সা ফ ক থা

ন্যারেটিভের ন্যারেটিভ

মোজাম্মেল হোসেন | এক্সক্লুসিভ
ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৫
ন্যারেটিভের ন্যারেটিভ

শেখ হাসিনার সরকার ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে চলে যাওয়ার পর সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন জনের রাজনৈতিক আলোচনা, বিশ্লেষণ, টকশোর বক্তব্যে ‘ন্যারেটিভ’ শব্দটি পড়তে পড়তে ক্লান্ত ও শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। একটি দৃষ্টান্ত আমি আমার কম্পিউটারে কপি করে রেখে দিয়েছিলাম। এ দেশে সাংবাদিকতা করতে করতে পাকিস্তানে প্রবাসী হয়ে শিক্ষকতার পেশা নেয়া আমাদের পরিচিত এক বাঙালি মেধাবী যুবকের জুলাই-উত্তর গত অক্টোবরের একটি ফেসবুক পোস্টে ৯৩৯ শব্দের লেখায় ১২ বার ন্যারেটিভ শব্দটি এসেছে। বিদেশে নয়, ঢাকায় থাকা এক জনপ্রিয় ইউটিউবারের প্রতিদিন এক বা একাধিক ভিডিওতে  প্রায়শ পৌনঃপুনিক  ন্যারেটিভ শব্দটি ঝংকৃত হতে শোনা যায়। 


প্রথমে ইংরেজি এই শব্দটির অর্থ একটু বুঝে নেয়া যাক। ইংরেজিতে ‘ন্যারেশন’ অর্থ বিবরণ বা বর্ণনা। নাউন বা বিশেষ্য পদ। কোনো ঘটনা, স্থান বা ব্যক্তি সম্পর্কে বিবরণ। এর ক্রিয়া বোঝাতে বর্ণনা করা বা বিবরণ দেয়া বলতে হয়। অর্থাৎ বাংলায় সহায়ক ক্রিয়াপদ প্রয়োজন হচ্ছে। তবে একই অর্থে ‘বলা’ ও ‘কহা’ বা কওয়া ক্রিয়াপদ আছে, সেখানে সহায়ক লাগছে না। ইংরেজিতে এই ক্রিয়াপদ বা ভার্ব হচ্ছে ‘টু ন্যারেট’। স্কুলে ব্যাকরণ পড়ার সময় আমরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বা ডাইরেক্ট ও ইনডাইরেক্ট ন্যারেশন  পেয়েছি, যে আলোচনায় যাওয়ার এখানে কোনো প্রয়োজনই নেই। 
আমাদের বিষয় হচ্ছে ‘ন্যারেটিভ’। এটি বিশেষ্য ও বিশেষণ বা অ্যাডজেকটিভ দুটোই। ন্যারেটিভের একটা গভীরতা আছে। সাধারণ ন্যারেশন হচ্ছে যা দেখলাম বা শুনলাম বা জানলাম তার বস্তুগত বিবরণ। এর দীর্ঘস্থায়ী রেশ থাকে না। এটা সংবাদের মতো। আর ন্যারেটিভ হচ্ছে গল্পের মতো, যা ধারাবাহিকভাবে এবং সম্পর্কযুক্ত বা প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়সহ একটা পরিণতি নির্দেশ করে বর্ণনা করা হয়। এটা শ্রোতার মনে স্থায়ী রেখাপাত করে ও ধারণার জন্ম দেয়। ইংরেজিতে ‘ন্যারেটিভ পোয়েট্রি’ যখন বলা হয় তখন পোয়েট্রি হচ্ছে বিশেষ্য ও ন্যারেটিভ হচ্ছে বিশেষণ। অর্থাৎ যে কাব্যে কাহিনী বলা হয়। বাংলায় আমরা ন্যারেটিভকে বলবো ‘আখ্যান’ বা ‘বয়ান’। আখ্যান গল্পই, তবে আমাদের বর্তমান অলোচনা প্রসঙ্গে কাল্পনিক স্থান-পাত্র নিয়ে গল্প নয় বরং বাস্তব ঘটনা ও চরিত্রের যুক্তি ও ব্যাখ্যাসহ বর্ণনা। এই বর্ণনায় ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ যুক্ত হয়। সেটাকেই ন্যারেটিভ বলে। বাংলায় বিদেশি ভাষার উৎস থেকে গৃহীত বয়ান শব্দটির একটি ধর্মীয় ভাব আছে। মসজিদে জামাতে নামাজের আগে ইমামের কথা, তাবলীগ ও ইজতেমায় আলেমদের আলোচনাকে বয়ান বলা হচ্ছে। 


এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্রনায়করা ও সমর্থক রাজনীতিবিদ ও আলোচকরা ক্রমাগত অভিযোগ করে চলেছেন যে, আওয়ামী লীগ ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের নিজস্ব দলীয় ন্যারেটিভ তৈরি করেছে যা তাদের মতে সত্য নয়। তাদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ ও তাদের রাজনৈতিক মিত্ররা ওই ন্যারেটিভকে দেশে স্বৈরতন্ত্র তথা তাদের ভাষায় ‘ফ্যাসিবাদ’ কায়েম করার জন্য ব্যবহার করেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসের এই আওয়ামী ন্যারেটিভ হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একক ও সর্বৈব নেতা, জামায়াতে ইসলামী ও এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ, পরে ইসলামী ছাত্রশিবির পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগী হয়ে ওই বাহিনীর মতোই যুদ্ধাপরাধ করেছে, ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করে আমাদের স্থায়ী মিত্র হয়েছে, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তিতে বিভক্ত হয়ে রয়েছে ইত্যাদি। 


ইতিহাসের ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। বিভিন্ন সময়েও কোনো ব্যাখ্যার প্রাধান্য সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও হয়েছে। তবে শর্ত হচ্ছে, সকলেরই ব্যাখ্যা তথ্যভিত্তিক হতে হবে। তথ্যকে অস্বীকার করে ব্যাখ্যা দিলে বা ন্যারেটিভ নির্মাণ করলে তা শুরুতেই প্রত্যাখ্যাত হবে, গ্রহণযোগ্য হবে না। ব্যাখ্যাগুলোও ইতিহাসে গ্রহণ-বর্জনের মধ্যদিয়ে এক সময় সর্বজনগ্রাহ্য হয়। কিন্তু প্রমাণিত তথ্যকে বাদ দিয়ে কোনো গল্প নির্মাণ করতে চাইলে তা অসৎ বলে পরিত্যাজ্য হবে। 


ইতিহাসের ব্যাখ্যা বা ভিন্ন দৃষ্টিকোণের ভিন্ন ন্যারেটিভ নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কও চলতে পারে এবং তা চলতি রাজনীতিকে প্রবলভাবে বা ধ্বংসাত্মকভাবে প্রভাবিত না করে বিদ্যায়তনিক তথা একাডেমিক স্তরে থেকে যেতে পারে। যেমন, বৃটিশ উপনিবেশ থেকে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় দেশভাগ বা পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য কোন্‌্‌ রাজনৈতিক শক্তির দায়দায়িত্ব বেশি- মুসলিম লীগ না কংগ্রেসের না হিন্দু মহাসভা ধরনের উগ্রবাদীদের? এ নিয়ে গবেষণা ও বিতর্ক চলছেই। অথবা, বৃটিশ উপনিবেশবাদীরা ভারত দখল করায় আমরা ইউরোপীয় রেনেসাঁর চিন্তা-চেতনায় সভ্য হতে পেরেছি, নইলে হতাম না; এর বিপরীতে বলা হয়, ভারতে অতি প্রাচীনকালেই উন্নত সভ্যতা ছিল, বৃটিশরা না এলে আমাদের নিজস্ব ধারায় আমরা উন্নত হতাম- এই ধারার বিতর্ক গভীরে চলমান রয়েছে। যার যার মতের পক্ষে তথ্য হাজির করতে হবে। পরস্পরে হাতাহাতি নয়। 


তবে ইতিহাসের ব্যাখ্যা ও ন্যারেটিভের বিতর্ককে অনেক সময় হাতাহাতি ও রাজনৈতিক সংঘাতের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। চলমান দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার মূল্যায়ন, তিনি কি একক নেতা না আরও নেতার ভূমিকা আছে, তার যোগ্য সহকর্মীদের আমরা কোথায় রাখবো, তিনি ৭ই মার্চ একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে সঠিক কাজ না ভুল করেছিলেন, ২৫শে মার্চ পালিয়ে যুদ্ধে যোগ না দিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া কি সঠিক ছিল, তিনি কি স্বাধীনতা না চেয়ে আপসে অখণ্ড পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোভে পড়েছিলেন, তার বাকশাল গঠন কি দেশকে জনস্বার্থে তার ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ নামাঙ্কিত আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য না-কি একদলীয় ফ্যাসিবাদ কায়েমের জন্য? এইসব নিয়ে বিতর্ক বা পাল্টাপাল্টি ন্যারেটিভের সুযোগ না দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাধররা একতরফা নিজেদের ন্যারেটিভে তার ছবি নামিয়ে, ভাস্কর্য ভেঙে, এমনকি বাড়ি ও জাতীয় ইতিহাসের স্মৃতি জাদুঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
আওয়ামী লীগ যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার একক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছে, যে-পটভূমিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বিতর্কে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে গুণ্ডামি করে দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, তার সংশোধন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তর্ক-বিতর্কে, আদালত ও সংসদের মাধ্যমে একদিন সমাধান হতে পারতো গণতন্ত্রকে সুযোগ দিলে। গণতন্ত্রের পথে আওয়ামী লীগেরও সংশোধন হতো। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে যেভাবে আওয়ামী লীগ জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে ঘোষণা দিয়ে বাকশাল পদ্ধতি পরিত্যাগ করে জনগণের দরবারে হাজির হয়েছিল। কিন্তু এখন বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার আসন থেকেই টেনে নামানো হচ্ছে। 


একটি প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। মানুষ ফেরেশতা নয়। ভুল-ত্রুটি সবারই কম-বেশি হয়। মৌলিক ও সার্বিক অবদান দিয়েই ব্যক্তিকে বিচার করতে হয়। ভারতে মহাত্মা গান্ধীর রাজনীতির প্রবল সমালোচনা করার অধিকার নাগরিকদের আছে। এমনকি তার নারী-সংক্রান্ত চরিত্রের সমালোচনা করে প্যামফ্লেট ও বই প্রকাশিত হয়। নিষিদ্ধ হয় না। তার হত্যাকারীর প্রশংসা করার মানুষও আছে, যাদের জেল-ফাঁসি হয় না। কিন্তু কংগ্রেস, বিজেপি, জনতা পার্টি, কমিউনিস্ট পার্টি, হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রভৃতি রাজনৈতিক সকল কিসিমের দল ও সংগঠন মহাত্মাকে জাতির পিতা মানে, তার বহিঃপ্রকাশ কম-বেশি যা-ই হোক। বঙ্গবন্ধুর মতো তার মহাত্মা পদবি নিয়ে টানাহেঁচড়া করে না। আমেরিকায় রাজনৈতিক বিরোধ ও প্রতিযোগিতা আছে, কিন্তু ‘ফাউন্ডিং ফাদার্স’ অভিহিত প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাদের কারও সম্মানহানি করে কেউ জঙ্গি লম্ফ দেয় না। এটাই জাতীয় ঐক্য, এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এটা আমাদের জাতি অর্জন করেনি।


সব রাজনৈতিক গোষ্ঠীই নিজস্ব ন্যারেটিভ দিয়ে জনগণের মনকে আচ্ছন্ন করে নিজস্ব রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের দিকে এগোতে চায়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতাকেন্দ্রে যারা বলশালী তারা পুরানা ন্যারেটিভ ও আওয়ামী ন্যারেটিভকে আক্রমণ করছেন এই বলে যে সেগুলো ‘ফ্যাসিবাদের উৎস’। কিন্তু তারা যে পাল্টা ন্যারেটিভ দাঁড় করাতে চাচ্ছেন তা কথিত ফ্যাসিবাদ তথা আওয়ামী স্বৈরতন্ত্রের চেয়েও বেশি আক্রমণ হানছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ফসল ১৯৭২ সালে প্রবর্তিত রাষ্ট্রের সংবিধান, জয় বাংলা ধ্বনি প্রভৃতির বিরুদ্ধে। এবং জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও পছন্দ প্রকাশ পাওয়ার আগেই বাস্তব আক্রমণ হেনে ইতিহাসের ঐ অধ্যায়ের চিহ্ন ও প্রতীক সব মুছে ফেলতে চাইছে। 


নতুন ন্যারেটিভ তৈরির চেষ্টা লক্ষণীয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেন হয়েছিল? হাসিনার শাসন উৎখাতের আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রনেতা, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. ইউনূসের বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমের ২রা ও ৩রা অক্টোবর ২০২৪ দুু’দিনব্যাপী একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার ‘প্রথম আলো’য় প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে তিনি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলেন, ‘১৯৭১ হয়েছিল বাঙালি মুসলমান সমপ্রদায়ের দু’টি বোঝাপড়া থেকে। ১৯৪৭ সালের আগপর্যন্ত ইসলামের সঙ্গে তার যে বোঝাপড়া ছিল, সেটা বদলে গিয়েছিল। তারা বুঝতে শুরু করলো, বাংলার ইসলাম পাকিস্তানের ইসলামের সঙ্গে যায় না, এমনকি উত্তর ভারতের ইসলামের সঙ্গেও নয়। ফলে তারা পাকিস্তানি ইসলামের বিরুদ্ধে দাঁড়ালো।’


এই নতুন ন্যারেটিভ বলছে যে, পাকিস্তানি শাসকদের নির্মম শোষণ এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্য, গণতন্ত্র,  স্বায়ত্তশাসন ও জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ আকাঙ্ক্ষা থেকে সৃষ্ট জাতীয়তাবাদ, পূর্ব বাংলার মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী নির্বিশেষে এবং বাঙালি, চাকমা-মারমা প্রভৃতি সকল জাতিসত্তার ঐক্যবদ্ধ লড়াই ও সেই আকাঙ্ক্ষাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দেয়ার জন্য ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা শুরুর জবাবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, বা সেটা মুক্তিযুদ্ধও নয়, ‘১৯৭১’ ছিল শুধু বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যাপার এবং ‘বাংলার ইসলাম’ ও ‘পাকিস্তানের ইসলামের’ দ্বন্দ্ব। এই ন্যারেটিভ কার পক্ষে হজম করা সম্ভব?
এই মর্মে ন্যারেটিভ দাঁড় করানোর চেষ্টা প্রায়ই দেখা যায় যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহায়তা ছিল ভারতের স্বার্থে এবং প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র। এ কথা জুলাই অভ্যুত্থানের অনেক আগেও বলা হতো। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ায় ভারতের রাষ্ট্রীয় লাভ হতেই পারে। এটা অসঙ্গত কিছু নয়। তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শেষভাগে পাক-ভারত যুদ্ধটা শুরু করেছিল পাকিস্তান। এবং ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ বললে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অপমান করা হয়। এগুলোই হচ্ছে ন্যারেটিভের মারপ্যাঁচ। 


২০২৪-এর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবসের রাতে মাহফুজ আলম তার একটি ফেসবুক পোস্টে ভারতীয় কিছু অঞ্চলসহ বাংলাদেশ নিয়ে মানচিত্র প্রকাশ করে আসমুদ্র হিমাচল কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রের স্বপ্নকল্প তুলে ধরেন। তবে কয়েক ঘণ্টা পরে তিনি সেটি মুছে দেন। তার মধ্যেই বহু মানুষের চোখ কপালে ওঠা ছাড়া ভারত সরকারও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। ড. ইউনূসের সরকার ওই পোস্টকে মাহফুজ আলমের ব্যক্তিগত মতামত বলে জানায়। মাহফুজ পিছিয়ে গেলেও এটা কোনো নতুন ন্যারেটিভ তৈরির সূচনা কি-না তা ভাবা যেতেই পারে। 
ন্যারেটিভের পর্যায়ে পড়ে না, তবে জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান ৯ই অক্টোবর ২০২৪ সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত তার দলের প্রস্তাব তুলে ধরার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “১৯৭২ সালে প্রবর্তিত দেশের সংবিধানের জন্ম হয়েছে ভারতের মাটিতে বসে। সেটা পার্লামেন্টে এনে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। সংবিধানটি ফরমায়েশি।”
এর চেয়ে বড় মিথ্যাচার কিছু হওয়া সম্ভব কিনা তা জীবিত সকল নাগরিক ও ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন। ১৯৭০ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলোর নির্বাচনে জয়ী পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল ১৯৭২ সালে। ড. কামাল হোসেনকে প্রধান করে গঠিত ৩৪ সদস্যের খসড়া প্রণয়ন কমিটি প্রচুর পরিশ্রম করে, নানা দেশের সংবিধান পর্যালোচনা ও চুলচেরা আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক করে খসড়া রচনা করার পর গণপরিষদে বিতর্কের পরে তা বিল আকারে পাস হয় ও সংবিধান বলবৎ হয়। বর্তমান সরকারের আইন উপদেষ্টা প্রফেসর আসিফ নজরুল ২০২২ সালে প্রকাশিত তার বহুল সমাদৃত ‘সংবিধান বিতর্ক ১৯৭২ : গণপরিষদের রাষ্ট্রভাবনা’ গবেষণাগ্রন্থে এইসব আলোচনার বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। ওই আলোচনা ও বিতর্কেও সারাংশ নিয়ে গ্রন্থিত দুই খণ্ডের কার্যবিবরণীর উল্লেখ করে আসিফ নজরুল লেখেন,  “এসব কার্যবিবরণী ও প্রতিবেদন হচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধানের ভিত্তিমূল দলিল।... গণপরিষদ দলিলের পাতায় পাতায় উদ্ধৃত আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের  নেতাদের ইতিহাসবোধ আর রাষ্ট্রভাবনা।...এর কিছুটা অংশ পড়েই আমি গণপরিষদের সদস্যদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং নিষ্ঠার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়ে পড়ি।’’ বইটির প্রথম অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন, ‘‘১০ই এপ্রিল ১৯৭২ সাল ছিল বাংলাদেশের জন্য অনন্য একটি দিন। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে দেশকে স্বাধীন করার পর বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিরা এদিন প্রথমবারের মতো একত্র হয়েছিলেন দেশের সংবিধান রচনার জন্য। ১৯৬৬ সালে ৬-দফার মাধ্যমে গণতন্ত্র, আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার ও শোষণমুক্তির কর্মসূচি দিয়ে সারা  দেশের মানুষকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তারই নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার প্রচেষ্টার শুরু ছিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনের এই দিনটি।...গণপরিষদের এই বিতর্কের ফল হিসেবে আমরা ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর স্বাধীন দেশের একটি সংবিধান পাই। তখনকার ভূরাজনীতি বিচারে এটি ছিল অনেকাংশে উন্নত সংবিধান, এখনকার সময়ের বিচারেও ১৯৭২ সালের সংবিধানই বাংলাদেশের সেরা সংবিধান।’’


আওয়ামী লীগ-বিরোধী আরেক আইনজীবী, সাবেক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী ও উপ-রাষ্ট্রপতি মরহুম মওদুদ আহমেদের ইংরেজিতে লিখিত ‘বাংলাদেশ: কনস্টিটিউশনাল কুয়েস্ট ফর অটনমি’ বইটিও এ ব্যাপারে আলো দেবে। 
জামায়াত আমীরের মূর্খতা ও দুরভিসন্ধি থেকে বুঝতে পারা যাবে বর্তমানে এক শ্রেণির লোকের আলোচনায় কেন ন্যারেটিভ ন্যারেটিভ নিয়ে এত উচ্চকণ্ঠ চিৎকার। 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর