চার মাস চিকিৎসা শেষে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর হঠাৎ করেই যেন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা তৈরি হলো। অনেকেই ভেবেছিলেন দেশে ফেরার পর তিনি নিজেই হয়তো নির্বাচনের তারিখ নিয়ে কিছু কথা বলবেন, দলের এতদিনের চাওয়া ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চাইবেন। সেরকম কিছু হলে সরকার ও বিএনপি মুখোমুখি অবস্থানে থাকবে, কিছু মাত্রায় উত্তেজনা তৈরি হবে। কিন্তু সেরকম কিছু হওয়ার আগেই অন্যরকম একটা রাজনৈতিক উত্তাপ যেন তৈরি হয়ে গেল। নির্বাচনের তাগাদা নয়, বরং এমন একটা দাবি নিয়ে রাজপথে নামলো নতুন দল এনসিপি, যাতে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেল।
জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি’র দাবি এখন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা। এ দাবি তারা বেশ কিছুদিন থেকেই করে আসছে। বলছে-আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ না করে কোনো নির্বাচন নয়। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে, শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, বিচার দৃশ্যমান করতে হবে, তারপর হবে নির্বাচন। তাদের এমন সব দাবি মানা সরকারের পক্ষে কতোটুকু সহজ বলা কঠিন। তবে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. ইউনূস একাধিক বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে স্পষ্টই জানিয়েছেন-আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা তার সরকারের নেই। পরে অবশ্য একবার এমনও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নির্ভর করবে সকল রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর।
আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে বলে এখনো মনে হয় না। এখন পর্যন্ত এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামকে এ বিষয়ে খুবই সক্রিয় মনে হচ্ছে। তবে এ কাজে দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক দল বিএনপিকে তেমন কিছু আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। বিএনপি’র দু’একজন নেতা অবশ্য বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সমাবেশে আওয়ামী লীগের অত্যাচারের বর্ণনা দিতে যেয়ে দলটির নিষিদ্ধ করার দাবি উচ্চারণ করেছেন। তবে সেটিকে কখনোই দলের শীর্ষ পর্যায়ের বা সংগঠনের আনুষ্ঠানিক অবস্থান বলে মনে হয়নি।
এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, আওয়ামী লীগ তার পুরো শাসনামলে বিএনপিকে নানাভাবে চাপের মধ্যে রেখেছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে একেবারে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত বিএনপি’র এমন কোনো নেতা পাওয়া যাবে না, যার নামে ১০-২০টা মামলা না ছিল। এসব মামলার সিংহভাগই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই পুরো সময় বিএনপি নেতাকর্মীদের ৮০ শতাংশই হয় জেলে থেকেছে নয় তো এলাকাছাড়া হয়ে থাকতে হয়েছে। হাসিনা সরকারের কাছে এতটা অত্যাচারিত হওয়া সত্ত্বেও বিএনপি কেন আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে মাঠে নামছে না- এমন প্রশ্ন হয়তো কেউ কেউ করতে পারেন। আমার বিবেচনায় বিএনপি এখানে খুবই ঠাণ্ডা মাথায় খেলছে।
বিএনপি বেশ ভালোভাবেই জানে, এনসিপি বা জামায়াত এখন যতই লাফালাফি করুক, রাজনীতির মাঠে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আসলে আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনের মাঠে তাদের প্রতীকসহ অনুপস্থিত থাকে, তাহলে তাদেরই লাভ। কিন্তু তারপরও তারা আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রধান শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায় না। তারা মনে করে, নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ণ শক্তি নিয়ে থাকুক বা না থাকুক, তাতে তাদের সম্ভাব্য বিজয়ে কোনো সমস্যা হবে না। যে নির্বাচনে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত, সেখানে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুপস্থিতি বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তাছাড়া এমনিতেও পশ্চিমা দেশগুলো কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের বিষয়টি কতোটা ভালোভাবে নেবে তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। ফলে ২০১৪ সালের বিরোধী দলবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের জয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেভাবে মূল্যায়িত হয়েছিল, তার পুনরাবৃত্তি বিএনপি’র ক্ষেত্রেও হোক, সেটাই বা তারা চাইবে কেন?
এখানে আরও একটা বিষয় লক্ষণীয়, আওয়ামী লীগকে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করে দিলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? দেশ জুড়ে আওয়ামী লীগের লাখ লাখ সক্রিয় নেতা-কর্মী-সমর্থক রয়েছে, তারা কি রাতারাতি কর্পূরের মতো উবে যাবে? নাকি তাদেরকে ধরে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে মারা যাবে? তারা এই দেশেই থেকে যাবে। কেউ কেউ হয়তো লুকিয়ে থাকবে, আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাবে। এত বিপুল সমর্থনযুক্ত একটা আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি তখন কার জন্য ঝামেলার কারণ হবে? অবশ্যই সরকারে থাকা দলটির জন্য; দ্বিতীয়, তৃতীয় অথবা কোনো স্থানেই না থাকা ছোটখাটো দলের জন্য নয়। কাজেই আওয়ামী লীগকে আন্ডারগ্রাউন্ডে পাঠানো জামায়াত বা এনসিপি’র জন্য ঝামেলা নয়, বরং বিএনপি’র জন্যই হুমকি। বিএনপি সেই ঝুঁকিতে যাবে কেন?
এখানে আরও একটা হিসাব আছে। এটা ভোটের হিসাব। ধরা যাক, এনসিপি ও জামায়াতের আন্দোলনের ফলে সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেই দিলো। এতে ফল কী হবে? আওয়ামী লীগ নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগের যে ভোটগুলো আছে, সেগুলো যাবে কোথায়? সেগুলো নিশ্চয়ই তাদেরকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকায় থাকা এনসিপি বা জামায়াতের বাক্সে যাবে না। বরং নিষিদ্ধের আন্দোলনে মৌন থাকা বিএনপি’র প্রতিই তারা একধরনের কৃতজ্ঞতা অনুভব করবে। এ হিসাবটাও বিএনপি’র নেতৃত্ব বেশ ভালোভাবে বোঝেন।
তাহলে এনসিপি বা জামায়াত কেন বোঝে না? প্রথমে এনসিপি’র কথা বলি। বিষয়টা তারাও বেশ ভালোভাবেই বোঝে, কিন্তু তাদের আসলে এ ছাড়া আর কোনো রাজনীতিই নেই! একটা কথা ভাবুন, এনসিপি রাজনীতিতে এসেছে কেন? তাদের মূল উচ্চারণটা কী ছিল? নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। তা সেই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তটা আসলে কী? এত ঢাকঢোল পিটিয়ে বর্ণাঢ্য আত্মপ্রকাশ, তারপর প্রায় আড়াই মাস হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত তারা কি তাদের ‘নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’র চেহারাটা পরিষ্কার করতে পেরেছে? তাদের রাজনৈতিক বা আদর্শিক রূপরেখাটা আসলে কী? তারা এখন পর্যন্ত তাদের দলের গঠনতন্ত্রই প্রকাশ করতে পারেনি। এদিকে মারাত্মক বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের রাজনৈতিক সমাবেশগুলোতে লোকসমাগম দ্রুততার সঙ্গে হ্রাস পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের জন্য এমন একটা কর্মসূচি খুবই দরকার ছিল, যেটাকে তুলনামূলকভাবে পপুলার হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আর সেই পপুলার মুভমেন্টটাই হচ্ছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি।
এর মধ্যে আর একটা বিষয় নিয়ে একটু আলোচনা করা যেতে পারে। দু’দিন আগে সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, যাকে ড. ইউনূস জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করেছিলেন, তিনি ফেসবুকে একটা বিশ্লেষণধর্মী এবং একই সঙ্গে হতাশামিশ্রিত স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেখানে তাদের বিপ্লব কেন সফল হচ্ছে না তার কিছু অজুহাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন কী করণীয় সে সম্পর্কেও বলা হয়েছে। করণীয় হিসেবে তিনি বলেছেন, সরকারে ছাত্রদের অংশীদারিত্ব আরও বাড়াতে হবে, আর সেই সঙ্গে ছাত্রদের আবারো ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কিন্তু এতদিন পরে এসে, রাজনৈতিক এই বাস্তবতায় তার এইসব সাজেশন কতোটুকু কার্যকর হতে পারে-তা নিয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। তিনি আসলে ছাত্রসমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিই মূলত বলেছেন, আর উপদেষ্টা পরিষদে ছাত্রপ্রতিনিধিদের অনুপাত বৃদ্ধির বিষয়টি আসলে এসেছে ছাত্রদের লোভ দেখানোর জন্য। কিন্তু সেটা কী আর এতদিন পরে সম্ভব? আগস্টের আট তারিখে দু’জন ছাত্র প্রতিনিধিকে যখন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো, তখনই আসলে ছাত্রদের অভূতপূর্ব সেই ঐক্য নষ্টের বীজ বপন করা হয়ে গেছে। এতদিনে সেই বীজ চারাগাছ থেকে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বিষয়টা সাধারণ মানুষও বুঝতে পেরেছে। আর তাই অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তাদের প্রতি মানুষের অনাস্থা বেড়ে গেছে।
সব মিলিয়েই, এই সময়ে এনসিপি’র সামনে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের মুভমেন্ট নিয়ে অগ্রসর হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই। আর জামায়াত যে এ আন্দোলনে এনসিপি’র সঙ্গে আছে, সেটার পেছনেও তাদের নিজস্ব কিছু রাজনীতি রয়েছে। এনসিপি গঠনের সময়েই জামায়াতের চেষ্টা ছিল সেখানে নিজেদের আদর্শগত সংশ্লিষ্টতা বাড়ানোর। সেটা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। কিন্তু বর্তমানে তারা ইসলামপন্থি রাজনৈতিক শক্তির যে ঐক্য নিয়ে কাজ করছে, তাদের সে উদ্যোগে এনসিপিকে সম্পৃক্ত করার আকাঙ্ক্ষা তাদের রয়েছে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের প্রতি তাদের দীর্ঘ দিনের একটা ক্ষোভ তো রয়েই গেছে। তাদের আমীর যতই ‘সকলকে ক্ষমা করে দেয়া’র কথা বলুন না কেন, সুযোগ পেলে জামায়াত তাদের প্রধান শত্রু আওয়ামী লীগকে শেষ করতে শেষ শক্তিটুকুও প্রয়োগ করবে, এটা এক ধরনের ঐতিহাসিক সত্য বলেই বিবেচনা করা যায়।
তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সরকারের ভূমিকা। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার এরই মধ্যে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে। এখন তাদের দুজন উপদেষ্টা সামাজিক মাধ্যমে যে সব কথা লিখেছেন তা থেকে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের আরও দুটো অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হবে। তারা হয়তো প্রতিক্রিয়া দেখতে চাচ্ছে। যদি তেমন বেশি প্রতিক্রিয়া না হয়, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ব্যাপারে অগ্রসর হতে চাইবে তারা। কিন্তু এমন পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের জন্য প্রধান বিবেচ্য বিষয় হবে বিএনপি’র ভূমিকা। বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী বলে, কীভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে, তার উপরই হয়তো নির্ভর করবে অনেক কিছু।