আ ন্ত র্জা তি ক

হাসিনার ভাগ্য বরণ করবেন না তো দিশানায়েকে!

জনতার চোখ প্রতিবেদন | আন্তর্জাতিক
জানুয়ারী ১৮, ২০২৫
হাসিনার ভাগ্য বরণ করবেন না তো দিশানায়েকে!

বাংলাদেশের পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতোই কি হবে শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকের পরিণতি! শেখ হাসিনা একই সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে ঘোর শত্রু দুই নৌকায় পা রেখেছিলেন। তিনি একদিকে ভারতের সঙ্গে ‘স্বামী-স্ত্রীর’ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে ছিল দহরম মহরম। কিন্তু এ দু’টি দেশের মধ্যে রয়েছে ঘোর শত্রুতা। দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে তারা প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ। এমন দু’টি দেশের সঙ্গে কূটনীতির ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করবেন শেখ হাসিনা তা নিয়ে ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের উদ্বেগের শেষ ছিল না। ভারত ও চীন ইস্যুতে তার সরকার ভারসাম্য রক্ষার নীতি ঘোষণা করেছিল। কিন্তু তিনি সেই কথা রাখতে পারেননি। শেখ হাসিনাকে শেষ পর্যন্ত ভারতকে বেছে নিতে হয়েছে। তিনি পালিয়ে ভারতে যাওয়ার পর পাল্টে যায় চীন। তারা সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিতে থাকে। শেখ হাসিনা যখন যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ হন, তখন তাকে আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে বৃটেনও না করে দেয়। বাকি বিশ্বের কোনো দেশ তাকে আশ্রয় দিতে চায়নি। চীনও তার মধ্যে অন্যতম। ফলে তিনি আর কোথাও আশ্রয় পাননি। তাকে দিল্লিতে একটি সুরক্ষিত অবস্থানে আশ্রয় নিতে হয়েছে। সেখান থেকে দেয়া বক্তব্য, বিবৃতির জন্য দেশের চোখে তিনি অন্যায় করছেন। তার মুখ বন্ধ রাখার জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি হয়েছে। এখন আলোচনায় এসেছেন শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট অনূঢ়া দিশানায়েকে। তিনি বামপন্থি, চীনপন্থি হলেও দিল্লির সঙ্গে দহরম মহরম সম্পর্ক গড়েছেন। প্রথম বিদেশ সফরে ভারতকে বেছে নিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। বলেছেন, তার দেশের কোনো বন্দর ভারতের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজে ব্যবহার করতে দেবেন না। জানুয়ারির মধ্যভাগে তার চীন সফরে যাওয়ার কথা। সেখানে চীন নিশ্চয়ই তার কাছে বিস্তর দাবি-দাওয়া তুলে ধরবে। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কার কাছে চীন যে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, তার অর্থ ফেরত চাইবে। সেখান থেকে ফিরে তিনি কী অবস্থান নেন- তা এখন দেখার বিষয়। দেশবাসীকে প্রতিশ্রুতির সাগরে ভাসিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। এখন দিল্লির সঙ্গে নাকি বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়বেন, নাকি শেখ হাসিনার মতো ভারসাম্যের কূটনীতি চর্চা করবেন- সেটা বলে দেবে সময়ই। যদি তিনি দুই দেশকে একসঙ্গে ধরেন- তাহলে সমূহ বিপদের আশঙ্কা আছে। একদিনে নিকট প্রতিবেশী ভারত। অন্যদিকে বিপুল ঋণদাতা চীন। সাধারণত দাতাদের সামনে মুখ উঁচু করে কথা বলা যায় না। তাদের দাবি মেনে নিতে হয়। তাহলে বেইজিং যদি অনুচিত দাবি তোলে, কী করবেন দিশানায়েকে? 


বিস্ময়করভাবে শ্রীলঙ্কায় নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বামপন্থি অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। তিনি এবং তার দল শ্রীলঙ্কার রাজনীতির দৃশ্যপটকে পাল্টে দিয়েছেন। কিন্তু অর্থ সংকটে থাকা এই দ্বীপরাষ্ট্রের নতুন শাসক দ্রুতই অনুধাবন করেছেন যে, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা খুব সহজ কাজ নয়। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এরপর নভেম্বরে পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় পায় তার ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) ও জোট। সেখানে নতুন বছর শুরু হয়েছে। তিনি এবং তার সমর্থকরা চান দেশে একটি পরিবর্তন। বিধ্বস্ত অর্থনৈতিক সংকট ও অনেক বছরের অপশাসনের ফলে যে ক্ষতি হয়েছে তা পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু ভোটারের প্রত্যাশা পূরণ করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে সরকারের কাছে জনগণের চাওয়া অনেক বেশি। ২০২২ সালে অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়ে শ্রীলঙ্কা। তারপর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ছিল ভঙ্গুর। এ সংকট থেকে বেরিয়ে আসা তাদের জন্য অনেক কঠিন। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এসব কথা লিখেছেন বিবিসি’র সাংবাদিক ইথিরাজন আনবারাসান। তিনি আরও লিখেছেন, নভেম্বরে  পার্লামেন্ট নির্বাচন হয়। তাতে ২২৫ আসনের মধ্যে এনপিপি জয় পায় ১৫৯ আসনে। অপ্রত্যাশিতভাবে তারা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। এর মধ্যদিয়ে নিজের ম্যান্ডেট অনুযায়ী বড় আকারে অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কারের মধ্যদিয়ে চলার বিপুল ক্ষমতা পেয়ে যান প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে। নির্বাচনের ফল যখন আসছিল তখনো আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফের একটি সফররত প্রতিনিধিদলের সঙ্গে মিটিং করছিলেন নতুন প্রেসিডেন্ট। আইএমএফের সঙ্গে বিদায়ী সরকার বেইলআউট প্যাকেজ হিসেবে আইএমএফের সঙ্গে ২৯০ কোটি ডলারের সমঝোতা করেছে। কিন্তু তাদের সঙ্গে করা চুক্তি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দেয়। এর ফলে কঠোরভাবে কৃচ্ছ্রতাসাধনের পদক্ষেপ নেয়া হয়, বাড়ানো হয় ট্যাক্স, কর্তন করা হয় জ্বালানির ওপর ভর্তুকি। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনধারণ হয়ে পড়ে কঠিন। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারণার সময় দিশানায়েকে এবং তার জোট প্রতিশ্রুতি দেয় যে, নির্বাচিত হলে তারা আইএমএফের সঙ্গে নতুন করে এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা করবে। তবে নির্বাচিত হওয়ার পর পুরো পাল্টে যান দিশানায়েকে। তিনি নতুন পার্লামেন্টে ভাষণ দেয়ার সময় পুরো ইউটার্ন নেন। বলেন, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমন যে, এটাকে হালকাভাবে নেয়া উচিত নয়। ভুল করার মতো কোনো জায়গা নেই। (আইএমএফের) শর্ত ভালো কি মন্দ তা নিয়ে আলোচনার মতো সময় এটা নয়। চুক্তি আমাদের পক্ষে কিনা তা নিয়েও আলোচনার সময় এটা নয়। এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে দু’বছর লেগেছে। আমরা সেখানে আবারো শুরু করতে পারি না। 


তার দল এনপিপি’র বিষয়ে ভোটারদের রায়কে দেখা হয় আর্থিক সংকটে জনগণের অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে। জনগণের অসন্তোষে ২০২২ সালে ক্ষমতাচ্যুত হন সাবেক প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে। ওই সময় শ্রীলঙ্কার হাতে খাদ্য ও জ্বালানি কেনার মতো অর্থ ছিল না। তারা এক পর্যায়ে প্রায় ৪৬০০ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ পরিশোধের বিষয়ে নিজেদেরকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। ভারত, চীন এবং জাপান সহ অন্যরা তাদেরকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়। 


সম্প্রতি যে নির্বাচন হয়েছে তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বিশেষ করে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাকসে, রনিল বিক্রমাসিংহে ও অন্যদের ওপর জনগণের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে। কারণ, তারা অর্থনৈতিক সংকটের কোনো সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ বিষয়ে বর্ষীয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর জয়াদেবা উয়াঙ্গোডা বলেন, অতিমাত্রায় ট্যাক্স বসানো হয়েছে। জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রেক্ষিতে জনগণকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি দেয়া হতে হবে দিশানায়েকের অগ্রাধিকারের অন্যতম। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে আনতে অবিলম্বে পদক্ষেপ চায় জনগণ। শ্রীলঙ্কা হলো আমদানিনির্ভর একটি দেশ। খাদ্য ও ওষুধের মতো অতি প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য তাদের প্রয়োজন বৈদেশিক মুদ্রা। 


বর্তমানে কলম্বো তাদের মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এর কারণ, তারা ঋণ পরিশোধ স্থগিত রেখেছে। আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে সম্ভবত প্রকৃত লড়াইটা শুরু হতে পারে। ওই সময়ে ঋণ শোধ করতে হবে শ্রীলঙ্কাকে। আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে যদি জনগণের জীবনযাত্রার মানের কোনো দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা না যায়, তাহলে প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে এবং তার সরকারের ওপর জনগণের আস্থার পরিবর্তন হতে পারে। প্রফেসর উয়াঙ্গোডা বলেন, জনগণ তাকে বিপুল ম্যান্ডেট দিয়েছে। সামাজিক কল্যাণমূলক কর্মসূচির মাধ্যমে কিছুটা স্বস্তি তিনি দিতে পারবেন- এ জন্য তার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা উচিত আইএমএফের। একই সঙ্গে দিশানায়েককে চীন ও ভারতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কারণ, শ্রীলঙ্কায় এই দু’টি দেশের প্রতিযোগিতা আছে। সাম্প্রতিক সময়ে তারা এই দেশে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করেছে। প্রফেসর উয়াঙ্গোডা বলেন, ভারত ও চীন উভয়েই চাইবে কলম্বো তাদের প্রভাব বলয়ের মধ্যে থাকুক। আমার মনে হয় কারও প্রতি ঝুঁকে না পড়ে নতুন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি হবে অত্যন্ত আশাবাদী। 


ইতিমধ্যে সতর্কতার সঙ্গে কূটনৈতিক চাল দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে। তিনি প্রথম সরকারি সফর হিসেবে মধ্য ডিসেম্বরে বেছে নিয়েছেন দিল্লিকে। তার ওই সফরের সময় শ্রীলঙ্কার বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে দুই দেশের মধ্যে পাওয়ার গ্রিড সংযোগে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় নিজেদের অবস্থান বৃদ্ধি করতে মরিয়া চীন। বিশেষ করে চীনের একটি ‘গবেষণামূলক’ জাহাজ  নোঙ্গর করে শ্রীলঙ্কার বন্দরে। এ স্থানটি ভারতের সর্বদক্ষিণ থেকে খুব কাছে। এ নিয়ে দিল্লিতে তীব্র উদ্বেগ দেখা দেয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট দিশানায়েকে বলেন, আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে একটি নিশ্চয়তা দিয়েছি যে, ভারতের স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর এমন কোনো কিছুকে আমাদের বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দেবো না। এই নিশ্চয়তা পাওয়ার পর দিল্লির কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট দিশানায়েককে বেইজিংয়ের চাওয়ার দিকেও নজর দিতে হবে। তিনি এ মাসের মধ্যভাগে চীন সফরে যাবেন। তখন তাকে চীনের দাবি-দাওয়ার মুখে পড়তে হবে। তখনই দেখা যাবে দিশানায়েকে দিল্লির মন রাখেন নাকি চীনকে খুশি করেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ সামনে চলে আসে। তিনি যেমন ভারতের দিকে ঝুঁকেছিলেন, তেমনি চীনের প্রতিও। চীন বাংলাদেশে বড় মাত্রায় বিনিয়োগ করার পর দিল্লিতে উদ্বেগ দেখা দেয়। ভারতের পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়। বলা হয়, বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সাবেক সরকারের তরফ থেকে বলা হয়, তারা ভারসাম্য রক্ষা করে চলবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী তাই হয়েছে? ৫ই আগস্ট জনরোষে পড়ে ক্ষমতা ছেড়ে গোপনে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তারপর থেকে তিনি নয়াদিল্লিতে গোপন স্থানে নিরাপদে অবস্থান করছেন। এক্ষেত্রে তিনি ভারতের ওপর ভর করেছেন। 

আন্তর্জাতিক'র অন্যান্য খবর