গণ-অভ্যুত্থানের বার্ষিকী উপলক্ষে ১লা জুলাই থেকে সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নানামুখী কর্মসূচি নিয়েছে। ওই দিন বিএনপি বাংলাদেশ চীন মৈত্রী হলে আন্দোলনে শহীদ ও গুম হওয়া পরিবারের স্বজনদের নিয়ে এক সমাবেশ করে, যাতে বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ভিডিও বার্তায় বক্তব্য রাখেন এবং দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দেন। ছাত্রনেতৃত্ব থেকে গড়ে ওঠা জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে দেশব্যাপী তাদের কর্মসূচি শুরু করেছে। আরও কোনো কোনো দল আলাদা কর্মসূচি নিলেও চব্বিশের সেই উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়নি।
চব্বিশে ছাত্রদের আন্দোলনটি সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে শুরু হলেও পরবর্তীকালে সেটা সরকার পতনের একদফায় পরিণত হয়। আন্দোলনে সাধারণ মানুষ সক্রিয় হয়েছিল বৈষম্যহীন একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। বিগত সরকারের আমলে তিনটি নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারেননি। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সর্বত্র দখলবাজি, চাঁদাবাজির সঙ্গে প্রশাসনের সর্বস্তরের দুর্নীতির মহোৎসব মানুষকে ভীষণ ক্ষুব্ধ করেছিল। এক বছর পর দেখা গেল, আইনের শাসনের বদলে একধরনের নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বিএনপি-জামায়াত ট্যাগ লাগিয়ে শায়েস্তা করা হতো। এখন স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে ট্যাগ লাগানো হচ্ছে।
অতি সমপ্রতি বেশ কিছু ঘটনায় নাগরিক নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়েছে। কুমিল্লায় এক সন্ত্রাসী একজন সংখ্যালঘু দরিদ্র নারীকে ধর্ষণ করে এবং সহযোগীরা তার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ভোলায় সন্ত্রাসীদের হাত থেকে স্বামীকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক নারী গণধর্ষণের শিকার হন। চট্টগ্রামের পটিয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা ছাত্রলীগের এক কর্মীকে থানা পুলিশের হাতে দিয়ে বলেছেন, তাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেছেন, মামলা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। কিন্তু ছাত্ররা তা মানতে নারাজ। এ নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয় এবং ছাত্ররা ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে অপসারণের দাবিতে ৭ ঘণ্টা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে। তাদের দাবির মুখে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে সরকার জেলা সদরে সংযুক্তে বাধ্য হয়।
এদিকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানায় হামলা চালিয়ে সাজাপ্রাপ্ত দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। এ হামলায় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)সহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুই পুলিশ সদস্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ২০০-২৫০ জন একযোগে থানা চত্বরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করে। তারা থানার চেয়ার, টেবিল, কম্পিউটার ও ল্যাপটপ ভাঙচুর করে, গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র তছনছ করে, ইটপাটকেল ছুড়ে থানার জানালার কাঁচ ও দরজা ভেঙে ফেলে। পুলিশ তাদের বাধা দিলে উভয়পক্ষে সংঘর্ষ হয়।
পুলিশ জানায়, বুধবার সন্ধ্যায় লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের সরোরবাজার এলাকায় চাঁদাবাজির সময় বেলাল ও সোহেলকে হাতেনাতে আটক করা হয়। পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উত্তম কুমার দাশ ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে তাদের প্রত্যেককে এক মাসের বিনাশ্রুম কারাদণ্ড দেন। এসব ঘটনা আইনশৃঙ্খলার অবনতির চরম বহিঃপ্রকাশ।
গত ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েই সরকারকে বিব্র্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি ও সেনাসদস্যরাও মোতায়েন আছে। তারপরও অপরাধ কমছে না। থেমে থেমে সংঘবদ্ধ সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এই ধরনের একের পর এক আইনের শাসনবিরোধী কাণ্ড চলতে থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে প্রতিশ্রুত নির্বাচনটি করাও সম্ভব হবে না।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পুনরুত্থান কর্মসূচির উদ্বোধন করতে গিয়ে একটি চমৎকার বাক্য উচ্চারণ করেছেন। সেটি হলো স্বৈরাচার যেন আর মাথাচাড়া দিতে না পারে। তিনি এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তার ভাষায়, ‘স্বৈরাচারের প্রথম পাতা মেলার আগেই যেন আমরা তাকে ধরে ফেলতে পারি। ১৬ বছর যেন আমাদের অপেক্ষা করতে না হয়।’
এর মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন, স্বৈরাচার একদিনে সৃষ্টি হয় না। স্বৈরাচার সৃষ্টি হয় ধীরে ধীরে। প্রথমে স্বৈরাচার মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে। পরে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে ব্যবহার করে। যার অসংখ্য নজির মানুষ কেবল গত ১৬ বছর নয়, এর আগেও প্রত্যক্ষ করেছে। কঠিন বাস্তবতা হলো গত ৫৪ বছরে কোনো দল পর পর দু’বার সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। সামরিক শাসন কিংবা জবরদস্তির ভোট করেই তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকতে হয়েছে। বিরোধী দলে থাকতে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। অথচ ক্ষমতায় এসে তারাই ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রায় একক ইচ্ছায় কাজটি করা হয়েছিল।
প্রধান উপদেষ্টা ওই অনুষ্ঠানে তার বক্তৃতায় গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-তরুণের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে লক্ষ্য নিয়ে তরুণ ছাত্র-জনতা, রিকশাচালক, শ্রমিকেরা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে এই অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আমরা গত বছরের প্রতিটি দিনকে আবারো পুনরুজ্জীবিত করবো।’ অভ্যুত্থানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এর পেছনে ছিল একটা বিরাট স্বপ্ন-নতুনভাবে রাষ্ট্রব্যবস্থা বিনির্মাণ, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ।’
মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি, সেই সব তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, রিকশাচালকদের-যারা রাস্তায় নেমে গণতন্ত্রের পতাকা উঁচিয়ে ধরেছিলেন; সাহস, ত্যাগ আর দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।’
প্রধান উপদেষ্টা যেই স্বপ্ন ও প্রত্যয়ের কথা বলেছেন, এক বছর পর সরকার কি তার কাছাকাছি আসতে পেরেছে? এ প্রশ্নের সরল উত্তর হলো সরকার অনেকক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। বৃহত্তর জনগণের ভাগ্যের কোনো বদল হয়নি। গণ-অভ্যুত্থানের মূল কথা ছিল বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গঠন। কিন্তু গত ১১ মাসে বৈষম্য আরও বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ত্রিশ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টা জুলাইকে ঐক্যের মাস হিসেবে অভিহিত করলেও আমরা সবক্ষেত্রে অনৈক্যের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। চব্বিশের জুলাই আগস্টে যে রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতৃত্ব ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে বিজয় এনেছে, আজ তারা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে আছে। কেবল রাজনৈতিক দল নয়, ছাত্রনেতৃত্বও আজ বহুধা বিভক্ত এবং একে অপরকে গণবিরোধী আখ্যা দিতেও দ্বিধা করছে না।
এই গণ-অভ্যুত্থানে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের বেশির ভাগ ছিলেন সাধারণ মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ। ফুটপাথের হকার তার ব্যবসা বাদ দিয়ে, রিকশাচালক তার রিকশা চালনা বন্ধ রেখে, অন্যান্য পেশার মানুষ তাদের নিজ নিজ কাজ বাদ দিয়ে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। প্রথম আলোর সেই বিখ্যাত ছবিটির কথা মনে পড়ছে। রাস্তার ওপর পুলিশের গুলি চলছে। আর রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ একটি পিলারের পেছনে নিজেকে আড়াল করে পুলিশকে পাল্টা ইটপাটকেল ছুড়ছে। এই ছবিটি আমাদের ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে রশীদ তালুকদারের সেই বিখ্যাত ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। একটি ছোট্ট শিশু মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে তুলে আইউব শাহীর বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল। সেই ছেলেটির খোঁজ স্বাধীন বাংলাদেশে পাওয়া গেলেও চব্বিশের জুলাইয়ের অনেক শহীদের পরিচয় পাওয়া যায়নি। তাদের অনেকেই বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে গোরস্থানে শেষ ঠিকানা বেছে নিয়েছেন। কিন্তু সরকার কিংবা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা তাদের খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হয়নি।
অতএব, চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের বার্ষিকী আমাদের সামনে কেবল আশা নিয়ে আসেনি। আশার সঙ্গে আছে আশাভঙ্গের বেদনাও।