কলকাতার চিঠি

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়নে ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি

পরিতোষ পাল, কলকাতা | এক্সক্লুসিভ
ডিসেম্বর ৭, ২০২৪
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়নে  ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রতিদিন নতুন নতুন বিতর্কের আবর্তে স্পর্শকাতর তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। উভয় দেশের মধ্যে বাকযুদ্ধও চলছে পরোক্ষভাবে। সংখ্যালঘু নির্যাতন, সন্ন্যাসীদের গ্রেপ্তার, জাতীয় পতাকার অবমাননা নিয়ে ভারতের নানা প্রান্তে প্রতিবাদ চলছে। ভারতের সংসদেও গিয়ে পৌঁছেছে উত্তেজনার ঢেউ। নানা ধরনের হঠকারী বক্তব্যের সিংহ নাদে উত্তেজনার ধরনও পাল্টাচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। দূতাবাসে হামলা হয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ থেকেও নানা উত্তেজনাকর বক্তব্যের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সেখানেও ভারতের জাতীয় পতাকার অবমাননার ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ শোনা গেছে। 


বাংলাদেশে শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ জুলাই-আগস্ট মাসে যখন ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে বিপ্লবের চেহারা নিয়েছিল, ঠিক সেই সময় হাসিনাকে দেশত্যাগ করতে হয়েছিল। ভারতের দীর্ঘদিনের মিত্র হিসেবে সেখানেই আশ্রয় নিয়েছেন। গত চার মাস ধরে তিনি দিল্লিতেই নিশ্ছিদ্র ঘেরাটোপে সেফ হাউসে অবস্থান করছেন। আগামী দিনে তিনি অন্য কোনো দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে ভারত ছাড়বেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে আপাতত ভারতই তার নিশ্চিন্ত আশ্রয়স্থল। এই আশ্রয়দানের পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অস্বস্তিকর পর্যায় থেকে স্থবিরতার পর্যায়ে গিয়েছে। এখন তা নানা ইস্যুতে তিক্ততায় রূপ নিয়েছে। 


ভারতের পররাষ্ট্রনীতির নির্ধারকরা ধীরে চলার নীতি নিয়ে চলেছেন বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল। সামপ্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে এ পর্যন্ত পাঁচটি বিবৃতি দেয়া ছাড়া ভারতের পক্ষ থেকে কোনো কঠোর পদক্ষেপের কথা জানা যায়নি। বরং বিরোধী দলগুলো থেকে বিবৃতির দাবি এবং শাসক দলের মধ্য থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের জোরালো দাবি উঠলেও ভারত সরকার চুপচাপ রয়েছেন। বরং আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে উগ্র হিন্দুদের হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ভারত দুঃখপ্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। 


রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্পর্ককে আর তলানীতে নামতে না দিয়ে ভারতের এখনই উচিত তৎপরতা শুরু করা। ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত বিষয়। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে দু’দেশের অর্থনীতি, অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সামাজিক সম্পর্কের নানা বিষয়। রয়েছে ভূকৌশলগত সম্পর্কের বিষয়টিও। ভারতের পূর্বে তাকাও নীতির বড় অংশীদার হলো বাংলাদেশ। 


কলকাতার এক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এক ঘরোয়া আলোচনায় পরিষ্কার করে বলেন, ভারত বাংলাদেশের বিষয়ে এক বগ্গা নীতি নিয়ে চলে এসেছে। হাসিনা সরকারের ওপর সম্পূর্ণভাবে ভরসা করে ভারত বাংলাদেশের মানুষের পাল্‌সকে বোঝার কোনো চেষ্টাই করে নি। সম্ভবত অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষার তাগিদ থেকেই ভারত সেটা করেছে। বাংলাদেশের সর্বশেষ নির্বাচনের মুখে বিএনপি’র এক যুবনেতা টেলিফোনে এই প্রতিবেদককে ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলেন ভারত সরকার আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব দলকে ত্যাজ্য করার যে নীতি নিয়ে চলছে তাতে একদিন ভুগতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ এর ফলে ক্রমশ আরও বেশি করে ভারত বিদ্বেষী হয়ে উঠবে। বাস্তবে সেটাই হয়েছে। ফলে ভারত কী ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে তা নিয়ে দ্বিধায় রয়েছে। তবে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে আলোচনার প্রস্তাব দিয়ে ভারতকে একটি সুযোগ করে দিয়েছে। ভারত সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আলোচনার রাস্তা খোলার জন্য আগামী সপ্তাহে পররাষ্ট্র সচিবকে ঢাকাতে পাঠাবেন বলে জানা গেছে। ইতিমধ্যেই ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। এই সম্পর্ককে একটি বিষয় দিয়ে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না।  


ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে মত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, সব ডিম একটা ঝুড়িতে রাখার নীতি এখন আর  কাজ করবে না। তাই ভারত সরকারের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকদের এখন নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশের আগস্ট পরবর্তী বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে হবে। ভারতে বসে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার ক্ষেত্রে যে সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন তাকে দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে সদর্থক বার্তা দেয়ারও প্রয়োজন রয়েছে।


অবশ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একটি অংশের মতে, সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় নানা ইস্যুতে তর্ক-বিতর্ক হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তাই সম্পর্ককে স্বাভাবিক করার জন্য ভিন্নতর  বিকল্পের কথা ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। নয়াদিল্লিভিত্তিক চিন্তন রিচার্স ফাউন্ডেশনের সভাপতি শিশির প্রিয়দর্শী মনে করেন, বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিতিকর রাজনৈতিক পরিবেশে পারস্পরিক বোঝাপড়া গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী নেতা এবং সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের  নিয়ে ইনফরমাল আলোচনার মাধ্যমে প্ল্যাটফরম তৈরি হবে। এইসব আলোচনা থেকে এমন সব মূল্যবান মতামত ও সুপারিশ উঠে আসবে। এর ফলে সরকারি নীতিনির্ধারণে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হবে। প্রিয়দর্শী আরও মনে করেন, সৃষ্টিশীলভাবে সম্পর্কের নতুন টাইমফ্রেম গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনীতির  বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে কাজ করা প্রয়োজন। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের যে জটিলতা রয়েছে তাকে মাথায় রেখে বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে  ভারতের উচিত উদারতা ও নমনীয়তা দেখানো। 


কূটনৈতিক মহলেরও একটি অংশ মনে করেন, দুই দেশের সম্পর্কের এই সংকটময় সময়ে ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসির উপরই ভরসা করা দরকার। সাধারণভাবে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা হৃদ্যতাপূর্ণ হওয়ার সংকট যেখানে রয়েছে সেখানে বেসরকারি স্তরে অলোচনার রাস্তা খোলাটাই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসির মাধ্যমে  পারস্পরিক দ্বন্দ্ব নিরসনের কাজটি করা অনেক সহজ হয়। এজন্য বেসরকারি পর্যায়ে নানা স্তরে (এনজিও, বিশেষজ্ঞ সংস্থা, মিডিয়ার প্রতিনিধি, চিন্তাবিদ ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি সমন্বয়ে) আলোচনা, কর্মশালা পরিচালনা এবং নাগরিকদের মধ্যে যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার উন্নতির মাধ্যমে নিয়ে কাজ শুরু করা যায়। এর ফলে দ্বন্দ্ব নিরসন এবং বোঝাপড়ার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত করা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতে এই ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসিতেই ভরসা রাখা দরকার। 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর