আলোচিত টকশো

কোনো দল নির্বাচন বর্জন করলে সে দলের জন্য সুইসাইডাল হবে

পিয়াস সরকার | এক্সক্লুসিভ
নভেম্বর ৮, ২০২৫
কোনো দল নির্বাচন বর্জন করলে সে দলের জন্য সুইসাইডাল হবে

অন্তর্বর্তী সরকারের এই সময়কালেও সরকারবহির্ভূত বিভিন্ন গোষ্ঠী দ্বারা আমরা আক্রান্ত হয়েছি বলে মন্তব্য করেছেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি আরও বলেন, কোনো সরকার কোনো অবস্থাতে সংবাদপত্র শিল্পকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেনি। নির্বাচনের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোনো দল নির্বাচন বর্জন করলে সে দলের জন্য সুইসাইডাল হবে। বহুমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হবে। চ্যানেল আই-এর নিয়মিত আয়োজন ‘আজকের সংবাদপত্র’ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। ৪ঠা নভেম্বর ছিল পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনেই তিনি এই আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন। সঞ্চালনায় ছিলেন মানবজমিন প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী। বাংলাদেশের টেলিভিশন টকশো’র ইতিহাসে এটি একটি ব্যতিক্রমী আয়োজন। বিশেষত যখন মুখোমুখি বসেন দুই আলোচিত সম্পাদক। একজন মতিউর রহমান চৌধুরীর মুখোমুখি আলাপচারিতায় আরেকজন মতিউর রহমান বলেন রাষ্ট্র, সরকার, সাংবাদিকতা ও দেশকাল নিয়ে। সেই সাক্ষাৎকারে উঠে আসে গুরুত্বপূর্ণ নানা আলোচিত ইস্যু। 


প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, প্রথম আলো ২৭ বছর অতিক্রম করেছে। ১৯৯৮ সালে যখন শুরু হয় তখন আমরা কয়েকটি লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলাম। আমাদের তৎকালীন চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানসহ আমরা ঠিক করেছিলাম এই পত্রিকাটাকে দলনিরপেক্ষ স্বাধীন পত্রিকা হিসেবে দাঁড় করাবো। সত্য কথা বলবো। ২৭ বছর পরে এসে আমরা বলতে পারি, যে লক্ষ্য নিয়ে কাগজটা শুরু করেছিলাম সেখানে আমরা দৃঢ় ছিলাম। সত্যের প্রতি আমরা বিশ্বস্ত ছিলাম। সত্য কথা বলার চেষ্টা করেছি। আমরা এটা বলবো যে, সবসময় সব আমলে সব সরকারের সময় আমরা সব সত্য কথা বলতে পেরেছি তা নয়। বিশেষ করে বিগত ১৬ বছর স্বৈরাচারী সরকারের আমলে আমরা অনেক সত্য কথা বলতে পারিনি এবং যতটুকু বলার চেষ্টা করেছি তাতে করে আমাদেরকে যথেষ্ট চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। আমাদের প্রচার সংখ্যা কমিয়ে দেয়ার বহু চেষ্টা হয়েছে। আমাদের সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এমনকি ব্যক্তি খাতের বিজ্ঞাপন, প্রায় ৫০টি কোম্পানির বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সর্বশেষ সাবেক প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন যে, প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, দেশের শত্রু।
মতিউর রহমান বলেন, সরকার চেষ্টা করেছিলেন প্রথম আলো’র মালিকানা কেড়ে নিতে। সরকার চেষ্টা করেছিলেন সম্পাদককে বদল করে দিতে। এসব অবস্থার মধ্যে গিয়েও আমরা টিকে আছি। কিন্তু শেখ হাসিনাকে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এর পেছনে শক্তি, ওই সত্য। আমরা সত্য কথা বলার চেষ্টা করেছি এবং সত্য বললে আপনি টিকবেন। আপনি চলতে পারবেন। আমাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলা হয়েছে। এখনো সে মামলাগুলো রয়েছে। কোনো মামলাতে কিন্তু আমাদেরকে অপরাধী হিসেবে শাস্তি দিতে পারেনি। কারণ আমাদের তথ্য খবর সংবাদ সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। তো সেজন্য বলি, আমরা সত্য কথা বলি। এখন আমরা বলছি, সত্যই সাহস।


আজকের দুনিয়াতে যদি দেখেন ভারত, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সংবাদপত্র, টেলিভিশনগুলোকে চাপের মুখে, ভয়ের মুখে থাকতে হয়। অনেকে বদলে যাচ্ছে। আপনি জানেন যে, ভারতে এনডিটিভি’র মতো একটা টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা বদল করতে হলো, আদানি গ্রুপ সেটাকে নিয়ে নিলো। এ ধরনের সমস্যা তো আছেই। আপনি বলতে পারেন যে, সবসময় কি সব সত্য বলতে পারেন? আমি বলবো আমাদের কোনো সমস্যার সুরাহা হয় না। সেদিক থেকে সত্যিকার অর্থে সংবাদপত্র শিল্প সেটা প্রিন্ট বলেন, ডিজিটাল বলেন, একটা সংকটের মধ্যে আমরা আছি। একটা চ্যালেঞ্জের মুখে আমরা পড়ে গেছি এর থেকে আমাদের সম্মিলিতভাবে বের হতে হবে। সারা দুনিয়ায় এগুলো নিয়ে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু কেউ খুব সন্তুষ্ট না এখন পর্যন্ত যে, সঠিক পথটি তারা বের করতে পেরেছেন। হ্যাঁ, নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান বা ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস তারা অনেক অগ্রগতি করেছে। তাদের সে শক্তি, ক্ষমতা, অর্থ আছে। আমাদের তো সেটারও অভাব। আমাদের তো এই নলেজ, এই চিন্তা, এই জগৎ সম্পর্কে ধারণাই নেই। শিখি অগ্রসর হই, ইতিমধ্যে দেখা যায় আরও পরিবর্তন, আরও নতুন প্রশ্ন চলে আসছে। এর সঙ্গে মিলিয়ে চলতে পারাটা চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, প্রথমে আপনাকে মাথার মধ্যে নিতে হবে যে, আমরা পরিবর্তন চাই; পরিবর্তন করতে হবে।


রাজনীতিকে কীভাবে দেখছেন- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় পার্থক্য দেখি না। এখন গণভোট নিয়ে যে কথা হচ্ছে তা কেউ মানবে কিনা আমি জানি না। কিন্তু সময় তো তাদের হাতে নেই। ঘুরে ফিরে দেখি উপদেষ্টা পরিষদের যে আলোচনা হয়েছে গত সপ্তাহে তাতে অধিকাংশের মত ছিল একই দিনে নির্বাচন দু’টি করার, গণভোট এবং সাধারণ নির্বাচন। গণভোট এবং সাধারণ নির্বাচন একইদিনে করার বিষয়েই হয়তো সবাইকে একমত হতে হবে। সাতদিন পরে যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কতোগুলো পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করে তখন তো রাজনৈতিক দলগুলো সেগুলো না মেনে অন্য কোনো বিকল্প পথ থাকবে না। আমি মনে করি না এ সময় এসে কোনো দলের পক্ষে নির্বাচন বর্জন করার মতো পদক্ষেপ কেউ নিতে পারবে। নিলে সে দলের জন্য এটা সুইসাইডাল হবে। বহুমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হবে দলটি।


অন্তর্বর্তী সরকারের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন,  অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত বা আগের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কেউ খুব ভেবেছে বলে আমার জানা নেই। দাবি ছিল কোটা সমস্যার সমাধান এবং সরকারের পতন হয়ে যাওয়ার পরেই কিন্তু এই তৎপরতা শুরু হয়। এবং যারা তৎপরতা করেছেন, যারা অংশীদার ছিলেন, বিশেষ করে যে ছাত্রদের কথা বলি তাদের কিন্তু সত্যিকার অর্থে জোরালো বা ভালো একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার মতো বাস্তব অভিজ্ঞতা বা ব্যক্তিগুলোকে চেনা-জানার মতো অবস্থা ছিল না। তাদের বেশ কয়েকজন পরামর্শক বা বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করে এই ব্যক্তিদেরকে তারা নির্বাচন করেছেন। সকল সরকারের সময় আমরা দেখি, এটা সবসময় খুব সফল তা  তারা হন না। আপনার মনে আছে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হওয়ার পর আমরাও বলেছিলাম যে, ড. ফখরুদ্দীনকে শুভেচ্ছা। তবে উপদেষ্টা পরিষদ আমাদের কাছে পুরোপুরি গ্রহণযোগ্য হয়নি। এবারো কিন্তু এরকম একটা প্রশ্ন উঠেছিল। সক্ষম সফল হবেন কিনা এ ধরনের প্রশ্ন ছিল। এ প্রশ্ন এখনো রয়েছে। এবং অনেকেই সফল হয়েছেন। অনেকে হয়তো হতে পারেন নি। এটা খুবই বাস্তব। সবাই একই রকম হয় না। তবে মানুষের কাছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আরও অনেক কিছু চাহিদা, দাবি ছিল যেগুলো তারা পূরণ করতে পারেন নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী করা, তাদেরকে ব্যবহার করা, মব সন্ত্রাস বন্ধ করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নানা ক্ষেত্রে কতোগুলো অধঃগতিকে রোধ করা এই কাজগুলোর ক্ষেত্রে কিন্তু তারা সফল হননি। তবে সরকারের একটি প্রধান কাজ তারা নিয়েছিলেন সংবিধান সংস্কার। বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করে কিছু কিছু পদক্ষেপ নেয়া সেসব ক্ষেত্রে খুব অগ্রগতি হয়নি। সবচেয়ে দৃশ্যমান যে কাজটা তারা করেছেন সেটা রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে ‘ঐকমত্য কমিশন’ গঠন করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রায় আট মাস ধরে, আলোচনা চালিয়ে গেছেন। তার মধ্যে অবশ্য আপনি বলতে পারেন পাঁচ, সাত, আটটি দল হয়তো খুব মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, অন্যদের তেমন কোনো শক্তি, সমর্থন বা দাবি আদায়ের মতো জায়গাতে তারা ছিলেন না। তারপরও কিন্তু বাংলাদেশ ইতিহাসে সাত-আট মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা প্রকাশ্যে যেটা টিভিতে দেখা যায়, রেডিওতে শোনা যায় এটা কিন্তু একটা নতুন অভিজ্ঞতা। এবং সেদিক থেকে বলবো যে, এতটা ধৈর্য ধরে এতদিন আলোচনা চালিয়ে গিয়ে এবং শেষ পর্যন্ত সংস্কার প্রস্তাবে একমত হওয়া এবং তার মধ্যে ৪৮টি ছিল সংবিধান সংশোধন বা সংস্কার বিষয়ক, এটাকে আমি অগ্রগতি বলতে চাই। আজকে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে যে, একটু সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছে, সংকট তৈরি হয়ে গেছে, তবে এর সামনেও তো আমাদের আরও সুযোগ সম্ভাবনার জায়গা আছে, আলোচনার জায়গা আছে, নির্বাচনের মধ্যদিয়ে যারা আসবেন ক্ষমতায় তাদের আরও সময় আছে।


আপনি কি মনে করেন না যে, এই সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে অনেকখানি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেখুন আমি যদি একটু পেছনের দিকে যাই যখন এ পরিবর্তন হয় গত বছরের আগস্ট মাসে তখন আমাদের সামনে যে দলগুলো ছিল তারাই আছেন। কিন্তু আবার অন্যদিক থেকে যদি দেখেন রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ভেতরে যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছিল এবং পরে যে শূন্যতা তৈরি হলো সেটাকে পূরণ করার মতো যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব ছিল। যোগ্য সামাজিক শক্তির অভাব ছিল। যোগ্য নাগরিক সমাজের নেতৃত্বেরও ঘাটতি ছিল। আমরা তো জানি যে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান নিয়োগ নিয়েও কিন্তু কিছু তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা হয়েছে। অর্থাৎ সবাই যে সব ব্যাপারে একদম ঐকমত্য পোষণ করে সবটা তারা করতে পেরেছেন তা কিন্তু নয়, সেদিক থেকে কতোগুলো অভ্যন্তরীণ ঘাটতি বা ত্রুটি বলবো না কিছু অভাব আমাদের মধ্যে ছিল। এই সরকারের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব বেশি আশা করিনি, আমরা সেজন্য প্রস্তুত ছিলাম না, আমাদের কাছে সে দাবিগুলো পরিষ্কারও ছিল না। সামাজিক অসন্তোষ এবং যেখানে শ্রেণি- পেশার মানুষের মধ্যে বিরোধ, বৈষম্য সেটাকে নির্মূল করা। সমাজে নারীর সমমর্যাদার বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয়া এবং শ্রমিক কৃষক এই গোষ্ঠী যারা দেশকে টিকিয়ে রেখেছেন তাদের ব্যাপারে সরকারের অবস্থানটা দেখেন, শিক্ষার ব্যাপারে দেখেন, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দেখেন, কতো অবহেলা, কি দুর্গতি এই দিকগুলোতেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। আর সবচেয়ে বড়- রাজনৈতিকভাবে একটা সমঝোতা, এটাকে জাতীয় ঐক্য বলবো না। অনেকে বলেছেন যে, সাউথ আফ্রিকার মতো ন্যাশনাল রিকনসোলিয়েশনের দিকে যাবে, খুব কঠিন কাজ। সাউথ আফ্রিকাও এটাকে নিয়ে অব্যাহত থাকেনি। আমরা একটা এই বিরোধপূর্ণ রাষ্ট্রে, সংঘাতপূর্ণ রাষ্ট্রে যেখানে ন্যূনতম সমঝোতা আমাদের মধ্যে নেই সেখানে এ ধরনের একটা কাজ আমরা করতে পারবো সেটা মনে হয় না। তবে আমাদের ধীরে ধীরে হলেও একটা জায়গাতে যেতে হবে যেখানে অন্ততপক্ষে আমরা রাষ্ট্র হিসেবে, একটা সমাজ হিসেবে একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারি। আমাদের রাষ্ট্রের একটা কল্যাণমুখী, একটা গণতান্ত্রিক সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য আমাদের কতোগুলো বিষয়ে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ একটা প্রশ্ন। এখানে আমাদের মধ্যে সমঝোতায় আসতে হবে। মানতেই হবে। আমাদের জাতীয়তাবাদ প্রশ্ন, প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ এবং এটা আমাদের দেশের প্রয়োজন এবং কীভাবে একে ব্যবহার করবো এটা আমাদেরকে ভাবতে হবে। আমাদেরকে অবশ্যই অসামপ্রদায়িক একটা সমাজ তৈরি করার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদেরকে ধর্মের বিষয় সহনশীলতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।  আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে হবে। আবার আমাদের ন্যায্য হিস্যা যেন আমরা পাই সেদিকেও নজর রাখতে হবে। এসব বিষয়গুলো অনেক দীর্ঘ তালিকা হয়ে যায়। ন্যূনতম পক্ষে নতুন সরকারে যারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন এবং তারা সকলকে নিয়ে একটা ঐকমত্য বা সমঝোতার ভিত্তিতে চলবেন- এটাই আমরা আশা করি। তা না হলে কিন্তু আবার যদি বিরোধ-বিভেদ-সংঘাত হয়, আবার যদি দেখা যায় কয়েক বছর পরে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ, বিক্ষোভ এবং জনবিদ্রোহ তৈরি হয় এবং এই ধরনের সংকট সংঘাত বোধহয় আমরা বেশিদিন সহ্য করতে পারবো না, আমাদের রাষ্ট্র সেটা নিতে পারবে না।


রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামী নিয়ে তিনি বলেন, বিএনপি বিগত সময়ে সক্রিয় থাকলেও জামায়াতে ইসলামীকে শেষ মুহূর্তে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৭/১৮ কোটি মানুষের সমস্যা দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে, দ্রুত অগ্রগতি হবে- এমনটা নয়। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐক্য বা সমঝোতা নেই, নেতৃত্বের প্রতি আস্থা নেই। মানুষের মধ্যে নানা সন্দেহ অবিশ্বাস থাকলে দেশ চলতে পারে না।  


বিগত ৫৪ বছরে আমরা দেশকে ধীরে ধীরে এই জায়গায় নিয়ে এসে পৌঁছেছি, আমরা আরও অতীতে যদি যাই দেখি বাংলাদেশের সমাজের মধ্যে বিভক্তি সর্বত্র, রাজনীতিতে, সামাজিক ক্ষেত্রে, অর্থনীতিতে। বৈষম্য রয়েছে ব্যক্তিতে, পরিবারে পরিবারে, গ্রামের সমাজের মধ্যে, নিজের মধ্যে। তাই অসহিষ্ণুতা, বিভক্তি, তর্ক যুদ্ধ এবং সহিংসতা দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় বাংলাদেশের মানুষ, প্রচলিত কথায় এটা ছিল শান্তির দেশ, এক ধর্মের দেশ, এক ভাষার দেশ, কিন্তু আমরা বাস্তবে কি দেখি এত বিভক্তি শান্তিপূর্ণ এই দেশে, নদীর দেশ, পাহাড়ের দেশ, শস্য শ্যামলা দেশের মধ্যে? এত রক্তক্ষরণ? এত বিরোধ? এত সংঘর্ষ? এত মৃত্যু? যেখানে সেখানে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এই হলো আমাদের বাস্তব পরিবেশ।


একসময় আপনি নাগরিক সমাজের ব্যাপারে খুবই সোচ্চার ছিলেন। বিশেষ করে আপনার পত্রিকা প্রথম আলো সোচ্চার ছিল। ইদানীং আমরা লক্ষ্য করছি যে, আপনি এ ব্যাপারে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু কেন? মতিউর রহমান চৌধুরীর এ প্রশ্নে তিনি বলেন, নাগরিক সমাজের ৫০/৬০-এর দশকে একটা উজ্জ্বল সময় ছিল। নাগরিক সমাজ বলতে, এই লেখক, শিল্পী, কবি, ছাত্রসমাজ অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ তারা ব্যাপক উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছে। যদি আমরা বলি ’৫২, ’৬২, ’৬৯, ’৭০, ’৭১ এবং আমরা দেখি পরবর্তী ’৯০ তে এসে। সেই পরিবেশের যে মানুষগুলো একাট্টা হয়েছিল সত্যিকার অর্থাৎ নিঃস্বার্থভাবে দেশের কল্যাণ, মঙ্গলের জন্য। এই প্রজন্মের মানুষগুলো ধীরে ধীরে চলে গেছেন। তারা নেই আর এর মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ বলেন, জাতীয়তাবাদ বলেন, অসামপ্রদায়িকতার প্রশ্ন বলেন, ধর্মের প্রশ্ন বলেন, নানা বিষয়ে আমাদের সমাজের মধ্যে ছোট বড় নানা রকম তর্ক এসেছে। এসব বিষয়গুলোতে বিতর্ক হয়েছে, বিরোধ হয়েছে, বিভেদ হয়েছে, এগুলোকে আমরা ধামাচাপা দিয়েছি। এগুলো নিয়ে আমরা ভালো আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক করিনি এবং সর্বশেষ আমরা দেখলাম যে, বিগত ১৬ বছরের যে সরকার ছিল আওয়ামী লীগের, শেখ হাসিনার সরকার এই বিষয়গুলোকে অপব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে প্রচার করতে গিয়ে, প্রমাণ করতে গিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমান একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি, মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বের ভূমিকাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তার অবস্থানকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে ব্যবহার করেছে, দলীয়ভাবে সংকীর্ণভাবে, গোষ্ঠীর স্বার্থে তাতে বিষয়গুলো সম্পর্কে মানুষের মধ্যে একটা অনীহা, একটা আপত্তি, একটা বিরোধিতা চলে এসেছে। এটাকে আমরা অস্বীকার করতে পারবো না যে, বিষয়গুলো নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি হয়েছে। তা হওয়ার ফলে এ বিষয়গুলোতে মানুষের মধ্যে বিভক্তি এসেছে। সন্দেহ অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে এবং এগুলো নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।


এগুলো নিয়ে আজকে নতুন করে আলোচনার সুযোগ হয়েছে। আমাদেরকে আলোচনায় যুক্ত হতে হবে। নতুন করে ভাবতে হবে এবং প্রত্যেকটা বিষয় কিন্তু আমাদের মধ্যে আলোচনার মধ্যদিয়ে যেখানে যতটুকু পারা যায় একটা ঐকমত্য তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে। না হলে রাজনৈতিকভাবে, আদর্শগতভাবে, সামাজিকভাবে এবং আরও অন্যান্য দিক থেকে যে বৈষম্য, যে সংঘাত, এভাবে একটা দেশ-রাষ্ট্র চলতে পারে না। আমরা কিন্তু এরকম একটা সংকটের মধ্যে আছি। আগামীতেও থাকবো যদি আমরা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, আমাদের সামাজিক নেতৃত্ব, আমাদের নাগরিক সমাজ যদি সত্যিকার অর্থে দেশের মধ্যে একটা বৃহত্তর ঐক্য সমঝোতার পরিবেশ তৈরি না করতে পারেন, আমরা না করতে পারি, সংবাদপত্রের ভূমিকা সেখানে অনেক, তা না হলে কিন্তু এর থেকে আমরা বের হতে পারবো না।


কেমন নেতৃত্ব চান? 
ন্যূনতম রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক সহিষ্ণু নেতৃত্ব হবে যারা তাদের সমালোচনা শুনবেন, সংবাদপত্রকে একটা স্বাধীন জায়গাতে অবস্থান করতে দিবেন, যেন আমরা সত্যিকার অর্থেই সত্য কথা বলতে পারি, যে কথাগুলো তাদের জন্য আরও বেশি করে প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ন্যূনতম ভিত্তিতে একটা সমঝোতা এবং বৃহত্তর নাগরিক সমাজ সঙ্গে নিয়ে একটা সমঝোতার ক্ষেত্র তৈরি করা। 


গ্রন্থনা: পিয়াস সরকার

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর