ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতারা কাটাছেঁড়া করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সংসদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি খোদ নেহেরুর কাজকর্মের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। আর এবার বিজেপি আগ্রহী হয়ে উঠেছে জওহরলাল নেহেরুর লেখা ব্যক্তিগত চিঠি নিয়ে। বিশেষ করে ভারতের শেষ ভাইসরয় লুইস মাউন্টব্যাটনের স্ত্রী এডুইনা মাউন্টব্যাটনকে লেখা চিঠিগুলো নিয়ে। সোনিয়া গান্ধীর কাছে থাকা জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত চিঠি ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে ক্রমশ সোচ্চার হচ্ছেন বিজেপি নেতারা। বিজেপি নেতাদের অভিযোগ, ৫১টি কার্টনভর্তি নেহেরুর লেখা চিঠিপত্র সোনিয়া গান্ধী সরিয়ে নিয়েছেন। তার মধ্যে ছিল এডুইনা মাউন্টব্যাটনকে লেখা অসংখ্য ব্যক্তিগত চিঠি। বিজেপি’র মুখপাত্র সম্বিত পাত্র সরাসরি জানতে চেয়েছেন এডুইনাকে লেখা চিঠির বিষয়বস্তু। সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ প্রদীপ ভাণ্ডারি সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, এডুইনাকে লেখা চিঠিতে কী এমন গোপনীয় বিষয় রয়েছে যে, সোনিয়া গান্ধী সেগুলো নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রেখেছেন। দেশ সোনিয়া গান্ধীর কাছে এর উত্তর দাবি করছে।
জওহরলাল নেহেরু চিঠিপত্রের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বহু মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। তিনি চিঠি লিখেছিলেন, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, জয়প্রকাশ নারায়ণ, পদ্মজা নায়ডু, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত, অরুণা আসফ আলি, বাবু জগজীবন রাম, গোবিন্দবল্লভ পন্থসহ অনেকের কাছেই এবং অবশ্যই লেডি মাউন্টব্যাটনকে। সেইসব চিঠিপত্র দীর্ঘদিন গান্ধী পরিবারের হাতেই ছিল। তবে নেহেরুর মৃত্যুর পর তার বাসভবন তিন মূর্তি ভবন সংরক্ষণের ভার হাতে নিয়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। পরে সেটি নেহেরু সংগ্রহশালা এবং গবেষণার কেন্দ্র হয়ে ওঠে । বর্তমানে বিজেপি সরকার সেটির নাম পরিবর্তন করে ‘প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহশালা এবং গ্রন্থাগার সোসাইটি’ রেখেছে। নেহেরু কন্যা ইন্দিরা এক সময় নেহেরুর লেখা সব চিঠিপত্র সংগ্রহশালার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তখন অবশ্য সেগুলো প্রকাশ করা হয়নি। ১৯৭১ সাল থেকে ওই সংগ্রহশালার তত্ত্বাবধানেই ছিল নেহেরুর ব্যক্তিগত চিঠিগুলো। তবে এখন জানা যাচ্ছে, ২০০৮ সালে সোনিয়া গান্ধী সেইসব চিঠিপত্র লোক পাঠিয়ে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছেন। অভিযোগ, ৫১টি কার্টনভর্তি সেইসব চিঠিপত্র এখনো সোনিয়া গান্ধীর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে। এতদিন পরে হঠাৎ করে সেগুলোই ফেরত চাওয়ার দাবি উঠেছে। অবশ্য এই বিষয়ে নেহেরু পরিবারের তরফে কখনোই মুখ খোলা হয়নি।
সমপ্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে নেহেরুর লেখা চিঠিগুলো ফেরত চেয়ে নেহেরু পরিবারের উত্তরসূরি রাহুল গান্ধীকে চিঠি দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী সংগ্রহশালা এবং গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ। সংগ্রহশালার পক্ষে ইতিহাসবিদ রিজওয়ান কাদরি গত ১০ই ডিসেম্বর লোকসভার বিরোধী দলনেতা তথা কংগ্রেস সংসদ সদস্য রাহুল গান্ধীকে চিঠিতে লিখেছেন, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর ব্যক্তিগত চিঠির ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিচার করে সেগুলো ফিরিয়ে দিন সনিয়া গান্ধী। সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষের আর্জি, চিঠির আসল প্রতিলিপি না ফেরানো হলেও অন্তত ফোটোকপি কিংবা ডিজিটাল সংস্করণ দেয়া হোক। গত সেপ্টেম্বরেও চিঠিগুলো ফেরানোর জন্য সোনিয়াকে আর্জি জানিয়েছিলেন সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষ। চিঠিতে লেখা হয়েছে, আমরা বুঝতে পারছি নেহেরু পরিবারের কাছে এই নথিগুলোর ব্যক্তিগত তাৎপর্য রয়েছে। যদিও সংগ্রহশালা কর্তৃপক্ষ মনে করে, এই ঐতিহাসিক সম্পদ গবেষক ও ইফতহাসবিদদের কাছে আরও সহজলভ্য হওয়া উচিত।
নেহেরু ও এডুইনার সম্পর্ক নিয়ে অতীতে বহুবার আলোচনা হয়েছে। মাত্র দু’বছর তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল, যে দু’বছর (১৯৪৭-১৯৪৮) মাউন্টব্যাটন ভাইসরয়ের দায়িত্ব নিয়ে ভারতে ছিলেন। এটা ঠিক যে এডুইনার সঙ্গে নেহেরুর গভীর সম্পর্কের কথা তৎকালীন কংগ্রেস নেতারাও জানতেন। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ তার আত্মজীবনীতে নেহেরুর ওপর লেডি মাউন্টব্যাটনের বিশাল প্রভাবের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, জওহরলাল লর্ড মাউন্টব্যাটনের দ্বারা খুবই প্রভাবিত হয়েছিলেন, তবে তার চেয়েও বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন লেডি মাউন্টব্যাটন দ্বারা। আজাদের মতে, লেডি মাউন্টব্যাটন শুধু খুবই বুদ্ধিমতি তাই নয়, তার ছিল বেশ আকর্ষণীয় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ মানসিকতা।
নেহেরু ও এডুইনার চিঠির অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তু এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। জানা যাবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত। তবে লুইস ও লেডি মাউন্টব্যাটনের কন্যা পামেলা হিকস তার লেখা ‘ডটার অব এম্পায়ার: লাইফ এজ এ মাউন্টবেটন’ বইয়ে তার মা ও নেহেরুর সম্পর্ক নিয়ে আলোকপাত করেছেন। তিনি যে বেশকিছু চিঠি নিজে দেখেছেন তাও তার লেখা বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি তার মা ও নেহেরুর মধ্যেকার সম্পর্ককে ‘প্রগাঢ়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পামেলা লিখেছেন, লেডি মাউন্টব্যাটন তার স্বামী লুইসের সঙ্গে ভারতে পা দেয়ার পর থেকেই দু’জনের মধ্যে প্রগাঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। একটি চিঠি থেকে তার মনে হয়েছে, নেহেরু ও আমার মা কতোটা গভীরভাবে পরস্পরকে ভালোবাসতেন এবং সম্মান করতেন। মা পণ্ডিতজির মধ্যে সাহচর্য এবং আত্মার সমতা খুঁজে পেয়েছিলেন, যা তিনি চেয়েছিলেন।
তবে নেহেরু ও এডুইনার মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক কী রকম ছিল? নিছকই বিমূর্ত ভালোবাসা ছিল? এর স্পষ্ট উত্তর দিয়ে পামেলা লিখেছেন, আমার মা ও পণ্ডিতজির মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক তৈরির কোনো সুযোগ ছিল না। তারা দু’জনে একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ পাননি; বরং সব সময় তাদের ঘিরে থাকতো কর্মচারী, পুলিশ ও অন্যরা।
লর্ড মাউন্টব্যাটন ১৯৪৮ সালের জুনে ভারত ত্যাগ করার সময় নেহেরু ও এডুইনার মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল তাও পামেলার বই থেকে জানা যায়। পামেলার ভাষ্য অনুযায়ী, এডুইনা ভালোবাসার উপহার হিসেবে নেহেরুকে একটি পান্নার আংটি দেয়ার মনস্থ করেছিলেন। কিন্তু নেহেরু তা গ্রহণ করবেন না বুঝতে পেরে সেই আংটিটি নেহেরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে দিয়ে গিয়েছিলেন। নেহেরুও এডুইনার স্থায়ীভাবে চলে যাওয়া নিয়ে এক আবেগঘন বিদায়ী ভাষণে বলেছিলেন, তুমি যেখানে গিয়েছো সেখান থেকে তুমি নিয়ে এসেছো সান্ত্বনা, নিয়ে এসেছো আশা ও উৎসাহ। নেহেরু বলেছেন, অতএব, এটা কী আশ্চর্যের যে, ভারতের মানুষ তোমাকে ভালোবাসবে এবং তাদেরই একজন হিসেবে মনে করে তোমার চলে যাওয়ায় বিষাদগ্রস্ত হবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ৮০ বছর পরে ব্যক্তিগত এইসব চিঠি নিয়ে অকারণ আগ্রহ জাগিয়ে তোলা হচ্ছে। পরিবারের আপত্তি থাকলে কেন চাপ দেয়া হচ্ছে? অনেকের মতে, কী গোপনীয়তা রয়েছে সেই চিঠিগুলোতে যে পরিবারের পক্ষ থেকে তা প্রকাশ্যে আনা হচ্ছে না?
পর্যবেক্ষকদের মতে, ভারতের এক সংকটময় রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে আলোকপাত হতে পারে নেহেরুর লেখা চিঠিগুলো থেকে, এটা হয়তো ঠিক। কিন্তু ব্যাক্তিগত বলয়ে প্রবেশ করার অধিকার কি রয়েছে? বিশেষ করে আজ যেখানে নেহেরুর পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ নেই।
আসলে নেহেরুর মতাদর্শের চরম বিরোধী বিজেপি চিঠিগুলোর বিষয়বস্তু প্রকাশ নিয়ে যেভাবে সোচ্চার হয়েছে তাতে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিজেপি নেতারা নেহেরু ও এডুইনার সম্পর্কের রসায়ন নিয়ে চর্চাতেই বেশি আগ্রহী কেন? নতুন করে কেচ্ছা ছড়িয়ে কংগ্রেসকে অস্বস্তিতে ফেলাই কি তাদের গোপন কৌশল?