মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আদালতে রায় ঘোষণার মুহূর্তে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহিনা বেগম। কারণ গত বছর ছাত্র নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ চলাকালীন শাহিনার ২০ বছর বয়সী পুত্র সাজ্জাদ হোসেন পুলিশের গুলিতে মারা যান। পরে তার লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়। এমন এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে ২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট ১৫ বছরের ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। প্রসিকিউটররা বলেন, আশুলিয়ার একটি গার্মেন্টসের কাছে হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার কয়েক মুহূর্ত আগে বিক্ষোভে অংশ নেয়া ৬ ছাত্রকে হত্যা করা হয়। যাদের ৫ জনকে প্রথমে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং পুড়িয়ে দেয়া হয়। আর বাকি ১ জনকে থানার ভেতরে জীবন্ত পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া ছিলেন হাসিনা। আদালত বলেছে, তার নির্দেশেই নিরাপত্তা বাহিনী এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, আন্দোলনে প্রায় ১৪০০ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে।
শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান প্রতিবেশী দেশ ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় তাদের অনুপস্থিতিতেই টানা কয়েক মাসের বিচারকার্য শেষে এই দু’জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। তাদের সঙ্গে সেদিন সাবেক পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে রাজসাক্ষী হওয়ায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। গত সোমবার রাতে শাহিনা বেগম আল-জাজিরাকে বলেন, এই ঐতিহাসিক রায় ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশে আবেগের ঢেউ তুলেছে। তিনি বলেন, যতক্ষণ না তাকে (হাসিনাকে) ফিরিয়ে এনে এই দেশে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে, ততক্ষণ আমি শান্ত হতে পারছি না। আন্দোলনে ছেলে হারানো ওই নারী বলেন, আমার ছেলে ওই থানার ভেতরে সাহায্যের জন্য চিৎকার করেছে। কেউ তাকে বাঁচায়নি। যারা তাকে পুড়িয়ে মেরেছে, তারা যেন আর কোনো মায়ের সন্তানের ক্ষতি করতে না পারে, তার ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত আমি শান্ত হবো না।
কিন্তু অভ্যুত্থানে প্রিয়জন হারানো শত শত পরিবার আদালতের রায়কে যুগান্তকারী হিসেবে মনে করলেও তাদের প্রশ্ন, হাসিনা কি আসলেই বিচারের মুখোমুখি হবেন? প্রশ্ন উঠেছে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারত কি হাসিনা ও আসাদুজ্জামানকে ফেরত দেবে, নাকি বিচারের হাত থেকে বাঁচাতে কৌশল করবে?
গাইবান্ধার বাসিন্দা শাহিনা বেগম বলেন, আমার ছেলেকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে তারা পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছিল, কিন্তু এই রায় দিতে প্রায় দেড় বছর লাগলো। এই সরকার কি সত্যিই তাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে? যদি সরকার পরিবর্তন হয় এবং পরের সরকার হাসিনা ও তার সহযোগীদের রক্ষা করে, তাহলে কী হবে? এই হত্যাকারীরা যে পালাতে পারবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
‘রায় কার্যকর হতেই হবে’: রায়ের দিন ট্রাইব্যুনালের বাইরে শত শত মানুষ জড়ো হয়। যাদের মধ্যে একজন মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। তার ভাই মীর মুগ্ধ অভ্যুত্থানের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। স্ন্নিগ্ধ বলেন, শেখ হাসিনা আরও বেশি শাস্তির যোগ্য। তিনি কর্তৃপক্ষের প্রতি এই রায় কার্যকর করার জন্য হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানান।
স্নিগ্ধের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নিহত বিক্ষোভকারী মুতাসির রহমানের বাবা সৈয়দ গাজী রহমান। তিনি হাসিনাকে হাজার হাজার পরিবারের হৃদয় শূন্য করে দেয়ার জন্য অভিযুক্ত করেন এবং মৃত্যুদণ্ডের রায় দ্রুত এবং প্রকাশ্যে কার্যকর করার দাবি জানান।
রাজধানী থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত রংপুর। জেলাটির ভাবনাপুর জাফরপাড়া গ্রামের ছেলে আবু সাঈদের পরিবারও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালতের রায়কে স্বাগত জানান। এই আবু সাঈদ ছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিদের সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া বিক্ষোভে শরিক হয়েছিলেন তিনি। পরে আন্দোলন চলাকালীন ১৬ই জুলাই পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তার বাবা মকবুল হোসেন বলেন, অবশেষে আমার মন শান্ত হয়েছে। আমি সন্তুষ্ট। তাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে অবিলম্বে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। সাঈদের মা, মনোয়ারা বেগম যোগ করেন, আমার ছেলে চলে গেছে। এটা আমাকে কষ্ট দেয়। এই রায় কার্যকর করতেই হবে। তিনি বলেন, রায়ের পর তাদের বাড়িতে আসা লোকজনের মধ্যে পরিবার মিষ্টি বিতরণ করেছে।
অভ্যুত্থানের আরেক শহীদ শাহরিয়ার খান আনাস। দশম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। ৫ই আগস্ট ঢাকার চানখাঁরপুলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার মা সানজিদা খান দীপ্তি আল-জাজিরাকে বলেন, এই রায় কেবল একটি সান্ত্বনা। তার দাবি যেদিন রায় কার্যকর হবে, সেদিনই ন্যায়বিচার হবে। পুত্র হারানোর শোকে কাতর এই নারী আরও বলেন, যেই ব্যক্তি হাজার হাজার মায়ের বুক খালি করেছেন, তার জন্য ১৪০০ মৃত্যুদণ্ডও যথেষ্ট হবে না। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে একজন শাসক যখন গণহত্যা চালায় তখন বিশ্বকে এর পরিণতি দেখতে হবে। আল্লাহ হয়তো কাউকে ছাড় দেন, কিন্তু তিনি ছেড়ে দেন না। দীপ্তি সাবেক পুলিশ প্রধান আল-মামুনের রায়ে সন্তুষ্ট নন বলেও জানান। তিনি বলেন, আবদুল্লাহ আল-মামুনের আরও দীর্ঘমেয়াদি সাজা হওয়া উচিত ছিল, কারণ তিনি দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর অংশ হয়েও আমাদের সন্তানদের হত্যা করেছেন।
‘আর কোনো স্বৈরশাসকের উত্থান নয়’: রায়ের দিন হাসিনা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন অংশে আনন্দ মিছিল বের করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হওয়া একটি মিছিল থেকে দ্বিতীয় বর্ষের স্নাতক শিক্ষার্থী রাফি বলেন, তারা হাসিনাকে ভারত থেকে প্রত্যর্পণের দাবিতে সমাবেশ করবেন। আল-জাজিরাকে এই তরুণ বলেন, আমরা আপাতত খুশি। কিন্তু আমরা চাই হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা হোক এবং তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হোক। এই রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা রাস্তায় থাকবে বলেও জানান রাফি।
এদিকে ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ঢাকার শাহবাগ মোড় এলাকায় ‘মৌলিক বাংলা’ নামে একটি গোষ্ঠী হাসিনার প্রতীকী মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। জুলাই অভ্যুত্থান থেকে অনুপ্রাণিত নির্দলীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদী বলেন, এটি একটি বার্তা যেন আর কোনো স্বৈরশাসকের উত্থান না নয়। প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।