বি ত র্ক

কী থাকবে গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে

সোহরাব হাসান | নেপথ্যের গল্প
জানুয়ারী ৪, ২০২৫
কী থাকবে  গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রে

২০২৪ সালের রাজনীতি কেমন হবে তার প্রতিধ্বনি শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালেই। ২০২৫ সালের রাজনীতি কেমন হবে, ২০২৪ সাল সেটাও জানান দিয়ে গেল অভাবনীয় ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে। ২০২৫ সালটি নির্বাচনের বছর না নির্বাচনের প্রস্তুতির বছর এখনই নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে ভেতরে ভেতরে সবাই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজনীতিতে যে মেরূকরণ চলছে, সেটাও আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় বিএনপি এখন জামায়াতে ইসলামীকেই প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে। ২০২৫ সালের প্রথম দিন ১লা জানুয়ারি ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সমাবেশে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে এই সমাবেশে তারেক রহমানের সবচেয়ে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটি হলো জনগণের নিত্যদিনের দুর্দশা উপেক্ষিত থাকলে জনগণ খোদ সরকারের সংস্কার দাবি নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হবে। গত সাড়ে চার মাসে এটাই নতুন কথা। এর আগে আমরা রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক দলের সংস্কার, জনপ্রশাসন ও পুলিশ ইত্যাদির সংস্কারের কথা শুনে এসেছি। সংস্কারের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি কমিশনও গঠন করেছে। কিন্তু খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের  সংস্কারের কথা এর আগে কেউ বলেননি। সংস্কারের প্রয়োজন কখন হয়? যখন বর্তমান ব্যবস্থা কাজ করে না। এর আগে অন্তর্বর্তী সরকারের আকার বাড়ানো হয়েছে। প্রথমে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। এরপর সেই সংখ্যা বাড়িয়ে ২৪ করা হয়। প্রকৃতার্থে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সংখ্যা আরও বেশি। কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সহকারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারপরও সরকার জনজীবনের সমস্যা সমাধান করতে পারছে না বলেই সরকার সংস্কারের প্রশ্ন উঠেছে।  
২০২৪ সালের শেষ দিকে দুটি ঘটনা দেশবাসীর বাড়তি নজর কেড়েছে। একটি হলো, সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড, দ্বিতীয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র। প্রথমটির পেছনে নাশকতার আশঙ্কা করা হয়েছিল বিভিন্ন মহল থেকে। বলা হয়েছিল, এটা স্বৈরাচারের দোসরদের কাজ। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি জানিয়ে দিলো-  এটা নাশকতা নয়, নিছক দুর্ঘটনা। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখানে কাজে লাগেনি।


ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পাঁচ মাস পর জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র ঘোষণা করতে ছাত্রনেতাদের উদ্যোগ নিয়ে এখন রাজনৈতিক মহলে তোলপাড় অবস্থা চলছে। এর আগে তাদের কোনো কোনো নেতা মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচনা করার ঘোষণা দিয়েছিল। এর জবাবে সমালোচকেরা বলছেন, তাহলে কি ছাত্রনেতারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একাত্তরে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, সেটাও অস্বীকার করতে চান? বায়াত্তরে সংবিধান নাকচ হয়ে গেলে অন্তর্বর্তী সরকারেরও অস্তিত্ব থাকে না।


নতুন দল গঠন ও নির্বাচনকে সামনে রেখে যে রাজনৈতিক মেরূকরণ শুরু হতে যাচ্ছে, তার আভাস- ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট দল ও সংগঠনের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতে। গত মঙ্গলবার যেদিন শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ হলো সেদিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম জামায়াতের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সম্মেলনে তাদের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সহযোদ্ধা হিসেবে অভিহিত করলেন।   তিনি বলেন, ‘আমাদের সবকিছুর আগে, ব্যক্তির আগে, গোষ্ঠীর আগে, দলের আগে পুরো দেশের মানুষ। ’২৪-এর অভ্যুত্থানে যেভাবে একসঙ্গে হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, এমনকি পরিকল্পনার টেবিলে শিবিরের সঙ্গে বসে কাজ করেছি, ঠিক সেভাবে দেশের স্বার্থকে সবার উপরে রেখে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবো।’


অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপি-জামায়াত ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের দাবি করছে বিএনপি।  দুই পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক বাহাসও জমে উঠেছে। বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ‘দখলদারি ও চাঁদাবাজির’ বিরুদ্ধে জামায়াত সোচ্চার। অন্যদিকে  মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি’র নেতারা।  বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য রুহুল কবির রিজভী সিলেটে এক অনুষ্ঠানে জামায়াত নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘একাত্তরে আপনাদের ভূমিকা কী ছিল? আপনারা কোন সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন? আপনারা কোন সেক্টর কমান্ডারের আন্ডারে যুদ্ধ করেছেন?


এর আগে জামায়াতের আমীর শফিকুর রহমান বলেছিলেন, বাংলাদেশে সেনাবাহিনী ও জামায়তই খাঁটি দেশপ্রেমিক দল। তার এই বক্তব্য নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তান আমলে জামায়াত নেতারাও একই কথা বলতেন। তাহলে তাদের আনুগত্য কার প্রতি বাংলাদেশ না পাকিস্তান? আওয়ামী লীগ আমলে সরকারবিরোধী সব দল ও ছাত্রসংগঠন আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। অনেক সংগঠনের কর্মী-সমর্থকেরা জীবন দিয়েছেন। সেখানে আলাদা করে কোনো সংগঠনকে সহযোদ্ধা ঘোষণা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।


ছাত্রদের ঘোষণা নিয়ে সরকারের মধ্যেও অস্থিরতা ছিল। প্রথমে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে বলা হলো, এটা বেসরকারি ঘোষণা। এর সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু নীতিনির্ধারকেরা তখনো নিশ্চিত হতে পারছিলেন না প্রস্তাবিত ঘোষণাপত্রে কী আছে। এরপর ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সরকারের নীতিনির্ধারকদের বৈঠক হয়, যাতে অনুরোধ করা হয়, তারা যেন এককভাবে ঘোষণা না দেন। সরকারের পক্ষ থেকেই ঘোষণাপত্র দেয়া হবে। সোমবার রাতেই এক জরুরি প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন,  গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ অংশগ্রহণকারী সকল শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্রটি প্রস্তুত করা হবে। এতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিত, ঐক্যের ভিত্তি ও জনগণের অভিপ্রায় ব্যক্ত হবে।


সরকারের এই আশ্বাসে পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। বিশেষ করে বিএনপি ও গণতান্ত্রিক বাম জোট।
বিএনপি’র  পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ  ঘোষণায় কেবল জুলাই-আগস্টের ৩৬ দিনের গণ-অভ্যুত্থানের সময় নয়, বিগত ১৬ বছরের আন্দোলনের, ত্যাগের স্বীকৃতি থাকতে হবে।  এ ঘোষণায় বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম, গুম-খুন, নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুমসহ রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা-সব থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে একমত হয়ে তা করতে হবে।


৫ই আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলনের অংশীজনেরা সবাই একটা বিষয়ে একমত ছিলেন যে, শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটাতে হবে। সেটা ঘটলো। এরপর কী হবে, কারা দেশ শাসন করবে, কখন ও কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, সেসব নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিএনপি’র সঙ্গে যেমন জামায়াতের মিলমিশ হবে না, তেমনি বামদের সঙ্গেও ১২ দলীয় জোটের খাপ খাবে না।


আন্দোলনকারী ছাত্রনেতাদের মধ্যেও মতের পার্থক্য আছে। তারপরও নিজেদের মতো করে একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত চাইছেন। তারা মনে করেন, পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে না। এ কারণেই নতুন  রাজনৈতিক দল ও বন্দোবস্ত দরকার। ছাত্রনেতারা গত ৮ই সেপ্টেম্বর গঠন করেন জাতীয় নাগরিক কমিটি নামের প্ল্যাটফরম। তারা ক্রমে দল গঠনের দিকে এগোচ্ছেন। ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসার কথা আছে। জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের দাবি, তাদের এই দল গঠনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নেই। নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, ‘রাজনৈতিক দল গঠনে রাষ্ট্রীয় মদত নেয়ার প্রশ্নই আসছে না। কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগও নেই, ধোঁয়াশাপূর্ণ বক্তব্যমাত্র। তারা যখন আমাদের কিংস পার্টি বলেন, তখন জানতে চাই, অন্তর্বর্তী সরকার কার না? তারা কি এই সরকারকে নিজেদের মনে করেন না? এই সরকার অন্য কেউ চালাচ্ছে? তারা কি চান, এই সরকার না থাকুক, প্রশ্নবিদ্ধ হোক?’ (সমকাল, ২৭শে ডিসেম্বর ২০২৪)


রাজনৈতিক পথ ও মত নিয়েও দুই পক্ষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন মনে করে, একটি নির্বাচনের জন্য জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে। জনগণের সঙ্গে রাজনীতির নতুন বন্দোবস্ত হতে হবে। পুরোনো রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে, এটা স্বীকার করতে হবে।


শহীদ  মিনারের সমাবেশ থেকে ১৫ই জানুয়ারির মধ্যে সরকারের প্রতি জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র জারি করার দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে সরকার সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ পিছিয়ে ১৫ই জানুয়ারি করেছে। সে ক্ষেত্রে ১৫ই জানুয়ারির মধ্যে এসব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার সুযোগ নেই। তাহলে ঘোষণাপত্র কি আলাদা হবে? যদি সেই ঘোষণাপত্রে সংস্কারের কথাই না থাকে, তাহলে সেটি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র পরিচালনার রূপরেখা হবে না, কেবলই আন্দোলনের স্বীকৃতিপত্র হিসেবে বিবেচিত হবে।


প্রশ্ন হলো, ১৫ তারিখ বা তারপর সরকারের পক্ষ থেকে কী ঘোষণা আসবে? বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের দাবি অনুযায়ী বিপ্লবের, না রাজনৈতিক নেতাদের দাবি অনুযায়ী গণ-অভ্যুত্থানের? বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান করা যতটা কঠিন, তার চেয়ে বেশি কঠিন সেসব রক্ষা করা। নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের আগেও তিন জোটের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই রূপরেখা দেশে গণতান্ত্রিক ধারা নিশ্চিত করতে পারেনি। জুলাইয়ের বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান যাই বলি না কেন, তারপরও যে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা নিরঙ্কুশ থাকবে, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?


মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে রচিত সংবিধানে অনেক দুর্বলতা আছে। তারপরও একটি ঘোষণার মাধ্যমে এই সংবিধানকে নাকচ করার চেষ্টা হলে সেটা মানুষ মেনে নেবে না। সংবিধানে অসঙ্গতি ও বৃহত্তর জনগণের স্বার্থবিরোধী কিছু থাকলে সেটা সংশোধন করা যেতে পারে। তাই বলে পুরো সংবিধান বাতিল করার অর্থ হবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করা। আওয়ামী লীগ সংবিধানকে স্বেচ্ছাচারী কায়দায় ধোলাই মোছাই করেছে এ কথা সত্য। কিন্তু এই সংবিধানে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের অঙ্গীকার আছে, সেটা তো অস্বীকার করা যাবে না।
তাই, আমরা যদি একটি মানবিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, একাত্তরকে বাতিল করে নয়,  একাত্তরকে ধারণ করেই চব্বিশের চেতনা এগিয়ে নিতে হবে। 

নেপথ্যের গল্প'র অন্যান্য খবর