এক ঐতিহাসিক রায়, যা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গত দেড় দশকের স্থিতাবস্থাকে আমূল নাড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া এবং তার ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের সিদ্ধান্তের ঘটনা দুই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর কূটনৈতিক সম্পর্ককে এক নতুন এবং কঠিন পরীক্ষার মুখে ঠেলে দিয়েছে। ১৫ বছর ধরে দিল্লির সঙ্গে এক কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু রাজনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিলেন হাসিনা, যেখানে চীনকে ছাপিয়ে ভারতই পেয়েছিল অগ্রাধিকার। এখন তাকে ফেরত চেয়ে ঢাকার দাবি এবং নয়াদিল্লির তাতে অস্বীকৃতি একটি অপ্রত্যাশিত কূটনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছে।
বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, এই সংকট মূলত হাসিনাকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকার চাইছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ভারত তার প্রত্যর্পণে রাজি নয়। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পর্যবেক্ষক মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, ভারতের সামনে এখন চারটি অপ্রত্যাশিত বিকল্প খোলা। প্রত্যর্পণ: হাসিনাকে ফেরত পাঠানো, যা ভারতীয় রাজনীতিতে অকল্পনীয় এবং বন্ধুকে বিপদে না ফেলার নীতির পরিপন্থি। বর্তমান স্থিতি: হাসিনাকে ভারতে রাখা, যা আগামীতে নির্বাচিত সরকার এলে দিল্লির জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করবে। নিরবতা: হাসিনাকে চুপ থাকার অনুরোধ জানানো, যা তার মতো নেত্রী মানবেন না এবং দিল্লিও সম্ভবত এই বিষয়ে জোরাজুরি করবে না। তৃতীয় দেশে স্থানান্তর: হাসিনাকে অন্য কোনো দেশে পাঠানো, তবে এর আইনগত জটিলতা ও নিরাপত্তার কারণে খুব কম দেশই রাজি হবে। যেহেতু ক্ষমতাসীন বা বিরোধী পক্ষ- উভয়েই হাসিনাকে বন্ধু মনে করে, তাই তার প্রত্যর্পণ ভারতের ‘বন্ধুত্বের নীতির’ সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। এই পরিস্থিতিতে, পুরনো মিত্রের জন্য ভারত কতোটা কূটনৈতিক মূলধন খরচ করবে, সেটাই এখন মুখ্য প্রশ্ন।
বিবিসি বিশ্লেষণে বলা হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গভীরতা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। বাংলাদেশ আজ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। বার্ষিক ১৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য এবং রেল, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও ট্রানজিটে বাংলাদেশের ভারতের ওপর গভীর নির্ভরশীলতা এই সম্পর্ককে সহজে ছিন্ন হতে দেবে না। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরতদ্বাজের মতে, ভারতের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের পক্ষে চলা কঠিন। এদিকে হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশ দ্রুতই তার পররাষ্ট্রনীতি পুনর্গঠন করছে। সিঙ্গাপুরের একটি গবেষণা অনুযায়ী, বর্তমান সরকারের প্রথম দিকের কূটনৈতিক পদক্ষেপ ছিল ‘ডি-ইন্ডিয়ানাইজেশন’। তারা বিচার বিভাগীয় আদান-প্রদান বাতিল করছে, ভারতীয় জ্বালানি চুক্তি পুনর্বিবেচনা করছে, সংযোগ প্রকল্প ধীর করছে এবং একই সাথে চীন, পাকিস্তান ও তুরস্কের দিকে ঝুঁকছে। ঢাকার একটি জরিপে ৭৫ শতাংশ মানুষ চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে ইতিবাচকভাবে দেখলেও ভারতের ক্ষেত্রে এই হার মাত্র ১১ শতাংশ। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে, বাংলাদেশ কৌশলগতভাবে ভিন্ন দিকে সরে যাচ্ছে।
ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ শুধু নির্বাসিত এক মিত্রকে সামলানো নয়, বরং তাদের নিরাপত্তার কেন্দ্রে থাকা একটি প্রতিবেশীকে ধরে রাখা। সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রবেশাধিকারের জন্য এই সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৪০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত নিয়ে বিশেষজ্ঞরা উদ্বিগ্ন- বাংলাদেশ অস্থির হলে বাস্তুচ্যুতি বা চরমপন্থা বাড়তে পারে।
লন্ডনের এসওএএস-এর অধ্যাপক অবিনাশ পালিওয়াল মনে করেন, ভারতকে এখন তাড়াহুড়ো করা যাবে না। ঢাকার সকল রাজনৈতিক পক্ষ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে নীরব ও ধৈর্যশীল কূটনীতি প্রয়োজন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন যে, আগামী ১২ থেকে ১৮ মাস সম্পর্ক অস্থির থাকবে। তবে, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন এবং নতুন সরকার গঠিত হলে সম্পর্ক পুনরায় গড়ার সুযোগ তৈরি হবে। নয়াদিল্লির সামনে এখন একটি বড় নীতিগত প্রশ্ন হলো- কীভাবে মিত্রদের আশ্বস্ত করা যায় যে, ভারত পাশে থাকবে, কিন্তু মানবাধিকার বিতর্কে জড়াবে না? সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর মতে, পররাষ্ট্রনীতি জনমত বা নৈতিকতায় চলে না। ক্ষমতায় যারা থাকে, যারা বন্ধুসুলভ, তাদের সঙ্গেই কাজ করা হয়। তবে বিশেষজ্ঞরা এও মনে করেন যে, হাসিনাকে অতিরিক্ত সমর্থন দিয়ে দিল্লি ভুল করেছে। এই রাজনৈতিক ফাটল মেরামত সম্ভব হবে কি না, তা অনিশ্চিত। অনেক কিছু নির্ভর করছে বাংলাদেশের পরবর্তী সরকারের ওপর। নতুন সরকার হাসিনা ইস্যুকে কতোটা প্রভাব ফেলতে দেবে, সেটাই আগামী দিনে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের গতিপথ নির্ধারণ করবে। যদি এই সম্পর্ক এক নির্বাসিত নেত্রীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে, তবে অগ্রগতির পথ কঠিন হবে।