কলকাতার চিঠি

মসজিদ-মন্দির বিতর্ক, টার্গেট কী?

পরিতোষ পাল, কলকাতা | এক্সক্লুসিভ
ডিসেম্বর ১৪, ২০২৪
মসজিদ-মন্দির বিতর্ক, টার্গেট কী?

তালিকাটি দীর্ঘ। ক্রমশ দীর্ঘতর হচ্ছিল। উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার পর বারানসির জ্ঞানবাপী, মথুরার শাহি ঈদগা, সম্ভলের জামে মসজিদ, ফতেপুর সিক্রির জামে মসজিদ ও শেখ সেলিম চিশতি দরগা, জৌনপুরের আটালা মসজিদ, লক্ষ্ণৌয়ের টিলেওয়ালি মসজিদ, বদায়ুর শামসি মসজিদ নিয়ে বিতর্ক চলছে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে। অন্যত্রও একই ভাবে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের ধারক কামাল মওলা মসজিদ, দিল্লির কুতুব মিনারের কুওয়াত-উল ইসলাম মসজিদ, কর্ণাটকের ব্যাঙ্গালুরুর জুম্মা মসজিদ, পশ্চিমবঙ্গের মালদহের আদিনা মসজিদ নিয়েও দাবি করা হচ্ছে মন্দির ভেঙে মসজিদ হয়েছে। সর্বশেষ রাজস্থানের আজমীর শরীফ দরগা নিয়েও মন্দির বিতর্ককে উস্কে দিয়েছে কট্টরপন্থি হিন্দু নেতারা। 
ভারতে হিন্দুদের মন্দিরের উপর মসজিদ তৈরি হয়েছে বলে হিন্দুত্ববাদীদের দাবি সংক্রমিত হয়েছে ভারতের নানা প্রান্তে। আদালতে মামলা ঠুকে প্রত্ন সমীক্ষার দাবি জানানো হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে কোনোরকম বিচারের পথে না হেঁটে নিম্ন আদালতের বিচারকরা সমীক্ষার নির্দেশ দিয়ে রীতিমতো দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি করছেন।
অবশ্য হিন্দুদের দাবির বিরোধিতা করে মুসলিম সংগঠনগুলোও আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। মুসলিমদের 
একটাই যুক্তি, ১৯৯১ সালে তৈরি উপাসনাস্থল (বিশেষ ব্যবস্থা) আইনে বলা হয়েছে, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট অর্থাৎ স্বাধীনতার পর ধর্মীয় উপাসনাস্থলের কাঠামোর কোনো চারিত্রিক পরিবর্তন করা যাবে না। যেখানে মসজিদ রয়েছে সেখানে এক সময় মন্দির থাকলেও তা বদলানো যাবে না আইন অনুযায়ী। অযোধ্যায় রাম জন্মভূমি মামলাতেও বলা হয়েছিল অযোধ্যা ছাড়া অন্য কোথাও উপাসনাস্থলের কাঠামোর কোনো বদল করা যাবে না। 


মন্দির-মসজিদ বিতর্কের স্থায়ী সমাধানে কংগ্রেসি প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসীমা রাওয়ের সময়ে তৈরি হয়েছিল এই প্লেস অব ওয়ারশিপ আইন। সেই সময় অনেক বিতর্ক হলেও সংসদে ‘ধ্বনি ভোটে’ পাস হয়েছিল আইনটি। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ চেয়েছিলেন এই বিতর্ককে দূরে সরিয়ে রাখতে সব সময়ের জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় পরের বছরই ঘটে যায় সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা। ১৯৯২ সালের  ৬ই ডিসেম্বর হিন্দুত্ববাদীরা শাবল, গাইতি ও কোদাল নিয়ে উন্মত্তের মতো কয়েক শত বছরের প্রাচীন বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়। এতে হিন্দুত্ববাদীদের জোশ আরও বেড়ে গিয়েছিল। পরে শীর্ষ আদালতের রায়ে অযোধ্যাতেই হিন্দুদের দাবি মেনে রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয়া হয়। এখন সেখানে চোখ ধাঁধানো মন্দির তৈরি হয়েছে। মুসলিমদের  সন্তুষ্ট করতে আদালতের নির্দেশে মসজিদ নির্মাণের জন্য কয়েক কিলোমিটার দূরে আলাদা জায়গায় জমি দেয়া হলেও সেখানে এখন পর্যন্ত মসজিদ নির্মাণের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। 


তবে এর পরেই বারানসিতে জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে শুরু হয় নতুন করে আইনি লড়াই। সেই আইনি লড়াইয়ে ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় প্যান্ডোরা বাক্স খুলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন পিপলস ডেমোক্রেট পার্টির মেহবুবা মুফতি। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশও একই অভিযোগ করেছেন। এই মামলায় চন্দ্রচূড় বলেছিলেন, উপাসনাস্থল আইন জ্ঞানবাপীতে প্রত্ন সমীক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নয়। আইনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জ্ঞানবাপীতে দু’দফায় সমীক্ষার নির্দেশ দেয়া হলেও তা আটকানোর পথে যান নি চন্দ্রচূড়। এমনকি পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের নির্দেশে মসজিদের নিচ তলায় পূজারও অনুমতি দেয়া হয়। প্রশ্ন উঠেছে, আইনে যেখানে বলা হয়েছে উপাসনাস্থলের কাঠামোর চারিত্রিক কোনো বদল হবে না সেখানে একের পর এক আদালতে মন্দির বিতর্ক তুলে মামলা হচ্ছে কী করে? কী করেই বা নিম্ন আদালতের বা হাইকোর্টের বিচারকরা সমীক্ষা করাকে আইনের পরিপন্থি নয় বলে রায় দিচ্ছেন? 


অবশ্য মূল আইনটি নিয়েই হিন্দুত্ববাদীরা একাধিক মামলা করেছেন সুপ্রিম কোর্টে। মামলাকারীদের বক্তব্য, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২২৬ অনুযায়ী হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আদালতের কাছে তাদের ক্ষোভ জানাতে পারছেন না। ওই আইনের জন্য ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্টের আগে ‘দখলীকৃত’ হিন্দু ধর্মস্থানের ধর্মীয় চরিত্র পুনরুদ্ধার করা যাচ্ছে না বলে তারা মনে করেন। 
এই রকম ১৯টি মামলা হলেও যে সব ক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের নির্দেশের ফলে আইনি বিতর্ক দেখা দিয়েছে সেই মামলাগুলোই সুপ্রিম কোর্ট শুনেছেন বলে জানানো হয়। শুনানিতে বৃহস্পতিবার শীর্ষ আদালত জানিয়ে দিয়েছেন, নতুন করে ধর্মীয় কাঠামোর পরিবর্তন সংক্রান্ত কোনো মামলা করা যাবে না। ইতিমধ্যেই বিচারিক আদালত সমীক্ষার যে সব নির্দেশ দিয়েছেন সেগুলোও স্থগিত থাকবে। কোনো বিচারিক আদালত এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর বা চূড়ান্ত রায় দিতে পারবেন না আপাতত। ভারত সরকারকে এ ব্যাপারে রিপোর্ট দিতে বলেছেন। 
তবে গত কয়েকদিন ধরেই সংখ্যালঘু সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও বিশিষ্টজনেরা  সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন যে, উপাসনাস্থল আইনকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করা  হোক। তারা বলেছেন, ১৯৯১ সালের আইনটি মুড়ি-মুড়কির মতো মামলা হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। 
আসলে ২০২১ সালে উপাসনাস্থল  আইনকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা হলেও ভারত সরকার রিপোর্ট দিতে টালবাহানা করাতেই এতদিন শুনানি হয় নি। এখনো তারা তাদের স্পষ্ট মতামত জানায় নি। এবার শুনানিতে আপাতত আইনি লড়াইকে ঠাণ্ডাঘরে পাঠিয়ে বিরোধ চাপা দেয়ার ব্যবস্থা হলো।


বিচারিক আদালতের  সমীক্ষার নির্দেশ সামপ্রদায়িক উত্তেজনাই তৈরি হচ্ছে। সমপ্রতি উত্তর প্রদেশের সম্ভলে শাহি মসজিদে আদালতের নির্দেশে সমীক্ষা চালাতে গিয়ে সামপ্রদায়িক উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এতে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। রাজস্থানের আজমীর শরীফ দরগা নিয়েও নিম্ন আদালতের বিচারক একতরফা সমীক্ষার নির্দেশ দিয়ে প্রবল শোরগোল তৈরি করেছেন। 
প্রশ্ন উঠেছে, ভোটের রাজনীতিতে মেরূকরণের লক্ষ্য নিয়েই কি নিয়মিত মসজিদ-মন্দির বিতর্ক  তোলা হচ্ছে? আরও মজার বিষয় হলো, অধিকাংশ বিরোধের ক্ষেত্রে মামলা হয়েছে উত্তরপ্রদেশে, এখন যেখানে ক্ষমতায় রয়েছেন হিন্দু সন্ন্যাসী যোগী আদিত্যনাথ। রাজনৈতিক  পর্যবেক্ষকদের মতে, আগামী ২০২৭ সালে উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনের জমি প্রস্তুত করতেই বিজেপি শাসিত এই রাজ্যে মসজিদ-মন্দির বিরোধকে তুলে ধরে সুস্পষ্ট মেরূকরণের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যেই যোগী আদিত্যনাথের সরকার রাজ্যের মানুষের কাছে ক্রমশ হতাশার কারণ হয়ে উঠছেন। আর তাই সেই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যই মসজিদ-মন্দিরকে উস্কে দেয়া হচ্ছে। অন্য রাজ্যেও গেরুয়া রাজনীতির অঙ্কেই বিরোধ নিয়ে সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীদের।  
পশ্চিমবঙ্গের  মালদহের আদিনা মসজিদ নিয়েও মন্দির বিতর্ক তুলে সোচ্চার হয়েছেন বিজেপি নেতারা। আগামী ২০২৬ সালে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন। সামপ্রতিক অতীতের নির্বাচনগুলোতে কোণঠাসা হয়ে বিজেপি এখন নিত্যনতুন ইস্যু হাতড়ে বেড়াচ্ছে। আদিনা মসজিদটি নাকি হিন্দু মন্দির ছিল বলে বিগত কয়েক বছর ধরে দাবি করে আসছে বাংলার বিজেপি নেতারা। ফের এই দাবিতে সরব হয়েছেন বিজেপি নেতা তথা আইনজীবী তরুণজ্যোতি তিওয়ারি। তার মতে, এই কাঠামোর আসল ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে আইনি পথে হাঁটা উচিত। আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমেই হিন্দুরা তাদের অধিকার ফিরে পেতে পারে এবং এই স্থাপত্যের আসল রূপ ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। 


বিজেপি নেতাদের মতে,  মধ্যযুগীয় ভারতে ইসলামী সমপ্রসারণের সময়কালে সংঘটিত আগ্রাসন এবং ধ্বংসকে প্রতিফলিত করে এই সব মসজিদ। মূল মন্দিরকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করে এর একটি নতুন ধর্মীয় পরিচয় আরোপ করা হতো সেই যুগে। এভাবে সেই সময় হিন্দু ঐতিহ্য এবং উপাসনালয়গুলোকে পদ্ধতিগতভাবে মুছে ফেলা হতো। 


আসলে বিজেপি মন্দির রাজনীতির উপর ভর করেই নির্বাচনে যেতে চায়। বিরোধী দলের এক মুসলিম সাংসদ মনে করেন, হিন্দু আবেগকে উস্কে দিতে এসব করা হচ্ছে। আর হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের দীর্ঘ দিনের এজেন্ডাই হলো অযোধ্যা, বারানসি, মথুরায় মসজিদের উপর মন্দির পুনঃনির্মাণ করার দাবি জানানো। তবে এখন এই সব জায়গা ছাড়াও ভারতের  প্রতিটি রাজ্যেই তারা বিতর্কিত জায়গা খুঁজছেন। কোথাও কোথাও হিন্দুত্ববাদীরা এমনও বলছেন, মুসলিমদের উচিত দাবি ছেড়ে দিয়ে সমঝোতায় আসা। তবে মুসলিমরা এই বিতর্কের ব্যাপারে খুবই সতর্কতা অবলম্বন করে চলছেন। তারা চান, ১৯৯১ সালের উপাসনাস্থল আইন অনুযায়ী সব চলুক। এ ব্যাপারে বিচার ব্যবস্থার উপর তারা ভরসা রাখছেন। তবে শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট কোন পথে হাঁটবেন সেটাই দেখার বিষয়। 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর