বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক (Caretaker) সরকারের প্রবর্তন ও বিলুপ্তি এবং পুনরুজ্জীবন শুধু একটি আইনি অধ্যায় নয় বরং ভোটাধিকার নিশ্চিত করার জন্য জনগণের ঐতিহাসিক দাবির প্রতিচ্ছবি।
উত্থান ও পতন: একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান সাধারণত একটি দল-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার (Caretaker Government) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনার আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত হয়, যেখানে শক্তিশালী, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং স্বচ্ছ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে সকল দলের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করে ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর বিপরীতে, এই ব্যবস্থার পতন ঘটে যখন ক্ষমতাসীন দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সাংবিধানিক ব্যবস্থার বাতিল বা বিকৃতি ঘটায়, বিশেষ করে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক কাঠামো বিলোপ করে দেয়। এই পদক্ষেপের ফলস্বরূপ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়, বিরোধী দলের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয় এবং জনগণের ভোটাধিকারের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয় এবং রাজনৈতিক সংকটকে তীব্র করে তোলে।
১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু একই বছর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। হাইকোর্ট ২০০৪ সালে সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করলেও ২০১১ সালে আপিল বিভাগ (৪:৩) সংখ্যাগরিষ্ঠতায়-এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে-এটিকে বাতিল করে দেয়। এই রায়ের পর পঞ্চদশ সংশোধনী এনে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত করে। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ নিয়তি এখন আবার সামনে ফিরে এসেছে। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে (২০শে নভেম্বর ’২৫) রায় ঘোষণা করেছেন সুপ্রিম কোর্টে আপিল বিভাগ। এর মধ্যদিয়ে চৌদ্দ বছর আগে আদালতের রায়ে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আবারো ফিরে এলো। যে ব্যবস্থাকে ১৪ বছর ধরে “অসম্ভব” বলা হয়েছিল, সেটিই আবার জনগণের আন্দোলন ও রক্তের বিনিময়ে ফিরে আসার পথ পেয়েছে। ইতিহাস যেন ঘোষণা করছে-জনগণের রক্ত এবং অভিপ্রায় কখনো বাতিল হয় না।
তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার জন্ম: নৈতিক প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা: ৯০-এর দশকে সামরিক শাসন, রাজনৈতিক অবিশ্বাস এবং প্রশাসনিক পক্ষপাতের বিরুদ্ধে জনতার তীব্র প্রতিবাদ থেকেই ধারণাটি জন্ম নেয়। প্রধান কারণ ছিল ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতি বিরোধী দলগুলোর আস্থা হারানো। এই শূন্যতা পূরণের নৈতিক দাবি থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্ম। পরবর্তীতে বিএনপি ১৩তম সংশোধনী পাস করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে যুক্ত করে। এটি ছিল রাষ্ট্রের ভোটাধিকারের নৈতিক নিরাপত্তার একটি “রক্ষাকবচ”- যাতে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে।
১৯৯১, ১৯৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচন দলীয় সরকার ছাড়া তত্ত্বাবধায়কের অধীনে সম্পন্ন হয়। যদিও পরবর্তীতে বিচারপতির বয়স বাড়িয়ে কাঠামোগত দুর্বলতা আনা হয়, যার পরিণতিতে দলগুলোর রাজনৈতিক ব্যর্থতার সুযোগে সামরিক সমর্থিত ‘ওয়ান-ইলেভেন’-এর অস্বাভাবিক সরকারের আবির্ভাব ঘটে।
তবু একথা স্পষ্ট ছিল- ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র গ্রহণযোগ্য উপায় হিসেবে জনগণ তত্ত্বাবধায়ককেই বৈধতা দিয়েছিল।
খায়রুল হকের রায় ও পঞ্চদশ সংশোধনী: গণতন্ত্রের নির্বাসন: ২০১১ সালের আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক বাতিল হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত উপেক্ষা করে রায়টি দেয়া হয়েছিল। আদালত “সংবিধানের মৌল কাঠামো”র নামে এমন এক তত্ত্ব হাজির করে যার ফলে জনগণের ভোটাধিকারই নির্বাসিত হয়ে পড়ে। অথচ সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্য যে ‘গণতন্ত্র’, তা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায়ই তো ছিল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা।
আওয়ামী লীগ সুযোগ নিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বাধ্যতামূলক করে। ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়, রাতের ভোট, ডামি নির্বাচন- সবকিছুই তখন ‘বিজয়ের ধারাবাহিকতা’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। নির্বাচন হয়ে ওঠে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার প্রক্রিয়া। এভাবেই রাজনৈতিক কাঠামো এমনভাবে বদলে গেল, যেখানে ক্ষমতাসীনদের অপসারণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এখান থেকেই জন্ম নেয় প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাসিবাদের বীজ। ফ্যাসিবাদ কখনো হঠাৎ আসে না- এটি আসে ধীরে ধীরে, আইন, প্রশাসন, মিডিয়া ও আদালতের নীরব দখলের মাধ্যমে।?তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে মেরূকরণ আরও গভীর করে তোলে এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তৈরি করে।
গণতান্ত্রিক স্মৃতি (Democratic Memory) ইতিহাসের নৈতিক বিচার: গত ১৪ বছর ধরে বলা হচ্ছিল-তত্ত্বাবধায়ক আর কখনো ফিরবে না। আবার সংবিধান পরিবর্তন অসম্ভব। কিন্তু ইতিহাস তার নিজস্ব নিয়মে চলে।
‘তত্ত্বাবধায়ক আর কখনো ফিরবে না’- এটি ছিল পঞ্চদশ সংশোধনীর পক্ষের রাজনৈতিক অঙ্গীকার। অন্যদিকে সংবিধানের ৭ (ক) ও ৭ (খ) অনুচ্ছেদ, যা সংবিধান স্থগিত বা বাতিল করার চেষ্টাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ঘোষণা করে, তাও উচ্চতর আদালত দ্বারা বাতিল হয়েছে। এটাই ইতিহাসের নির্মম রসিকতা এবং একই সঙ্গে নৈতিক ন্যায়বিচার। কারণ ইতিহাস অন্যায় কাঠামোকে দীর্ঘদিন ধরে সহ্য করতে পারে না। জনতার স্মৃতি একধরনের নৈতিক শক্তি- ঐধহহধয অৎবহফঃ বলতেন, ন্যায়হীনতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধই মানব অস্তিত্বের প্রমাণ। এ কারণেই তত্ত্বাবধায়ক ফিরে আসছে। এটি কেবল আইনগত ফিরে আসা নয়-এটি দার্শনিক ফিরে আসা, একটি Democratic Memory, একটি moral covenan:
যা জনগণের, তা জনগণেরই থাকবে।
দার্শনিক শিক্ষা: তত্ত্বাবধায়ক: যন্ত্র নয়, চর্চার রক্ষাকবচ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিশ্চিত হবে- এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ জধষিং, চড়ঢ়ঢ়বৎ, এৎধসংপর্ত সবাই সতর্ক করে দিয়েছেন: গণতন্ত্র যন্ত্র নয়, এটি চর্চা।
এই চর্চা তখনই টিকে থাকবে, যখন জনগণ বুঝবে তারা প্রজাতন্ত্রের নৈতিক মালিক। জনগণ যখন রাজপথে দাঁড়ায়, তারা কেবল সরকারের পরিবর্তন চায় না, তারা দাবি করে রাষ্ট্র কাঠামোর নৈতিক রূপান্তর।
বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন ছিল এমনই এক অস্তিত্বগত দাবি- ভোটের অধিকার নয়, বরং অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষার সংগ্রাম। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কেবল নির্বাচন ব্যবস্থা নয়, এটি ছিল জনগণের ন্যূনতম নৈতিক রক্ষাকবচ। যা procedural justice K moral justice-এর পথে রূপান্তর ঘটানোর ঐতিহাসিক প্রয়াস।
ইতিহাস আজ প্রমাণ করেছে-ক্ষমতার চক্রান্ত যত বড়ই হোক, জনগণের রক্তের ওপর কোনো স্থায়ী শাসন গড়া যায় না। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরে এসেছে-কারণ ইতিহাসের নিজস্ব নৈতিক আইন আছে। এই ফিরে আসা-একটি সতর্কবার্তা, একটি সম্ভাবনা, এবং একটি দার্শনিক অঙ্গীকার-জনগণের যা, তা জনগণেরই থাকবে। জনগণই হলো ক্ষমতার মূল উৎস, এবং সেই উৎসকে রুদ্ধ করার সকল প্রয়াস কালে কালে বিলীন হয়ে যাবে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন প্রমাণ করলো যে, ন্যায় ও জনগণের ইচ্ছাই হলো ইতিহাসের চালিকাশক্তি। এই শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আলোর দিশা হয়ে থাকবে।
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ইমেইল: faraizees@gmail.com