অ নু স ন্ধা ন

নতুন দলে নতুন কী?

মুনির হোসেন | নেপথ্যের গল্প
মার্চ ১, ২০২৫
নতুন দলে নতুন কী?

দেশে দেশে নয়া রাজনৈতিক শক্তির উত্থান নতুন কিছু নয়। বিপ্লবোত্তর বিভিন্ন দেশেই নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। গেল আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং দলটির শীর্ষ নেতাদের দেশত্যাগের পর বাংলাদেশেও সেই সম্ভাবনা ছিল। যেটি বাস্তবে রূপ নিয়েছে গত শুক্রবার। সেদিন হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে নতুন রাজনৈতিক দলের। নাম- বাংলাদেশ জাতীয় নাগরিক পার্টি (ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি-এনসিপি)। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো দেশীয় গণতন্ত্রের তীর্থস্থান মহান জাতীয় সংসদকে সাক্ষী রেখেই নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। যদিও বিগত সময়ে এ সংসদে গণতন্ত্রের চর্চা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবুও সংসদের সামনের প্রশস্ত মানিক মিয়া এভিনিউয়ে বড় জমায়েতের মাধ্যমে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।


ইতিহাসে আরও একটি বিষয়ে নতুন দল জায়গা করে নিয়েছে তা হলো পুরোপুরি তারুণ্যনির্ভর এমন শক্তিশালী দলের উত্থান বিশ্বে এটিই প্রথম। যে দলের শীর্ষ নেতাদের কেউ বয়সে ৩০-এর গণ্ডি পার হননি। এটা ঠিক বিভিন্ন দেশে ছাত্ররা বড় রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। ১৯৬৮ সালে ফরাসি ছাত্রআন্দোলন দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করেছিল, যা পরবর্তীতে বিভিন্ন বামপন্থি দলকে শক্তিশালী করে। ১৯৯৮ সালে ইন্দোনেশিয়ায় ছাত্রআন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার পতনের পর ছাত্ররা রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশেও ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনের ভিত তৈরি করে দেয় ছাত্ররা। ২০২৪ সালে নাহিদ ইসলামরা কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবিতে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। সরকারের ব্যাপক দমন-পীড়ন সেই আন্দোলনকে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ দেয়। প্রবল গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান হাসিনা ও তার সহযোগীরা। যা পরবর্তী সময়ে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানকে ত্বরান্বিত করে। যার গঠন প্রক্রিয়ায় শুরুতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন’ থেকে জন্ম নেয় ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’। এ প্ল্যাটফরম থেকেই নতুন রাজনৈতিক শক্তি এনসিপি’র আত্মপ্রকাশ। 


ছাত্রআন্দোলনের নেতারা শুরু থেকেই বলে আসছেন তারা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হাজির করতে চান। যার ভিত্তি হবে বাংলাদেশ ফার্স্ট (প্রথম) ও মধ্যপন্থা। এর মাধ্যমে তারা বুঝিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ঐকমত্য এবং ডানপন্থা-বামপন্থা ভুলে সবপক্ষকে নিয়ে মধ্যপন্থা অনুসরণ। কিন্তু তার বাস্তবায়ন কীভাবে তা স্পষ্ট নয়। এর বাইরে নতুন দলে নতুনত্ব কী- এ প্রশ্ন এখন সামনে আসছে। নাহিদ ইসলাম ও আখতার হোসেনের নেতৃত্বাধীন দলে এমন কী আছে যা সাধারণ মানুষকে নতুন দলে আকৃষ্ট করবে। কিংবা এমন কী দর্শন আছে যা দেখিয়ে তারা নতুন প্রজন্মকে তাদের দলে টানবেন। এমনই অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। সময়ই বলে দেবে- নতুন দল কি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন কিছু আনতে পারবে? না গতানুগতিক পথই বেছে নেবে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে। এ ছাড়াও পরিবারকেন্দ্রিক দল পরিচালনার যে সংস্কৃতি বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্যমান আছে নতুন দলেও সেটি ফিরে আসে কিনা সে শঙ্কাও থেকে যায়।


দুনিয়া জুড়ে রাজনীতির মাঠে প্রধান দু’টি শক্তি রাজ করে। এর বাইরে থাকে ছোট ছোট অসংখ্য রাজনৈতিক দল। যারা সময়ে সময়ে নির্বাচনী মাঠে ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। বিপ্লব বা বড় কোনো ঘটনার পর বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির জন্ম হয়। এগুলো পরবর্তীতে রাজনীতিতে প্রধান দুই চরিত্রের একটিকে হটিয়ে নিজেরা সেই স্থান দখল করে। এ যাত্রায় কেউ সফল, আবার কেউ ব্যর্থ হয়। এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালেও দেখা যায়- ১৯০৫, ১৯৪৭, ১৯৭১ এর বড় বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নতুন দলের জন্ম হয়েছে। মুসলিম লীগ ও আওয়ামী লীগের মতো সফল রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে আবার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দুর্দান্ত দর্শন নিয়ে সামনে আসা সম্ভাবনাময় জাসদের অঙ্কুরে হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাসও সবার জানা। ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের নেতৃত্বে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে এনসিপি’র। সেই দলটির সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হবে সামনে। তবে এখন এ দল নিয়ে যে আলোচনা আছে রাজনীতির মাঠে তা হচ্ছে এনসিপিও কিংস পার্টি কি না? কারণ এ দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম কয়েকদিন আগেই সরকার থেকে পদত্যাগ করে দলের নেতৃত্ব নিয়েছেন। বিষয়টি এমন না যে, তিনি সরকারে থাকতে দল গঠনে কাজ করেননি। এ ছাড়াও তাদের আরও দুই প্রতিনিধি আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলম এখনো সরকারে আছেন। যারা ভেতরে থেকে নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। 


ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন এ দলের আবির্ভাব নিয়ে জনমনে কৌতূহলের কমতি ছিল না। ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে এ দেশের মানুষ অপেক্ষা করেছে এনসিপি’র আত্মপ্রকাশ পর্যন্ত। কারণ দেশে দুই প্রধান দলের বাইরে সত্যিকার অর্থে বড় রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের চেষ্টা ছিল এটি। সমপ্রতি এক অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, কেবল সাইনবোর্ড থাকলেই রাজনৈতিক দল হয়ে যায় না। প্রকৃত রাজনৈতিক দলের গণভিত্তি থাকে। নতুন দলটির আসল পরীক্ষা হবে, যখন তারা নির্বাচনে বড় দলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। রেহমান সোবহানের এ বক্তব্য অনুযায়ী আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন দলের যে আত্মপ্রকাশ সেটি কতোটুকু সফল হবে সময়ই তা বলে দেবে। তবে দল গঠনের প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই তারা যে পুরনো বন্দোবস্ত থেকে বের হতে পারেননি সেটি অনেকটাই দৃশ্যমান। কারণ এ দলের শীর্ষ নেতৃত্ব বাছাই হয়েছে অগণতান্ত্রিকভাবে। সমঝোতার মাধ্যমে শীর্ষ নেতৃত্ব বাছাই হওয়ায় যাদের সঙ্গে সমঝোতা হয়নি তারা নিজেদের দল থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়াও এ দলের শীর্ষ পদগুলোর সবই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীদের দখলে। অথচ অভ্যুত্থানে অন্যতম স্টেক ছিল এ দেশের পাবলিক, প্রাইভেট সব বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের। তাই শুরু থেকেই একটা চাপা অসন্তোষ রয়েছে এনসিপি’র অভ্যন্তরে। শীর্ষ পদে নারী নেতৃত্ব ও সংখ্যালঘু প্রতিনিধি নিশ্চিতকরণ নিয়ে দল গঠনের আগেই প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন তারা। সে পর্যন্ত শীর্ষ পাঁচ পদের একটিতেও এদের জায়গা হয়নি।


এনসিপি’র ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট যে কেন্দ্রীয় কমিটি হতে যাচ্ছে সেখানে শীর্ষ পদগুলোর কাঠামোগত একটি নতুনত্ব দেখা গেছে। আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, প্রধান সমন্বয়কারী, মুখ্য সংগঠক উত্তরাঞ্চল, মুখ্য সংগঠক দক্ষিণাঞ্চল। ইতিমধ্যে শীর্ষ পদগুলোর নেতৃত্ব ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে আহ্বায়ক পদে নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব পদে আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) পদে সারজিস আলম, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) পদে হাসনাত আব্দুল্লাহ, প্রধান সমন্বয়কারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, যুগ্ম প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হান্নান মাসুদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এ কাঠামো বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন। তবে ছাত্ররা যে নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন সেটি তাদের ভাষ্য অনুযায়ী কেবল মুখেই সীমাবদ্ধ এখনো। বাস্তবে নতুন কোনো কিছুই ছাত্ররা গণমানুষের সামনে হাজির করেননি। পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বলতে তারা বুঝিয়েছেন কেবল বিদ্যমান দলগুলোর রাজনৈতিক চর্চাকে। তারা সেটি থেকে বেরিয়ে নতুন রাজনীতির চর্চা করতে চান বলে জানান। এখন সময়ই বলে দেবে এনসিপি নতুন কী নিয়ে আসেন রাজনীতিতে। এ ছাড়াও ছাত্রদের রাজনীতির দর্শন এখনো স্পষ্ট নয়। তারা কেবল ২০২৪কে তাদের রাজনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বিভিন্ন বক্তব্যে হাজির করছেন বলে অনেকে মনে করেন। ক্ষেত্রবিশেষে ১৯৭১ থেকে ’২৪কে ঊর্ধ্বেও রাখছেন।  কিন্তু রাজনীতিতে আদর্শ থাকা জরুরি। কোন আদর্শে আপনি রাজনীতি করবেন সেটি জনগণকে স্পষ্ট করতে হয়। মানুষ তখনই আপনার দলকে বেছে নেবে। এদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোরও সুনির্দিষ্ট আদর্শ রয়েছে। এ যেমন বিএনপি’র বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ, আওয়ামী লীগের বাঙালি জাতীয়তাবাদ, জামায়াতে ইসলামীর ইসলামী মূল্যবোধ ইত্যাদি। তাই ছাত্রদেরও নতুন রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদিও তারা নিজেদের মধ্যপন্থার রাজনৈতিক দল বলছেন ইতিমধ্যে। তবে সমালোচনা রয়েছে- অতিমাত্রার ডানপন্থি রাজনীতির চর্চা নিয়েও।


অন্তত আগামী নির্বাচন পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ময়দানে এনসিপি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। বড় দল বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি এ দলটিও অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা নেই। ভোটের মাঠেও ফ্যাক্টর হতে পারে এনসিপি। এ ছাড়াও প্রায় সমপর্যায়ের মধ্যপন্থা রাজনৈতিক দলের উত্থান বিএনপিকে যে স্বস্তি দিচ্ছে না তা ইতিমধ্যে দলটির নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট। আবার জামায়াত নতুন দলের উত্থানের সহযোগী হলেও ভবিষ্যতে এনসিপি তাদের রাজনীতির জন্যও চ্যালেঞ্জ হবে। এখন দেখার বিষয় রাজনীতিতে লম্বা রেসের ঘোড়া হতে এনসিপি কি সত্যিই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন কিছু আনবে, না কি পুরনো ধারার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে? তাদের রাজনৈতিক দর্শন, গণভিত্তি, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র ও সাংগঠনিক শক্তি- এসবই নির্ধারণ করবে, তারা স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক ফেনোমেনন, না কি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ বদলাতে পারবে। এমনকি বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসেও এনসিপি সত্যি ব্যতিক্রমী হতে পারে, যদি এটি দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকে এবং গণভিত্তি গড়ে তুলতে পারে। 

নেপথ্যের গল্প'র অন্যান্য খবর