অ র্থ নী তি

অর্থনীতির শ্বেতপত্র কাজ করবে কীভাবে?

এম এম মাসুদ | এক্সক্লুসিভ
জানুয়ারী ১৮, ২০২৫
অর্থনীতির শ্বেতপত্র  কাজ করবে কীভাবে?

পতিত শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা নিয়ে সরকারের দেয়া তথ্য-উপাত্তের সঙ্গে ভিন্নমত ছিল বিশ্লেষক ও বিরোধীদের। আওয়ামী লীগ সরকারের দেয়া তথ্য, বক্তব্য ও পরিসংখ্যানে দেশের অর্থনীতির সঠিক চিত্র বা প্রতিফলন ছিল না বলে তাদের অভিযোগ। এমন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের অর্থনীতির প্রকৃত চিত্র জানতে গত ২৮শে আগস্ট একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। ১২ সদস্যের স্বাধীন বিশেষজ্ঞ দলের তৈরি শ্বেতপত্রটি গত ১লা ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কমিটি দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে তাদের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি করে। পরের দিন মিডিয়ার সামনে বিস্তারিত তুলে ধরেন শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। 


সংবাদ সম্মেলনে কমিটি জানায়, দেশে গত ১৫ বছরে ‘চামচা পুঁজিবাদ থেকেই চোরতন্ত্র’ তৈরি হয়েছিল, যাতে রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগসহ সবাই অংশ নিয়েছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে- এমনটা বলা হচ্ছে শ্বেতপত্রে।
শ্বেতপত্রে অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা তুলে ধরা হয়। এতে নব্য ধনীদের উত্থান, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মিথ্যা বিবরণ দিতে ভুল তথ্য ও ব্যাপকহারে অর্থ পাচারের মতো বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। শ্বেতপত্র কমিটি ৬১৮ বার বৈঠক করে। অংশীদারদের সঙ্গে ৬০ বার পরামর্শ করা হয়েছে। ২২টি নীতি-ভিত্তিক পরামর্শ, ১৭টি কারিগরি পরামর্শ, তথ্যদাতাদের সাক্ষাৎকার ও ঢাকার বাইরে তিনটি গণশুনানি করা হয়। 


অনিয়ম চিহ্নিত: 
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বছরের পর বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা সব বিষয় তুলে ধরতে এমন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কারণ দেশবাসী ও অন্তর্বর্তী সরকারের আনুষ্ঠানিক নথির প্রয়োজন ছিল। পুরো ব্যবস্থাটিকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছিল। দেশে শক্তিশালী অর্থনীতির আখ্যান দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল না। এ কারণেই শ্বেতপত্র প্রকাশের কথা ভাবা হয়। সরকার অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে যেসব সংকটে পড়বে তা চিহ্নিত করা হয়েছে শ্বেতপত্রে। তিনি বলেন, বছরের পর বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা সব বিষয় তুলে ধরতে এমন কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। কারণ দেশবাসী ও অন্তর্বর্তী সরকারের আনুষ্ঠানিক নথির প্রয়োজন ছিল। পুরো ব্যবস্থাটিকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছিল। দেশে শক্তিশালী অর্থনীতির আখ্যান দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল না। এ কারণেই শ্বেতপত্র প্রকাশের কথা ভাবা হয়। সরকার অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে যেসব সংকটে পড়বে তা চিহ্নিত করা হয়েছে শ্বেতপত্রে।


এর আগেও শ্বেতপত্র প্রকাশ হয়েছে: বাংলাদেশে শ্বেতপত্র প্রকাশের ঘটনা এবারই প্রথম নয়। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ২০০১ সালে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। তাতে আওয়ামী লীগ সরকারের আগের মেয়াদের বিভিন্ন অসঙ্গতির কথা তুলে ধরা হয়।


শ্বেতপত্র কী এবং কী কাজে আসবে?
শ্বেতপত্র তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, শ্বেতপত্র এসেছে বৃটিশ ঐতিহ্য থেকে। বৃটিশ পার্লামেন্ট থেকে। যখন এমন পরিস্থিতি দেখা দেয় যার কোনো তাৎক্ষণিক বা সুস্পষ্ট সমাধান নেই, তখন বিশেষজ্ঞরা সমস্যাটি বিশ্লেষণ করে মতামত দেন। শ্বেতপত্রের সুবিধা হলো যে, এটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সংসদ বা সরকারের নির্দেশে হয়ে থাকে। কিন্তু যারা কমিটিতে থাকেন তারা স্বাধীনভাবে শ্বেতপত্র তৈরি করেন। শ্বেতপত্র কমিটি গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) প্রতিবেদন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করেছে বলে জানিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির অবমূল্যায়ন করায় আমরা মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানও দেখেছি। দেশি-বিদেশি ঋণের বোঝাও খতিয়ে দেখেছি। এই শ্বেতপত্র তৈরিতে পরামর্শক খরচ বাবদ প্রায় ২৫ লাখ ডলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে একটি টাকাও নেয়া হয়নি। 


দুর্নীতির মাত্রা, শ্বেতপত্রে চাঞ্চল্যকর তথ্য: শ্বেতপত্রের তথ্য বলছে, শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার অর্থ তছরুপ ও অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে মেগা প্রকল্পগুলোতে। ১৫ বছরে প্রকল্পের খরচ গড়ে ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং প্রকল্পগুলো শেষ করতে গড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় লেগেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)-এর মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ৬০ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার (১.৬১ থেকে ২.৮০ লাখ কোটি টাকা) রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাজেট বাড়ানোর মতো বিভিন্ন দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব ব্যাংকিং খাতের সংকটকে গভীর করেছে। বিগত ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে যে মন্দ ঋণ তৈরি হয়েছে, তা দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল বা ২৪টি পদ্মা সেতু করা যেত। ধারাবাহিক ঋণ খেলাপির ঘটনা এবং বড় ধরনের কেলেঙ্কারিগুলো আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতাকে ধ্বংস করেছে এবং উৎপাদনশীল খাত থেকে পুঁজি অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে গেছে বলেও শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে। এ ছাড়া অভিবাসন খাতে গত এক দশকে প্রায় সাড়ে তের লাখ কোটি টাকা সরানো হয়েছে হুন্ডিতে লেনদেনের মাধ্যমে। মূলত রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমে ভিসা ক্রয়ের নামে এ টাকা বিদেশে গেছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়, এ টাকা মতিঝিল-উত্তরা রুটের মেট্রোরেল নির্মাণ খরচের চারগুণ। সিন্ডিকেট ও অনৈতিক রিক্রুটমেন্ট চর্চার কারণে সত্যিকার অভিবাসী কর্মীরা ক্ষতির শিকার হয়েছে এবং দেশ রেমিট্যান্স থেকে বঞ্চিত হয়েছে। 


কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তারা ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বড় প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখেছেন প্রতিটিতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। ২৯টি বড় প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। পরীক্ষা করা সাতটি প্রকল্পের আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে, জমির দাম বেশি দেখিয়ে এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে হেরফের করে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত করে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। ব্যয়ের সুবিধা বিশ্লেষণ না করেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ছাড়া এবং বেআইনিভাবে অপরাধকে রেহাই দেয়া ছাড়া এই বিশাল লুটপাট মোটেও সম্ভব ছিল না। 


হেলথ চেক আপ: অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে কেমন অর্থনৈতিক অবস্থা পেলো সেটি বুঝতে অর্থনীতির একটা ‘হেলথ চেক আপ’-এর কথা বলেছেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য জাহিদ হোসেন। বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক এই প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, বর্তমানে অর্থনীতি কোন অবস্থায় আছে, উত্তরাধিকার সূত্রে কী পাওয়া গেছে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কীভাবে চলছে সেগুলোকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। এটা স্বাস্থ্য পরীক্ষার মতো।


দুর্নীতির রূপ: ব্যাংক লোন নিয়ে দুর্নীতি। বলপ্রয়োগ করে ব্যাংক দখল করে দুর্নীতি। অবৈধ পন্থায় অর্জিত কালো টাকা বিদেশে পাচার। রাজনৈতিক সুবিধার বশবর্তী হয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প অনুমোদন করে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ও দুর্নীতি। প্রকল্প ব্যয় বেশি দেখিয়ে দুর্নীতি। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর নির্ধারিত ব্যয়ের বেশি ব্যয় পুনঃপ্রাক্কলনের মাধ্যমে। কর্মচারী ও প্রশাসক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি। জমি-স্থাবর সম্পদ অন্যায়ভাবে জোর করে দখল করার দুর্নীতি। সরকারি প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি। অতিমূল্যায়িত কন্ট্রাক্ট বা টেন্ডার বিতরণে দুর্নীতি। প্রকল্পের ব্যবহার্য সম্পদের অনৈতিক অন্যত্র ব্যবহার করে দুর্নীতি। ঘুষের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বদলের দুর্নীতি। জনতহবিলের অর্থ অপ-খাতে ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি। ধনীদের অন্যায়ভাবে কর অব্যাহতি দান করে দুর্নীতি। সরকারের ভেতরের খবর বাইরের স্বার্থে গোপনে বাইরের শক্তিকে জানিয়ে দেয়ার মাধ্যমে দুর্নীতি। বাজারের সাপ্লাই চেইনে দুর্নীতি। চাঁদাবাজির দুর্নীতি। স্বার্থসংশ্লিষ্ট শ্রেণি ও গ্রুপগুলোর জোট বেঁধে  দুর্নীতি। একচেটিয়া পুঁজির দুর্নীতি। ইচ্ছাকৃতভাবে দেরি করে দুর্নীতি। কমিশন। রাজনৈতিক সমপ্রীতি। আইন ও নীতি প্রণয়নে দুর্নীতি।


সরকারকে কী করতে হবে:
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার বিস্তারিত বিবরণ জনগণের সামনে প্রকাশ করা উচিত। ন্যূনতম দু’বছর মেয়াদি পরিকল্পনা হওয়া উচিত। মধ্যমেয়াদি এই পরিকল্পনা দ্রুত হওয়া দরকার। বলা হয়, ‘জরুরিভাবে আমাদের সমগ্র ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন, যাতে সর্বত্র শক্তিশালী জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা হবে, সততা ফিরে আসবে এবং অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তৈরি হবে। দুর্নীতির চক্র ভেঙে দিতে হবে।’


ড. দেবপ্রিয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে ড. ইউনূস বলেছেন,  শ্বেতপত্রটি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত, যেন তারা এখান থেকে শিক্ষা লাভ করতে পারে। এটা ঐতিহাসিক দলিল। এখান থেকে জুলাই অভ্যুত্থানের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা বের করা যাবে। 


করণীয়: শ্বেতপত্র অনুযায়ী বর্তমান ও আগামী সরকারকে স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ শুরু করেছেন, যা কিছুটা দৃশ্যমান। পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে কার্যক্রম কাজ চলমান। পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে এই কাজের ধারাবাহিকতা চালিয়ে যেতে হবে। ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করে গ্রাহকদের আমানতের নিশ্চয়তা সরকারকে দিতে হবে। ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ করা উচিত। ব্যবসা বাঁচলে অর্থনীতি বাঁচবে। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে। বেকার সমস্যার সমাধান হবে। সরকারের হাত মজবুত হবে।


শ্বেতপত্র কী কাজে আসবে?
কমিটির সদস্য মোহাম্মদ ড. আবু ইউসুফ জানান, শ্বেতপত্রে প্রতিটা অধ্যায়ে উন্নয়নের অন্তরায়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এতে সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হলো- স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি রুটিন তৈরি করে দ্রুত বাস্তবায়ন শুরু করা। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার দ্রুত শুরু করা উচিত। পাশাপাশি সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর