আবু সাঈদ হত্যা: জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে যা আছে

জনতার চোখ ডেস্ক | নেপথ্যের গল্প
মার্চ ১, ২০২৫
আবু সাঈদ হত্যা: জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে যা আছে

রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে হত্যার সঙ্গে পুলিশ সরাসরি জড়িত। তারা ছাত্রলীগের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে জুলাই বিপ্লবের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায়। তারা লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায়। এমন প্রহারের শিকার হয়েছিলেন আবু সাঈদও। জুলাই বিপ্লব নিয়ে ১২ই ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন তার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড নিয়ে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, ৫ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট ছিলেন আবু সাঈদ (২৩)। পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছিলেন। কোটা বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০২৪ সালের ১৬ই জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া ইউনিভার্সিটির বারে প্রতিবাদ বিক্ষোভে জড়ো হন কয়েক হাজার স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। তবে পুলিশের হিসাবে তাদের সংখ্যা তিন হাজার থেকে চার হাজার। বিশ্ববিদ্যালয়টির এক নম্বরে গেছে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী সমবেত হলে সেখানে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসকে (ওএইচসিএইচআর) পুলিশ যে রিপোর্ট দিয়েছে, সে অনুযায়ী, যখন বিক্ষোভকারীরা গেটের ভেতর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে জোর করে প্রবেশের চেষ্টা করেন, তখন ছাত্রলীগ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। শিক্ষার্থী ও জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে। পুলিশ আরও বলেছে যে, আবু সাঈদ মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। মাথায় ক্ষত ও গানশটে আহতের কথা লেখা হয়েছে তার মৃত্যুর কারণে। নির্ভরযোগ্য ও বিভিন্ন ভিকটিম ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান ও ভিডিও থেকে ওএইচসিএইচআরের বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ আছে যে, আবু সাঈদকে হত্যায় সরাসরি পুলিশ জড়িত। ছাত্রলীগের সহযোগিতায় পুলিশ বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠিসোটা দিয়ে হামলা করে। 

 

প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, যাদেরকে প্রহার করা হয়েছে আবু সাঈদ তাদের অন্যতম। বিক্ষোভকারীদের দিকে কাঁদানে গ্যাস এবং প্রাণঘাতী ধাতব গুলি লোড করা শটগান থেকে গুলি ছুড়েছে পুলিশ। গুলিতে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হন। একজন বিক্ষোভকারী আংশিক অন্ধ হয়ে গেছেন। পুলিশ যখন গুলি করা শুরু করে আবু সাঈদ তখন তার দু’হাত প্রসারিত করে দেন। ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে দেখা যায় যে, আবু সাঈদ এক হাতে বাঁশের একটি লাঠি ধরা ছিলেন। এ সময় তিনি প্রায় ১৪-১৫ মিটার দূরে অবস্থান করছিলেন। ফলে তিনি (পুলিশ) কর্মকর্তাদের জন্য কোনো রকম হুমকি ছিলেন না। প্রত্যক্ষদর্শীরা ওএইচসিএইচআর’কে বলেছেন, আবু সাঈদ এক পর্যায়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন- আমাকে গুলি করো। তখন দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা তাকে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি করে। তাদের শটগানে ছিল প্রাণঘাতী ধাতব বুলেট লোড করা। তারা সরাসরি আবু সাঈদের বুক বরাবর টার্গেট করে। ওএইচসিএইচআর প্রাপ্ত ভিডিও এবং গুলির ছবি যাচাই করে দেখেছে। এসব ছবি প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল। এসব ছবির ডিজিটাল ফরেনসিক করেছে ওএইচসিএইচআর। তা থেকে তারা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছে কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে। ছবিতে দেখা যায় আবু সাঈদ তার দুই হাত প্রসারিত করে ছিলেন। পুলিশ যখন তাকে গুলি করে তখন তিনি কোনো হুমকি ছিলেন না। এক্ষেত্রে ওএইচসিএইচআর আবু সাঈদকে গুলির সময়, আগে ও পরের ছবির ডিজিটাল ফরেনসিকে বিভিন্নভাবে দেখিয়েছে। তার একটিতে দেখানো হয়েছে, কমপক্ষে দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা গুলি করছে আবু সাঈদকে। জিওলোকেশনের ভিত্তিতে দেখানো হয়েছে পুলিশ এবং আবু সাঈদের মধ্যে এ সময় দূরত্ব ছিল মাত্র ১৪ থেকে ১৫ মিটার।

 

 আরও একটি ছবিতে দেখা গেছে আবু সাঈদের কাঁধে লাল দাগ। এই রক্তের কারণেই তার টি-শার্টে রক্তের দাগ পাওয়া যায়। অন্য একটি ছবিতে তার শরীরে বেশ কিছু ক্ষত দেখা যায়। এর মধ্যে আছে তার হাত, বাহু, কনুই ও কাঁধ। আরও একটি ছবি থেকে দেখা যায় আবু সাঈদের শরীরে রক্ত। মেডিকেল পরীক্ষায় দেখা যায়, গুলি তার কাঁধ, ফুসফুস ভেদ করে চলে গেছে। এর ফলে শরীরের অভ্যন্তরে রক্তপাত হয়েছে। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, আবু সাঈদকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। সেখানে একজন চিকিৎসক পরে বলেছেন, গুলি আবু সাঈদের ফুসফুসে প্রবেশ করে থাকতে পারে। এ থেকে অভ্যন্তরীণভাবে রক্তপাত হয়েছে। ওএইচসিএইচআরের ফরেনসিক ফিজিশিয়ান আবু সাঈদের  মেডিকেল রিপোর্ট খতিয়ে দেখেছেন। তিনি দেখতে পেয়েছেন, আন্তর্জাতিক ফরেনসিক মানদণ্ড অনুসরণ করে যথাযথভাবে ময়নাতদন্ত করা হয়নি। ওই চিকিৎসকের নিজস্ব মেডিকেল তথ্যপ্রমাণের মধ্যে রয়েছে মৃতদেহের ছবি, শটগানের গুলি। আবু সাঈদের বুকের ডানপাশে কমপক্ষে চল্লিশটি ধাতব পেলেট। বামপাশে ৫০টির মতো ক্ষত। তার হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস এবং পেটের বিভিন্ন এলাকায় গুলি ছিল। ফরেনসিক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, যেভাবে আবু সাঈদের শরীরে গুলি পাওয়া গেছে তাতে এটা নিশ্চিত যে, তাকে কমপক্ষে দুইবার প্রাণঘাতী ধাতব পেলেট বা ছররা গুলি করা হয়েছিল এবং তা করা হয়েছিল প্রায় ১৪ মিটার দূর থেকে। আবু সাঈদের ভিডিও ফুটেজের ফরেনসিক ভিডিওতে বলা হয়েছে, আবু সাঈদের কাঁধে, বুকে এবং বাহুতে দৃশ্যমান রক্তপাতের চিহ্ন আছে। তবে মাথায় কোনো ক্ষতের লক্ষণ বা চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এর ফলে তার মৃত্যুর বিকল্প কারণ খোঁজা যেতে পারে। সেটা হলো, তিনি যখন হাসপাতালে নেয়ার আগে মাটিতে পড়ে যান তখন মাথায় আঘাত লাগে। এ থেকেও তিনি মারা যেতে পারেন। প্রকৃত ময়নাতদন্তের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও ডকুমেনটেড ক্ষত এবং সংশ্লিষ্ট ভিডিও ফুটেজ এটা সমর্থন করে যে, আবু সাঈদকে প্রাণঘাতী ধাতব ছররা গুলি করা হয়েছিল কমপক্ষে দু’বার। তার প্রেক্ষিতেই তিনি নিহত হন। এতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তাকে পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যা করেছে। 

নেপথ্যের গল্প'র অন্যান্য খবর