ফি রে দে খা

জি এম কাদের মার্শাল ল’ জারির সুপারিশ করেছিলেন

সাইফুল হক | নেপথ্যের গল্প
ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
জি এম কাদের মার্শাল ল’  জারির সুপারিশ করেছিলেন

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বঙ্গভবন থেকে আমাকে জানানো হয়েছিল ৫ই আগস্ট সন্ধ্যায় উপস্থিত থাকার জন্য। ঢাকা সেনানিবাসে সেদিন মির্জা ফখরুলসহ অন্যান্য দলের রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে শুধু জোনায়েদ সাকি ছিলেন। আমি আর মাহমুদুর রহমান মান্না ভাই উপস্থিত হতে পারিনি। মিটিং শুরু হওয়ার দু’ঘণ্টা পরে আমি জানতে পারি ক্যান্টনমেন্ট যাবার বিষয়ে। আমার ফোন বন্ধ থাকায় তা জানতে বিলম্ব হয়ে যায়। তাছাড়া আমার গাড়ির ড্রাইভারও ছিলেন দূরে। শেষে বেরিয়েও আমাদের আর যাওয়ার সুযোগ ছিল না। পরে আমাদের বলা হলো সেনানিবাসে আপনাদের আর আসার দরকার নেই সরাসরি বঙ্গভবনে আসেন। পরে আমি বঙ্গভবনে গিয়েছি। বঙ্গভবনে পৌঁছাই সন্ধ্যা ৭টার দিকে। এর আগের ঘটনাক্রম দেশবাসী অবগত আছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দুপুর আড়াইটার দিকে শেখ হাসিনা ভারত পালিয়ে যান।


ওইদিন সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে প্রবেশ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো মাগরিবের নামাজ আদায় করেন। এরপর শুরু হয় মিটিং। প্রায় ২ ঘণ্টার মতো মিটিং হয় সেখানে। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সকলকে জানান, শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেছেন। জরুরিভাবে সেনাবাহিনী সকল দলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছে এমন কিছু দল ক্যান্টনমেন্টে গিয়েছিলেন। সেখানে বসে তারা আলাপ আলোচনা করেছেন কীভাবে একটা সরকার গঠন করা যায় এখন। দেশের এই পরিস্থিতিতে তারা আর সময় নষ্ট করতে চাননি। তিন বাহিনী প্রধান ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানরা মিলিত হয়ে বলেন, দেশের এই পরিস্থিতিতে আজকে বসে যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া না হয় তাহলে ‘ল অ্যান্ড অর্ডারের’ আরও অবনতি হতে পারে। এই বলে সেনাপ্রধান সবার মতামত জানতে চান। 


সার্বিক পরিস্থিতিতে এই ব্যাপারে এখন করণীয় কী, নেতৃবৃন্দ যদি মতামত দেন তাহলে ভালো হয়। সেনাপ্রধান শুরুতে সূচনা বক্তব্য রাখেন। সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পরই বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য রাখেন। বিএনপি মহাসচিব এই পরিস্থিতিতে প্রথম বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির কথা বলেন। মির্জা ফখরুল বলেন, তাকে অন্যায়ভাবে একটা মিথ্যা মামলায় আটকে রাখা হয়েছে। এখনই রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তাকে মুক্ত করে দিতে পারেন।


মত বিনিময়ে তিন নম্বর ব্যক্তি হিসাবে আমি কথা বলেছিলাম। চার পাঁচটা পয়েন্টে কথা বলেছিলাম আমি। প্রথমে প্রেসিডেন্টের মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেছি, শেখ হাসিনা যে পদত্যাগ করেছেন এ বিষয়ে আপনার (রাষ্ট্রপতি) দিক থেকে পরিষ্কার একটা বক্তব্য থাকা দরকার। দ্বিতীয়ত, ইতিমধ্যে ক্যান্টনমেন্টে যতটুকু আলোচনা হয়েছে আর আমরা যেটা মনে করি, একটা অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে আজকে এখনই সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। দেশের এই পরিস্থিতি যদি চলতে থাকে তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে। এরমধ্যে আমরা খবর পাচ্ছিলাম যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরে থানায় হামলা হয়েছে, সেখানে অনেক পুলিশ মারা গেছেন। আমি আশঙ্কা করলাম এখনই যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া না হয় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আরও ঘটতে পারে। আমাদের নির্দলীয় একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা দরকার। তৃতীয়ত, বলেছিলাম পরিস্থিতি খুবই উত্তেজনাকর। এখনই সমস্ত রাজনৈতিক দলকে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখা উচিত। সবাই যেন শান্ত থাকেন, ধৈর্য্য ধরেন। কোনো ধরনের সহিংসতায় আমরা যেন জড়িয়ে না পড়ি, সহিংসতা বা সংঘাতে জড়িয়ে পড়লে আমাদের অভ্যুত্থানের ফলে যে বিজয় এটা কিন্তু বিপদগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। 


আমি উল্লেখ করেছিলাম, এনায়েতপুরের যে ঘটনা এটা আরও বিস্তৃত হতে পারে এভাবে চললে। প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধানের জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রাখা উচিত। তাদের বলতে হবে আমরা একটা নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে কথা বলেছি। তিন বাহিনীর পক্ষ থেকে সেনাপ্রধান বলবেন মানুষ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেন। কোনো ধরনের নাশতকা, গুজবে যেন আমরা পা না দেই। কোনোভাবেই যেন সংঘাত তৈরি না হয়। মানুষকে আশ্বাস ও ভরসা দেয়া সবাই যেন ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রেখে চলেন। চতুর্থত, বলেছিলাম অনেকগুলো রাজনৈতিক দল আমরা বঙ্গভবনে এসেছি কিন্তু ছাত্রদের কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি দেখছি না। আলোচনার শেষদিকে তিন চারজন ছাত্র এসেছিলেন। কিন্তু তারা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মুখ না। প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধানের উচিত হবে ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গেও অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে আলোচনা করা। পারলে এটা আজকেই নইলে কালকের মধ্যে।


জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে বঙ্গভবনে দেখে সবাই বিস্মিত মন্তব্য হয়েছিলেন। সেদিন জি এম কাদের মার্শাল ল’ জারি করার কথা বলেছিলেন। যেটা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেননি। অন্যান্য দলগুলো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বশীল কথা বলেছিলেন। মামুনুল হক বলেছিলেন, ইসলামী মূল্যবোধের একজন মানুষ যেন সরকারে থাকে। অন্যরা ব্যক্তি নিয়ে কোনো কথা বলেননি। আমরা গণতন্ত্র মঞ্চের সবাই ও মির্জা ফখরুল ইসলামসহ আমাদের আগের অবস্থানেই ছিলাম, শেখ হাসিনা পরবর্তী নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার হবে। এই পজিশনে আমরা এমনই ছিলাম। মিটিং শুরুর আগে আমরা এই বিষয়ে আলাপ করে নিয়েছিলাম। বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ বাকি সবাই এমন কথাই বলেছিলেন। দলীয় সরকারের বিষয়ে কথা কেউ বলেননি। জাতীয় পার্টি থেকে জিএম কাদের ও আনিসুল হক মাহমুদ দু’জন যোগ দিয়েছিলেন। কেননা, তারা তো ফ্যাসিস্ট সরকারের বড় দোসর ছিল। এটাই ছিল জাতীয় পার্টির পুনরুত্থানের প্রথম উদ্যোগ। এটা দেখেই আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। মিটিংয়ে অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সেনাবাহিনী যোগাযোগ করতে পারেননি। বোঝা গেছে আমাদের রাষ্ট্র কতোখানি তথ্যবিহীন, এদের কারও নাম্বার নেই, তথ্য নেই, টেলিফোন নাম্বার নেই। ইচ্ছে করলে যে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় ছিল সবার কাছে পৌঁছানো যেতো। সবাই তখন তৈরিই হচ্ছিলেন আসবেন। ফলে অধিকাংশ দলের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করতে পারেননি। বামজোট, প্রগতিশীল এসব দলের সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারেননি। প্রথমে আমি, মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকি বঙ্গভবনে হাজির হই। বাকি তিন দলের তিন নেতা পরে গিয়েছিলেন। গণতন্ত্র মঞ্চের ছয় দলের প্রতিনিধিই সেখানে ছিলেন। আমাকে সেদিন বঙ্গভবনে যাওয়ার কথা বিএনপি থেকে জানানো হয়েছিল আর আমাদের জোনায়েদ সাকি ক্যান্টনমেন্টের বৈঠকে ছিলেন। ক্যান্টনমেন্টের মিটিং শেষে জোনায়েদ সাকি বলেন, সাইফুল ভাই আমরা বঙ্গভবনে যাবো, আপনি চলে আসেন। বঙ্গভবনের বৈঠকে ড. আসিফ নজরুল প্রাথমিকভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কথা বলেছিলেন।


বঙ্গভবনের বৈঠকে জাতীয় পার্টি ছাড়া সবাই পজিটিভ কথা বলেছিলেন। আমার কথার প্রেক্ষিতে ডিজিএফআই প্রধান বলেন, সাতটা থানার খবর এসেছে সবাইকে মেরে ফেলা হয়েছে। এভাবে চলতে দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তিনি বৈঠকে জানান, এখন দ্রুত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করতে হবে। আমরা দলের পক্ষ থেকে সকলেই জনগণকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানিয়ে প্রেস বিফ্রিং করলাম। জনগণ যেন কোনো হানাহানি, সংঘাতে না জড়ায়, প্রতিশোধের জায়গায় যেন কেউ না যায় এ বিষয়ে বললাম। এরপর প্রেসিডেন্ট, তিনবাহিনী প্রধানকে সঙ্গে রেখে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। 


বঙ্গভবনের বৈঠকে প্রেসিডেন্টকে বলেছিলাম, হাসিনার পদত্যাগপত্রের বিষয় নিয়ে আপনার পরিষ্কার বক্তব্য রাখা উচিত। তখন আমার কথা টেনে নিয়ে সেনাপ্রধান বললেন, হ্যাঁ শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। কথাটা এতটুকুই। যদিও পদত্যাগপত্রের বিষয়টা ৫ই আগস্টের ওই মিটিংয়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা হয়নি। 


বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করি। এটা আমাদের সমর্থিত সরকার। সরকারের প্রশ্নে কিছু সমালোচনা আছে। কিন্তু আমরা চাই সরকার যেন ব্যর্থ না হয়। এজন্য আমরা আমাদের সমর্থন অব্যাহত রেখে যেতে চাই। দলগুলোর সঙ্গে যে বোঝাপড়া করা দরকার অন্তর্বর্তী সরকার সেটা করতে পারছে না। একধরনের সমন্বয়হীনতা, সরকারের মধ্যে অনেক প্যারালাল সরকার, প্রফেসর ইউনূসের এক সরকার, আমলাদের এক সরকার, ছাত্র-তরুণরা সরকারকে আবার অন্যদিকে নিতে চাচ্ছে। ফলে এই সরকারে অনেকগুলো সরকার আমরা দেখছি। কোনো ধরনের সমন্বয় দেখছি না। একেকজন একেকভাবে কথা বলে যাচ্ছেন। আমি মনে করি, গুরুত্বপূর্ণ নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে সরকারপ্রধান হিসেবে ড. ইউনূসেরই কথা বলা উচিত। সবাই যদি কথা বলতে যায় তাহলে কথার খেই হারিয়ে ফেলে। এতে বিভ্রান্তি তৈরি করে। আমরা সমর্থন দিয়ে যাচ্ছি সরকারকে। তবে এটা শর্তহীন সমর্থন না, সরকার যে পর্যন্ত সঠিক পথে আছে, সে পর্যন্ত আমাদের সমর্থন থাকবে। আমরা মনে করি, কেউ কেউ সরকার আর রাজনৈতিক দলগুলোকে মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেষ্টা করছে। এই সরকার তো রাজনৈতিক কোনো দলের না। 


রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিপক্ষ বানানো তৎপরতা আমরা দেখছি সরকারের ভেতরে ও বাইরে। আমরা মনে করি, ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে সংস্কার রিপোর্টগুলো আসবে। অনেকগুলো ব্যাপারে আমাদের মতৈক্য রয়েছে। সরকারকে নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে, সরকার থেকে পলিটিক্যাল মেসেজ যেতে হবে নির্বাচন কমিশনে। মেসেজটা পেলে নির্বাচন কমিশন কাজ করতে পারবে। চূড়ান্তভাবে নির্বাচনের শিডিউল নির্বাচন কমিশনই ঘোষণা করবে। এ পর্যন্ত আমরা সরকারকে সময় দিতে চাই। তারা যদি আগামী বছরের মধ্যে জনপ্রিয় একটা নির্বাচন করে যেতে পারেন এটাই তাদের সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মনে করি। 

নেপথ্যের গল্প'র অন্যান্য খবর