রক্তমাখা শার্ট, মর্গ এবং হতভাগা পিতার কান্না

জীবন আহমেদ | নেপথ্যের গল্প
ডিসেম্বর ২৮, ২০২৪
রক্তমাখা শার্ট, মর্গ এবং হতভাগা পিতার কান্না

আমার জানালা থেকে বৃষ্টির মাখামাখি দেখি। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে সিগারেট হাতে গভীর মগ্নতা নিয়ে তাকিয়ে থাকি দিগন্তের পানে। সবুজ ঘাসে মোড়ানো চারপাশ ঠিক মাঝখানে একটি টিনের ঘর বেশ পুরনো। বৃষ্টি হলে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকি ঘরটার দিকে। ঝুম বৃষ্টি টিনের চালে পড়ার শব্দ কানে বাজে। এমন সব অনুভূতির মধ্যেই হঠাৎ মনে হলো এক সহকর্মী বড় ভাইয়ের কথা। যিনি আমাকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন আল জাজিরার ডকুমেন্টারি দেখে। তার উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসা...আচ্ছা, জীবন আপনি যে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। ভাগ্য কি সবসময় আপনার পক্ষে থাকবে? 

 

আমি জানতে চাইলাম হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? তখনো বুঝে উঠতে পারিনি তিনি কি বলতে চাচ্ছেন? এরপরের কথা ছিল, ২০১৫ সাল থেকে আপনি পেশাগত কাজের কারণে বহু আলোচিত ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। এসব ঘটনায় আপনার কি কখনো মনে হয়নি আপনি  মারাও যেতে পারতেন? ভাগ্য আপনার সহায়ক না-ও হতে পারতো? বিশেষ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আপনার পাশে দাঁড়ানো পুলিশটি যে গুলিতে লুটিয়ে পড়েছে, তা আপনার গায়েও লাগতে পারতো। 
বেশ খানিকটা চুপ থেকে বললাম, চোখের সামনে এত বেঁচে থাকা আর এত মৃত্যু দেখেছি যে, আমার আজকাল নিজের জন্য মায়া হয় না। কারণ আমার বেঁচে থাকা বা মৃত্যু কোনোটাই আজকাল ভাবিয়ে তোলে না। ১৮ই জুলাই বৃহস্পতিবার আমি বাসা থেকে বের হয়ে প্রতিদিনের মতো ক্যামেরা হাতে ছুটলাম স্পটে। জানি না আজকে বেঁচে ফিরতে পারবো কিনা? সবটাই ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে। হয়তো ভাগ্য আমার পক্ষে থাকবে, নয়তো থাকবে না। কিছু দূর আসার পর গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হচ্ছে আশেপাশে কোথাও যুদ্ধ চলছে। বাইকের গতি বাড়িয়ে দ্রুত ছুটতে লাগলাম। রামপুরায় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির সামনে আসার পর বুঝলাম গুলির শব্দ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির দিক থেকে আসছে। বাইক একটা গলির  ভেতরে রেখে বাড্ডার রাস্তা ধরে ব্র্যাকের দিকে এগুতেই লক্ষ্য করলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার তীব্র সংঘর্ষ চলছে।  পুলিশের গুলিতে এক এক করে মানুষ গুলিবিদ্ধ হচ্ছে। ছাত্র-জনতা ভয় না পেয়ে গুলির মধ্যেই পুলিশকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। চোখের সামনে একটা কিশোরের মাথায় গুলি লাগলো। কিশোরটি রাস্তায় দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। তার মাথা বেয়ে চোখের নিচের দিকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ১৪-১৫ বছরের বাচ্চা ছেলেটি তখনো হয়তো খেয়াল করেনি তার মাথায় গুলি লেগে শরীর রক্তে ভিজে যাচ্ছে। কিছু মানুষ তাকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য ছুটে গেল। এ পর্যন্তই, এরপর সে বেঁচে আছে না মারা গেছে- জানতে পারিনি। সংঘর্ষের মধ্যেই হঠাৎ খেয়াল করলাম মধ্যবয়স্ক একজন মানুষকে চার-পাঁচজন হাত-পা ধরে নিয়ে আসছে। সাদা শার্ট পরা ভদ্রলোকের বুকে গুলি লেগেছে। পরনের সাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে আছে। আমি ছবি তুলছি, আমার কাজ শুধুমাত্র ছবি তোলা এবং পেশাগত দায়িত্ব পালন করা। সব কিছুর পরও তাই করে যাচ্ছিলাম। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের গুলি চলছে। একটা সময় পর পুলিশের গুলি শেষ হয়ে আসে। সেই সুযোগে ছাত্র-জনতা পুলিশকে ধাওয়া দিলো। পুলিশ ভয় পেয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির পাশের একটা বিল্ডিংয়ের ভেতরে আশ্রয় নিলো। তারপর চলে আসি রামপুরা টিভি সেন্টারের সামনে। ওদিক থেকে পুলিশ একের পর এক গুলি করছে। অসংখ্য ছেলেমেয়ে গুলিতে আহত হচ্ছে। আমি নির্বিকার ছবি তুলে যাচ্ছি। 
 

সকাল গড়িয়ে দুপুর। পুলিশের গুলি চলছে। একসময় আমরাও গুলি লাগবে এই ভয়ে পুলিশের পেছনে আশ্রয় নিলাম। মাথার উপর রোদ, তীব্র গরম। শরীর আর চলছে না। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বারবার আমাদের উদ্দেশ্যে বলছে, আপনারা কেন নিউজ করেন না? আপনারা দালাল সাংবাদিক! তখন ভীষণ রকমের অসহায় মনে হচ্ছিল। কাউকে কোনো কথার উত্তর দিচ্ছি না। শুধু নীরবে নিজের কাজটাই করে যাচ্ছি। তারপর ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাতিরঝিলে ঢোকার মুখে রেস্ট নিচ্ছি কর্তব্যরত সহকর্মীদের সঙ্গে। হঠাৎ আবারো পুলিশের গুলি। একদল পুলিশ আমাদের দিকে ছুটে আসছে। পুলিশ গুলি করতে পারে তাই হাত তুলে তাদের উদ্দেশ্যে বললাম, এখানে সবাই সাংবাদিক। কেউ গুলি চালাবেন না। কথা শেষ না হতেই আমাদের দিকে গুলি ছুড়লো। আমার গায়ে গুলি লাগে ওই অবস্থায় দৌড়ে পালিয়ে হাতিরঝিলের ফুটপাথে বসে পড়লাম।  

 

গায়ে ছোড়া গুলি নিয়ে আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলাম চিকিৎসা নিতে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। একের পর এক গুলিবিদ্ধ মানুষ আসছে জরুরি বিভাগে। হাসপাতাল যেন এক মৃত্যুপুরি। চারপাশে মানুষের কান্নায় ভারী হয়ে উঠলো বাতাস। কারও পায়ে গুলি, কারও মাথায় গুলি, সবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। বুঝলাম, এখানে আমার চিকিৎসা হবে না। আমাকে ডাক্তার ব্যথানাশক ইনজেকশন দিয়ে বললো, আপনি চলে যান। তারপর চলে গেলাম আনোয়ার খান মেডিকেলে। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে অফিসে ফিরি। সন্ধ্যার পর ফোন এলো। অপর প্রান্ত থেকে বলা হলো, জীবন, ঢাকা মেডিকেলের অবস্থা ভালো না। বলা মাত্র ছুটে গেলাম জরুরি বিভাগের সামনে। গিয়ে দেখি এ যেন অন্য মেডিকেল। এরকম কিছু দেখবো, একদম মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলাম না। হাত-পা কাঁপছে হাসপাতালের বাইরের চিত্র দেখে। দুই/এক মিনিট পরপরই আহত, গুলিবিদ্ধ মানুষ আসছে। 
এ যেন মেডিকেলের জরুরি বিভাগ নয়, সিরিয়ার যুদ্ধক্ষেত্র। ছবি তোলার মতো সাহস হচ্ছে না। স্কুল ড্রেস পরা একটা ছেলে আমার দিকে ছুটে এলো। তার সাদা শার্ট রক্তে ভিজে গেছে। একটি রক্তমাখা আইডি কার্ড দেখিয়ে বলছে, ভাই আমার বন্ধু আমার কোলের উপর মরে গেছে। আমি কিছু করতে পারিনি। ভাই, আমার বন্ধুকে পুলিশ বুকের উপরে গুলি মারছে। আপনারা, সাংবাদিকরা, প্লিজ একটু ভেতরে যান। আমার বন্ধুর মতো অসংখ্য লাশ পড়ে আছে। ওরা চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। 
 

ছেলেটি বন্ধুর লাশ নিয়ে ছুটে চললো। আমার চোখ ভিজে উঠছে আর ভাবছি মানুষের জীবনের দাম ক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের দিকে আমি ছেলেটার চলে যাওয়া দেখলাম। জরুরি বিভাগের সামনে রক্তের জন্য হাহাকার। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় রক্ত ম্যানেজ করা সম্ভব হচ্ছে না। কেউ কেউ রক্ত দেয়ার জন্য লাইন দিচ্ছে। কিন্তু এত রক্ত কোথায় পাবে? 
 

এদিক থেকে মানুষ আমাদের দিকে তেড়ে আসছে সাংবাদিক শুনে। ভয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছি। এত লাশ আর নিতে পারছি না। হঠাৎ এক বড় ভাই এসে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললো, প্রিয়কে চেনেন? উদ্যানের গেটে আড্ডা মারে ছেলেটা? কিছু সময় আগে গুলি লেগেছে। তার লাশ খুঁজে পাচ্ছি না? আপনি কী তার লাশটা দেখেছেন?  কিছু বুঝতে না পেরে বললাম, না ভাই লাশটা আমার চোখে পড়েনি। আমি জানি না আমার মানুষ হিসেবে কি করা উচিত? নাকি সব বাদ দিয়ে লাশটা খুঁজবো। কিন্তু মানুষকে এখনো আমি চিনে উঠতে পারছি না। কেন পারছি না? নাকি আমি না চেনার ভান ধরে লাশটা না চেনার ভয়ে মিথ্যা বলছি? আমার কি কান্না করা উচিত? নাকি ছবি তুলবো? নিজেকে ধরে রাখা বেশ কঠিন কাজ। এত এত মানুষের কান্না। কোনোভাবে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না। 
 

এসব চিত্র দেখে বাড়ি ফেরার পথে ঢু-দিলাম গুলশানের একটি রেস্তরাঁ কাম বারে। দৃশ্যপট বুঝতেই ঢু দেয়া। কি অদ্ভুত! এখানে লাশের কোনো হিসাব নেই? চিৎকারের শব্দ নেই? শহরে কি হচ্ছে কেউ কিছু জানে না? এখানে কাপল চুমু খাচ্ছে মাতাল হয়ে। চলছে হিন্দি গানের সঙ্গে নাচানাচি। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষরা এখানে। এখানে গুলির শব্দ কানে পৌঁছায় না। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে চলে গেলাম ছোট ভাইয়ের বাসায়। আমাকে দেখে বললো, ভাই আপনি ঠিক আছেন তো? ক্ষীণ কণ্ঠে বললাম, আপাতত ঠিক আছি। রাতে কিছু সময় পর পর ঘুম ভেঙে গেল। আচমকা ভয় আমাকে চেপে ধরলো। কোনোভাবেই চোখের পাতা বুঝলো না। কি জানি অজানা ভয় আর শঙ্কায় কাবু হয়ে পড়ে রইলাম। সারারাত এভাবেই কেটে গেল। 
 

১৯শে জুলাই। সকালে কারফিউ শহর অদ্ভুত এক নীরবতা পালন করছে। হঠাৎ খবর পেলাম রামপুরা টিভি সেন্টারের সামনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কারফিউ ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে গেছে। বাইক নিয়ে ছুটলাম। আসার পর দেখলাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হ্যান্ড মাইকে বারবার বলছে, আপনারা বাসায় ফিরে যান। নয়তো আমরা অ্যাকশনে যেতে বাধ্য হবো। ঠিক তার কিছু সময় পর তারা গুলি করলো। একটা গুলি একটা মানুষ। আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খুশি মনে বলাবলি করছে, একটা পড়ছে এভাবে চললে ওরা বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু তাদের ভাবনা ভুল প্রমাণ করে আন্দোলনকারীরা রাস্তা ছাড়লো না। এভাবে সারাদিন চলতে থাকলো। 
অফিসে গেলে সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক। চিফ রিপোর্টার আমাকে দেখে বলে কতোদিন ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন না, জামা-কাপড় ময়লা কেন? উত্তরে আমি বললাম, ভাই এখনো বেঁচে আছি এজন্য খুশি থাকেন। প্রতিদিন যে লাশ দেখছেন, সেই লাশের মধ্যে আমাকেও পেতে পারেন। কথা শেষ না হতেই একজন রিপোর্টার আমার পাশে দাঁড়িয়ে চিফ রিপোর্টারকে বললো, ভাই নিউজ কি দেবো! চিফ রিপোর্টার বললো, আজকে সারা দেশে মৃত্যুর সংখ্যা কতো? আজকে থেকে আপনি প্রতিদিন লাশের সংখ্যার হিসাব রাখবেন? সহকর্মী বন্ধু রিপোর্টার চা খেতে নিচে নেমে আমাকে বললো,  জীবন ভাই লাশের সংখ্যার হিসাব কি করে রাখবো? সব শুনে নিজেকে বিধ্বস্ত লাগছিল। 
 

ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় পাশাপাশি বিদেশি দু’টি গণমাধ্যমে কাজ করি বলে প্রতিমুহূর্তে ছবি পাঠানো কঠিন হয়ে গেল। কীভাবে ছবি পাঠাবো? সন্ধ্যায় বিদেশি একটা নম্বর থেকে কল এলো সুইডেন থেকে। সুইডেন অফিসের সম্পাদক কল করেছেন। জানতে চাইলেন, ঠিক আছে কিনা? শরীরের অবস্থা কী? নেটওয়ার্কের সমস্যার জন্য কথা শুনতে সমস্যা হচ্ছিল। ছবি কীভাবে পাঠাবো বললে উনি আমাকে এএফপি’র শফিক ভাইয়ের (বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব) কথা বললেন। ওনাকে বলা আছে। তিনি ইন্টারনেট ব্যবস্থা করবেন। শফিক ভাইকে কল করলে তার অফিসে যেতে বললেন। আমি সন্ধ্যার পরে তার আফতাব নগরের অফিসে গিয়ে দেখি আরেক চিত্র। বিদেশি গণমাধ্যমে কর্মরত অনেকেই সেখানে তাদের ছবি পাঠানোর জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের সবার চোখে-মুখে ক্লান্তি আর আতঙ্কের ছাপ। তারপর শফিক ভাইয়ের অফিস থেকে আমার ছবি পাঠিয়ে ফিরে যাই নিরাপদ আশ্রয়ে। ফেরার পথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ায় তারা আমাকে ছেড়ে দেয়। 
 

পরদিন কঠোর শাটডাউনের কারণে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। গণগ্রেপ্তার চলছে। আমি সেদিন অনেকটা যুদ্ধংদেহী সাজে প্রেসের ভেস্ট আর হেলমেট পরে বের হই। আগের রাতে ভেবেছিলাম মেডিকেলের মর্গে যাবো। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আর সেদিন (১৮ই জুলাই) যাওয়া হয়নি। ওইদিন রাতের পর থেকে যেহেতু শহরে আর তেমন কোনো গ্যাঞ্জাম নেই, তাই আমি সেদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে গেলাম। আমার সঙ্গে সেদিন একজন রিপোর্টার আপু ছিল। চতুর্দিকে তখন সুনশান নীরবতা। আমাদের সেদিন উদ্দেশ্যই ছিল যে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সরকারি বাহিনীর সংঘর্ষে কতোজন নিহত হয়েছে তার প্রকৃত সংখ্যা খুঁজে বের করা। মর্গের সামনে যাওয়ার পরে সেখানে কয়েকটি কুকুর ছাড়া আর তেমন কাউকেই দেখতে পাইনি। মর্গের পাশের ছাউনিতে কয়েকজন ছিল যারা এসেছিল তাদের স্বজনদের খুঁজতে। লাশকাটা ঘরের উল্টো পাশেই দুটো ডেডবডি লাল চাদর দিয়ে ঢেকে রাখা। লাশ দুটো দেখে কিছুটা অবাক হলাম। তখন হঠাৎ মনে ভাবনা এলো এই যে, বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা যে মৃত মানুষের খবর পাচ্ছি তাদের লাশগুলো কোথায়?
 

মর্গের পাশেই একটা কার্গো কন্টেইনার রাখা ছিল। আমার মনে হতে লাগলো এই কন্টেইনারের মধ্যেই হয়তো লাশ রাখা আছে। এসব ভাবতে ভাবতে মর্গের পাশে বড় টিনশেড ঘরটায় গিয়ে দায়িত্বরত পুলিশের কানে কানে জানতে চাইলাম “লাশের প্রকৃত সংখ্যা কতো জানেন? কোনো লিস্ট কি আছে?” তিনি আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে বললেন যে, “নতুন ভবনে ওইদিকে আরেকটা মর্গ আছে, সেখানে যান। সেখানেই সব তথ্য আছে।” 
আমরা দু’জন মিলে সেই মর্গ খুঁজে বের করে দেখি মর্গের নাম ময়ূরী। ময়ূরীর পাশেই একটা অফিস ঘর আর সেখানে দুই তিনজন লোক বসা ছিল। তাদের কাছে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিষয়ে জানতে চাইলে সেখানে থাকা একজন অবাক হয়ে আমাকে বললো, “আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। আপনি পরিচালক স্যারের কাছে যান। তিনি সব বলতে পারবে।”
 

তখন আমাদের সামনে দিয়ে একটা ছেলে হাতে চাবির গোছা নিয়ে মর্গের দিকে হেঁটে চলে গেল। সেই ছেলেটার সঙ্গেই একজন মধ্যবয়স্ক লোক হাঁটছিল। সে মর্গের বাইরে এসে দাঁড়ালো। এরপর সেই চাবির গোছাওয়ালা ছেলেটা মর্গের গেট খুলে ভেতরের ফ্রিজিং চেম্বার থেকে একটা লাশ বের করলো। লাশটা লাল একটা চাদর দিয়ে কিছুটা ঢাকা ছিল। বডিটা যখন বের করলো খেয়াল করলাম যে, লাশের পা দুটো তুলনামূলক ছোট। আমি ধারণা করে নিলাম যে লাশটা হয়তো কোনো ছোট বাচ্চার। আমার সঙ্গে থাকা রিপোর্টার আপুকে বললাম যে, “লাশটা হয়তো কোনো ছোট বাচ্চার।” 
 

ছেলেটা যখন লাশের ট্রলি নিয়ে বের হচ্ছিলো আমি তখন আমার ক্যামেরা রেডি করে ছবি তুলতে শুরু করি। আর তখনই সেই মধ্যবয়স্ক লোকটি এসে সেই ট্রলিতে হাত রাখে। সে আমার দিকে কিছুটা হাসি মুখ করে বলে, “আমার মেয়েকে কি আপনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন? যদি পারেন তবেই ছবি তুলবেন, নইলে না।” আমি তাকে দেখে কিছুটা অবাক হয়ে ভাবতে শুরু করি যে, এ কেমন বাবা যে, তার মেয়ের লাশ নিয়ে যেতে এসে হাসছে। কিন্তু পরক্ষণেই আমি বুঝতে পারি যে, সেই হাসি কোনো আনন্দের না, সেই হাসি আর্তনাদের। আমি ট্রলির দিকে তাকিয়ে দেখি সেখানে লাশের লাল চাদরের উপরে লেখা আছে “নাম: রিয়া মণি, বয়স: ০৬, মৃত্যুর কারণ: মাথায় শটগানের গুলি।” তখন আমার ভেতরটা কেমন যেন দুমড়ে-মুচড়ে গেল। আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো। আমি আর ছবি তুলতে পারলাম না। আমি বারবার সেই রিয়া মণির রক্তহীন সাদা পায়ের দিকে দেখতে থাকি। লক্ষ্য করলাম রিয়ার বাবার সঙ্গে আরও একজন ভদ্রলোক ছোটাছুটি করছেন। তিনি রিয়ার মামা। তার কাছে ঘটনা জানতে চাইলে তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “প্রতিদিনের মতো শুক্রবার (১৯শে জুলাই) দুপুরের খাবার খেয়ে ছাদে যায় রিয়া। কিন্তু হঠাৎ ভবনের নিচে ও চারপাশে হৈচৈ, চিৎকার- চেঁচামেচি আর গুলির শব্দ শুনে দৌড়ে ছাদে যান মেয়েকে ঘরে আনতে দীপক কুমার গোপ। মেয়েকে কোলে তুলে নিতেই বুলেট এসে বিদ্ধ হয় রিয়ার মাথায়। মুহূর্তেই ঢলে পড়ে বাবার কোলে।
 

পথ চলা থামে না। এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী হলাম জুলাই- আগস্টে। তার কিছু মনে আছে। কিন্তু যা বলতে পারিনি তার সংখ্যাই অনেক। দিন শেষে আমারও বাড়ি ফিরতে হয় নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। রিয়া মণিদের আর ফেরা হয় না। ্ত

 

নেপথ্যের গল্প'র অন্যান্য খবর