প র্যা লো চ না

নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রাষ্ট্রে বিপর্যয় ডেকে আনবে

শহীদুল্লাহ ফরায়জী | এক্সক্লুসিভ
এপ্রিল ২৬, ২০২৫
নিরঙ্কুশ ক্ষমতা রাষ্ট্রে  বিপর্যয় ডেকে আনবে

নিরঙ্কুশ ক্ষমতা এমন এক ব্যবস্থা, যা নিজের সীমারেখা ভুলে যায়, ভুলে যায় প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের অস্তিত্ব। একচ্ছত্র শাসনক্ষমতা রাষ্ট্রকে রূপান্তরিত করে ব্যক্তির ইচ্ছার পুতুলে, যেখানে আইন, ন্যায্যতা কিংবা জনগণ-সবই পরিণত হয় ক্রীতদাসে।


ইতিহাসের অনন্য রক্তাক্ত গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা রূপান্তরের বা নতুন এক রাষ্ট্র বিনির্মাণ এবং সর্বব্যাপী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে ঐতিহাসিক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল-অগণিত ছাত্র-জনতার রক্তের দাগ মুছে যাওয়ার পূর্বেই সে সম্ভাবনা দিন-দিন ক্ষীণ হয়ে আসছে। বড় বড় দলগুলোর দলকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র চিন্তা ও কর্মকাণ্ডে গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় ক্রমেই দূরবর্তী হয়ে যাচ্ছে। এত ভয়ঙ্কর গণহত্যার পরও রাষ্ট্রীয় রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের কণ্ঠস্বর প্রতিমুহূর্তে অস্পষ্ট হয়ে আসছে।


রক্তক্ষয়ী গণ-অভ্যুত্থানের পর একটি প্রশ্ন প্রচণ্ডভাবে উত্থাপিত হয়েছিল যে-আমাদের প্রজাতন্ত্র হবে সমাজের সমষ্টিগত ইচ্ছার ফলশ্রুতি। আরও স্পষ্ট করে বললে বলা যায়, রাষ্ট্র হবে সমাজের সকল অংশের মানুষের অন্তর্ভুক্তির বাস্তবসম্মত রূপ। এই একটি বিষয় নিয়েই আজকের আলোচনার অবতারণা।


বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক অভ্যুদয় থেকেই সমাজের সকল অংশের মানুষের সমষ্টিগত ইচ্ছা এবং অভিপ্রায়কে উপেক্ষা বা বর্জন করে শাসনব্যবস্থা আর শাসনকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশে বিগত ৫৪ বছরে একদিনের জন্যও সমাজের সামগ্রিক স্বার্থে রাষ্ট্রটিকে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি। এটা জাতির জন্য এক দুর্ভাগ্য।
রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য দলতান্ত্রিকশাসন নির্ভর আমলাতন্ত্রের উপর রাষ্ট্রব্যবস্থার সামগ্রিক পরিচালনার দায়িত্ব ও ভার প্রদান করা হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রাধিকার বা মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-একান্তভাবে বল প্রয়োগ ও উৎপীড়নের মাধ্যমে সরকারের কর্তৃত্ব বজায় রাখা। এই বল প্রয়োগে রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত থাকে দমনপীড়নের জন্য সৃষ্ট একাধিক সংস্থা। 


এহেন রাজনৈতিকব্যবস্থা এবং নিপীড়নমূলক রাষ্ট্রযন্ত্রকে অক্ষত রেখে গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের প্রস্তাবনা উত্থাপন করা হচ্ছে। সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তনের যে-সমস্ত দাবি উত্থাপিত হচ্ছে তা দলতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামোর হেরফের বিশেষ। দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না বা প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে দলের সভাপতি হতে পারবে না-এসব তুলনামূলক ভালো প্রস্তাবনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের শাসন-ক্ষমতার মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। রাষ্ট্র পরিচালনায় শুধু রাজনৈতিক দল বা একটি গোষ্ঠীর অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক দলসমূহের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মতাদর্শগত প্রতিনিধিত্বের প্রচলিত ব্যবস্থাই সমগ্র রাষ্ট্র কাঠামোতে প্রাধান্য অর্জন করে, যার পরিণতিতে সামগ্রিকভাবে তাদের স্বার্থই সুরক্ষিত হয়, যা বিগত ১৫ বছর আরও স্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়েছে। রাজনৈতিকব্যবস্থা বা রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থায় শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র সংস্থায় বড় ধরনের সংকট। 


বাংলাদেশে বিশাল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবীগণ সংযুক্ত। এই বিকাশমান বিশাল সমাজশক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাহিদা-কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা মুষ্টিমেয় রাজনৈতিক দলের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। সুতরাং, শুধুমাত্র রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব সমাজের সকল অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে না। ফলে সামগ্রিকভাবে সমাজের অগ্রগতি খর্ব হচ্ছে, উৎপাদন ও উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন হচ্ছে, প্রশাসনিক বা রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত নীতি প্রণয়নে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে, সর্বোপরি রাষ্ট্র গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়ে সংঘাত-সংঘর্ষ এবং রক্তপাতে অনিবার্য হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক দলের ন্যূনতম প্রতিনিধিত্ব অর্থাৎ বিকশিত সমাজশক্তির প্রতিনিধিত্ব ছাড়া ক্রমবর্ধমান রাষ্ট্রক্ষমতাকে যথার্থ ও যৌক্তিকতার উপযুক্ত বৈধতার মাপকাঠিতে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হচ্ছে না। নিরপেক্ষ নির্বাচন বা তথাকথিত নির্বাচন- কোনোটাতেই রাষ্ট্রশক্তির বৈধতার সংকট দূরীভূত করতে পারছে না। ফলে একদিকে রাষ্ট্রশক্তির বৈধতা-সংকট, অন্যদিকে উৎপাদন-উন্নয়ন ও জ্ঞান বিজ্ঞানে জড়িত মানুষজন, রাষ্ট্র পরিচালনা বা নীতি নির্ধারণে আইনগত ও সাংবিধানিকভাবে ভূমিকা না রাখায়- হতাশ ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থার শৃঙ্খলে সকল সমাজশক্তি শৃঙ্খলিত। আর শৃঙ্খলিত শক্তি বা ব্যক্তির কাছে জীবন অর্থহীন ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে। বিরাট কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে, উৎপাদনে জড়িত জনগোষ্ঠীকে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে জড়িত জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে, ব্যবস্থা থেকে বহির্ভূত করে দিয়ে, কাঠামো থেকে বহিরাগত করে দিয়ে-বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করে তোলা অসম্ভব। বিদ্যমান দলকেন্দ্রিক শাসনপদ্ধতি অক্ষত বা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র জটিল থেকে জটিলতর সংকটের আবর্তে  নিমজ্জিত হবে।


বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে-আকাঙ্ক্ষা উদ্ভাসিত হয়েছিল তার প্রাথমিক ভিত্তি হবে-প্রচলিত বা বিদ্যমান ‘সংকুচিত গণতন্ত্র’কে অতিক্রম করা। অচিন্তনীয় গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরাক্রমশালী ফ্যাসিবাদীব্যবস্থা উচ্ছেদে প্রমাণ হয়েছে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক দল নিয়ামক শক্তি নয়। সমাজের সকল অংশের অংশগ্রহণে, লড়াই-সংগ্রামে প্রবল শক্তিশালী শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। অনুরূপভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় সকল অংশের অংশগ্রহণভিত্তিক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তা অভ্যুত্থানকারী শক্তিগণ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। সকল সমাজশক্তির অংশগ্রহণমূলক রাষ্ট্রীয় রাজনীতির তাত্ত্বিক ভিত্তিভূমি হচ্ছে ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’।


বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে- প্রত্যেক ব্যক্তিকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সাংবিধানিক সুযোগ নিশ্চিত করা। প্রতিনিধিত্বের প্রশ্নটি হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়। যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও কাঠামোতে সমাজের সকল অংশের বা স্তর ভেদে শ্রমজীবী-কর্মজীবী-পেশাজীবীগণ রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করতে না পারে ততক্ষণ পর্যন্ত স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশে বড় দলসমূহ-দলকেন্দ্রিক গণতন্ত্রের বিপর্যয়, সীমাবদ্ধতা ও সংকটের উৎস অনুধাবন করতে পারছে না। 


অংশীদারিত্বের গণতন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মালিকানা-দল বা ব্যক্তির মালিকানার পরিবর্তে নাগরিকের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে, যা সামাজিক মালিকানার অপর নাম। দলতন্ত্র, ব্যক্তিতন্ত্র বা অভিজাততন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্রকে মুক্ত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’। রাষ্ট্রক্ষমতা দলের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার জন্য প্রতিযোগিতার নামে যে অসুস্থ, ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করে, তার বিকল্প হচ্ছে অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র। যার উদ্দেশ্য- লুটেরাতন্ত্রের বিপরীতে একটি বিকল্প রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দেয়া। ধ্বংসপ্রাপ্ত দলীয় গণতন্ত্রের বিপরীতে অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র এমন একটা ব্যবস্থা যা সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ নয়-বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ ও পারস্পরিক সহযোগিতা রচনা করার ভিত্তি হয়ে উঠবে। সমাজের সকল অংশের অংশগ্রহণের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বিকশিত হবে-একটি সুনির্দিষ্ট ও সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। যারা সংস্কারের দাবি করছেন, যারা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি তুলছেন-তারা কেউ সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থার বা সমাজব্যবস্থার রূপান্তরের কী লক্ষ্য হবে এবং কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে জনগণের মালিকানা বা অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে, তা পুরোপুরি বিবেচনায় আনতে ব্যর্থ হচ্ছেন। প্রচলিত গণতন্ত্র, রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক ব্যবস্থা অব্যাহত রেখে, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং ’২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় পূরণের কোনো উপায় নেই। দলের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে বা কিছুটা বিকেন্দ্রীকরণ করে, নামকাওয়াস্তে কোনো সংস্কার বা কোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের গুণগত রূপান্তর সম্ভব হবে না। একটি অবাধ নির্বাচন হলে, দু’বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হলে, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের নিয়োগ কোনো কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন হলে বা রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ভাগাভাগি করলে, সমাজ ও রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয়ে উঠবে। রাজনীতিবিদদের বিদ্যমান মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। শুধুমাত্র দল ক্ষমতায় গেলেই সব সমস্যা-সংকটের সমাধান করে ফেলবে-এই বিধ্বংসী চিন্তার পরিবর্তন ঘটাতে হবে, পরিবর্তন ঘটাতে হবে মনন ও সাস্কৃতিক স্তরের। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়-ব্যক্তিস্বার্থ ও দলের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার সংস্কৃতি বহু বছরের পুরনো, সার্বিক পরিবেশে অনেকেই এর বাইরে অবস্থান করে না।
দল ক্ষমতায় গেলেই বিকশিত সমাজশক্তির স্বার্থ প্রতিফলিত হবে-এই ভুল দৃষ্টিভঙ্গি কারও কারও মধ্যে দেখা যায়। সেই জন্য অংশীদারিত্বের ব্যবস্থা গড়ে তোলার অন্যতম শর্তটি হচ্ছে-রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেরই মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তন।


অংশগ্রহণভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার নির্যাস হচ্ছে- ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’। এর উদ্দেশ্য হলো এমন একটা সামাজিকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে সমাজের প্রতিটি সদস্য সুযোগ পাবে স্বাধীনভাবে নিজের ক্ষমতা ও যোগ্যতার বিকাশ ঘটানোর । এর মাধ্যমে 
ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরতন্ত্র অকেজো, নিষ্ক্রিয় ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে। প্রচলিত গণতন্ত্র দিয়ে রাষ্ট্রের চরিত্র গণমুখী করা যায় না বরং গণবিরোধী হয়-তা প্রমাণিত।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য পূরণের প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে-সংখ্যা লঘিষ্ঠের তথাকথিত গণতন্ত্রের অবসান করে সংখ্যাগরিষ্ঠের উন্নততর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এতে স্বৈরতন্ত্রের অনেক চিহ্ন, প্রথা-পদ্ধতি বহাল থাকবে, কারণ এই অংশীদারিত্বের প্রাথমিক স্তরেও মানুষের অধিকারের ক্ষেত্রে, সাম্যের ক্ষেত্রে-অসাম্য বজায় থাকবে দীর্ঘকাল। স্বাধীনতার পর স্বৈরতন্ত্রের যে-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার জের থাকবে আরও বহু বছর। সমাজে যে-অসাম্য, তা অসম রাজনৈতিক ব্যবস্থারই প্রতিফলন। সুতরাং গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায়কেন্দ্রিক প্রকৃত গণতন্ত্রীকরণের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে এখনই। ক্ষমতায় নতুনশক্তির অংশগ্রহণ, পুরনো শক্তিকাঠামোর বদল বা পরিবর্তন কিংবা নতুন মেরূকরণই হবে-সংস্কারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে অগ্রাধিকার পাবে শ্রমজীবী ও পেশাজীবী সমাজশক্তি। এটাই হবে দ্বিতীয় স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত ‘প্রজাতন্ত্র’। রাষ্ট্রকে শোষণ ও দমনের হাতিয়ার থেকে জনগণের রাষ্ট্রে রূপান্তরের নতুন তাত্ত্বিক ভিত্তি হাজির করতে হবে।


আর সেই ভিত্তিটিই হলো ‘অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র’। এই ব্যবস্থায় শ্রমজীবী-পেশাজীবী মানুষ শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে কাজ করবে না, তারা কাজ করবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে, বাধা বন্ধনহীনভাবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের সৃজনশীল বিকাশের স্বার্থে। এই নবতর রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কারণে বিপুল পরিমাণ শ্রমশক্তি ও পেশাজীবীদের মেধার সমন্বয়ে, বিশাল উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটবে প্রবলভাবে। শ্রমজীবী মানুষের মধ্যকার ব্যবধান কমে আসবে, সংঘাত-রক্তপাতের প্রবণতা নিম্নমুখী হবে, সমাজে স্থিতিশীল ও সুসামঞ্জস্য ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এই স্তরে বিকাশ ঘটবে প্রকৃত গণতন্ত্রের। এই গণতন্ত্রই হয়ে উঠবে প্রতিটি ব্যক্তির আত্মবিকাশের নামান্তর। উপরিকাঠামোতে সংস্কার বা মেরামত বা জোড়াতালি দিয়ে যে-ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, তা কোনোক্রমেই সর্বজনীন হবে না। গণ-অভ্যুত্থানের পূর্ব এবং গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী রাজনৈতিক মডেল একই রকম থাকবে-তা কল্পনাও করা যায় না। যেখানে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের চেতনা, স্বাধীনতা ও আত্মিক মুক্তির প্রশ্নটি জড়িত-সেখানে স্বৈরতান্ত্রিক মডেল পুনঃস্থাপিত করা বা পুনর্গঠন করা হবে, আত্মদানকারীদের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা। সকল মানুষের রাষ্ট্রীয় রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণের বাস্তবতার উপযোগী বিকল্প রাজনৈতিক মডেল উপস্থাপনে ছোট-বড় সকল রাজনৈতিক দল পিছিয়ে পড়েছে। বড় বড় দলের ক্ষুদ্র চিন্তা এই সমস্যাকে আরও প্রকট করছে। অংশীদারিত্বই হচ্ছে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রের বিকল্প ব্যবস্থা। এর লক্ষ্য হবে কোন দলের শ্রেষ্ঠত্ব নয়, এমন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা- যেখানে দেশের সকল স্তরের জনগণ প্রাধান্য পাবে, অধিকার, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রয়োগের স্বীকৃতি পাবে। এটাই প্রজাতন্ত্রের মর্মবস্তু।


রাষ্ট্রশক্তির দমনাত্বক ও নিপীড়নমূলক ভূমিকার অবসানে গণ-অভ্যুত্থানের পর কোনো রাজনৈতিক শক্তিই বিকল্প প্রস্তাবনা হাজির করেনি। এত নৃশংস গণহত্যা বা লাশের গন্ধ বাতাসে থাকার পরও, বিএনপি ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক দল দাবি উত্থাপন করেনি- র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে নিষিদ্ধ করার। যদি বিএনপি’র মূল দাবি এখন আর র‌্যাব নিষিদ্ধ নয়। এছাড়াও কোনো রাজনৈতিক দল দাবি উত্থাপন করেনি- ডিজিএফআই-এর আইন ও কর্তৃত্ববহির্ভূত ক্ষমতা চিরতরে বাতিল করার। রাষ্ট্রের আটটি গোপন বন্দিশালা কারা কারা প্রতিষ্ঠা করেছিল, তাদেরকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবিও রাজনৈতিক মাঠে অনুপস্থিত। কেউই দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে না-গণহত্যায় ছাত্র-জনতার ওপর পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনী কতো রাউন্ড গুলি নিক্ষেপ করেছে। এসব নৃশংসতার কোনো তদন্তও হচ্ছে না। খুন, হত্যা ও আয়নাঘর সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধীদের শাস্তির মুখোমুখি করা হচ্ছে না। আমাদের  সন্তানদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে আমরা ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। রাষ্ট্রশক্তির সংকোচনের দাবি উত্থাপন করছি না। ফলে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে যে-ঐতিহাসিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, তা বিনষ্ট হতে চলেছে। দলীয় সর্বব্যাপী ক্ষমতা অর্জনের ভয়ঙ্কর রাজনীতি রাষ্ট্রকে আবার বিপর্যয়ের মুখে ফেলবে। 


লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক 
faraizees@gmail.com

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর