষ্টা করি সহকর্মী জীবনের সঙ্গে। এমনিতে তখন প্রতিদিনই রক্ত ঝরছিল। ৩রা আগস্ট শহীদ মিনার থেকে চূড়ান্ত ডাক দেন নাহিদ ইসলাম। হাসিনা সরকারের পদত্যাগের একদফা আল্টিমেটাম ঘোষণা করেন এই ছাত্রনেতা। সেনাবাহিনী আর গুলি চালাবে না সে খবর এরইমধ্যে চাউর হয়ে যায়। পতনের আগে শেখ হাসিনা শেষ চেষ্টা করেন। তার দলের সশস্ত্র ক্যাডারদের লেলিয়ে দেন আন্দোলনকারীদের ওপর। রাত থেকেই আওয়ামী লীগ এবং দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করেন।
সেদিন সকালে বাসা থেকে বের হয়েই চোখে পড়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্য। প্রকাশ্যে দেশি-বিদেশি অস্ত্র হাতে বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিতে দেখা যায় তখনকার শাসকদলের নেতাকর্মীদের। এর মধ্যেও অফিসে এসে পৌঁছাই। দিনের প্রথম সংঘাতের খবর পাওয়া যায় শাহবাগ থেকে। তবে সেখানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা টিকতে না পেরে সরে যান। কিন্তু বাংলামোটর এলাকায় দিনভর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নির্বিচারে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করে। স্পট থেকে আমাদের রিপোর্টার ফাহিমা আক্তার সুমি দফায় দফায় ফোন করে জানাতে থাকেন, কীভাবে অগণিত গুলিবিদ্ধ আন্দোলনকারীকে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে।
তবে রাজপথে যখন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলছে পর্দার আড়ালেও কিছু ঘটনা ঘটতে থাকে। আন্দোলনকারীরা দুই দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। ৫ই আগস্ট শ্রমিক সমাবেশ, ৬ই আগস্ট মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি। কিছু সময় পরই আন্দোলনের পর্দার আড়ালে থাকা একটি চরিত্রের কাছে একটি বার্তা আসে। বলা হয়, ৪৮ ঘণ্টা অনেক লম্বা সময়। এসময়ে বহু কিছুই ঘটে যেতে পারে। এরই প্রেক্ষিতে মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি একদিন এগিয়ে আনা হয়।
সে যাই হোক ৪ঠা আগস্ট একপর্যায়ে কাওরান বাজারে আমাদের অফিসের পাশের রাস্তা থেকে গুলি এবং সাউন্ড গ্রেনেড বিস্ফোরণের ভয়াবহ শব্দ শুনতে পাই। কয়েক দফায় রাস্তায় যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু ব্যর্থ হই। খবর নিয়ে জানতে পারি রামপুরার আন্দোলনকারীরা মার্চ করে ফার্মগেটের দিকে আসার চেষ্টা করছেন। কাওরান বাজার মেট্রোস্টেশনের আগ থেকেই তাদের দিকে লক্ষ্য করে পুলিশের পাশাপাশি গুলি করতে থাকে শাসক দলের ক্যাডাররা। এ সংঘর্ষ চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। পুরো এলাকায় তৈরি হয় যুদ্ধ পরিস্থিতি।
সেদিনের পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে জীবন আহমেদ বলছিলেন, আমরা চার-পাঁচজন কাওরান বাজারের অলিগলির মধ্যদিয়ে ফার্মগেট গেলাম। দেখলাম একদল পুলিশ দাঁড়িয়ে। আমি পুলিশের ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যেতে চাইলাম। হঠাৎ তিন-চারজন পুলিশ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো, ‘ওইখানে যাওয়া যাবে না। ছাত্ররা গুলি করছে। ওপাশ থেকে আপনি গেলে আপনার গায়ে গুলি লাগবে।’
পুলিশের কথা শুনে তাকে বললাম, ‘আপনি আমাকে কোনভাবে বাধা দিতে পারেন না। আমাকে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে দিন। আমাদের নিরাপত্তা আমরা দেখবো।’ কথাটা শেষ না হতেই দেখলাম পাশ থেকে একটা রিকশা ওই ভিড়ের দিকে যাচ্ছে। তখনই আমার সন্দেহ হলো ভেতরে কিছু একটা হচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল করে দেখলাম হাত-পা ধরে একটি রক্তাক্ত নিথর দেহ রিকশায় তুলে দিচ্ছে। রিকশার পাদানিতে ফেলে দ্রুত নিয়ে যাচ্ছে। ছেলেটার কপালে জাতীয় পতাকা বাঁধা। নিভু নিভু চোখে তাকাচ্ছে। পুলিশ আমাদের তার কাছে যেতে দেয়নি। দূর থেকেই ছবি তুলতে থাকি। ছবি তুলতেও বাধা দেয় পুলিশ। তবুও আমি রিকশাকে অনুসরণ করি। রিকশাটা আল-রাজি হাসপাতালের কাছে গেল। সেখানে আওয়ামী লীগের ৪০-৫০ জন নেতাকর্র্মী রিকশাটা ঘিরে ধরে। তারা ছেলেটাকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেয়নি।
আমি তখনো ছবি তুলে যাচ্ছি। হঠাৎ ওদের মধ্যে একজন আমাকে খেয়াল করলো। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা নামিয়ে চুপচাপ অন্যদিকে হাঁটা শুরু করলাম, ঠিক তখনই আমাকে চার-পাঁচ জন ডাক দিলো। জিগ্যেস করলো, ‘তুই ছবি তুলেছিস?’ আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ভাই ছবি তুলি নাই। পুলিশের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা।’ ওরা আমার ক্যামেরা চেক করলো। আমি একটু বুদ্ধি করে আগের ছবি দেখিয়ে বললাম, ‘ভাই দেখেন আপনাদের ছবি তুলি নাই।’ ঠিক পাশে বণিক বার্তার ফটো সাংবাদিক কাজী সালাহউদ্দিন রাজুকে রড দিয়ে বাড়ি মারে তারা। আরেকজন এসে তাকে লাথি দেয়। আমাদের সহকর্মী রাজু তখন রাস্তায় পড়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। হামলাকারীদের হাত-পা ধরে কোনো রকম আমরা চারজন মিলে রাজুকে টেনে নিয়ে দৌড় দিলাম। অফিসে নিয়ে এলাম রাজুকে।
শেষ কথা: নাফিজকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। বাংলার মাটি পরম মমতায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজনকে ঠাঁই দিয়েছে। এই শহীদদের আত্মত্যাগ আমরা যেন কোনো দিন ভুলে না যাই।