ভারতকে ঘিরে অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এরই মধ্যে বন্ধু বলে পরিচিত দেশগুলোও শত্রু দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। ভারত এই ব্যূহ ভেদ করবে কী করে তা নিয়ে নানা স্তরে চলছে আলোচনা। সরকারি নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্তারা রীতিমতো চিন্তিত। ভারত এখন বহুমুখী জটিল নিরাপত্তা পরিবেশের মুখোমুখি। পাকিস্তান তার প্রক্সি যুদ্ধ ও সীমান্ত অতিক্রম করে সন্ত্রাসবাদ চালিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ নিয়ে উত্তেজনা অব্যাহত আছে। সমপ্রতি কলকাতায় অনুষ্ঠিত তিনদিনের যৌথ কমান্ডার্স সম্মেলনে এসব নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এই সম্মেলনে ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর ১৭টি কমান্ডের শীর্ষ পদাধিকারীরা ছাড়াও যোগ দিয়েছিলেন ভারতের সেনা সর্বাধিনায়ক ও তিন বাহিনীর প্রধানরা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই সম্মেলনের উদ্বোধন করলেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সম্মেলনে পুরো সময় উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও এই সম্মেলনে প্রতিরক্ষা সচিবের পাশাপাশি বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দও অংশ নিয়েছিলেন।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এবং প্রতিরক্ষা শিল্পকে স্বল্পমেয়াদি যুদ্ধ থেকে শুরু করে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পর্যন্ত বিস্তৃত নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আধুনিক যুদ্ধে প্রযুক্তি, কৌশল এবং অভিযোজনযোগ্যতার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। অতীতের অভিযানের পাশাপাশি বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা থেকেও শিক্ষা নিতে বলেছেন। অপারেশন সিঁদুরকে প্রযুক্তি-চালিত যুদ্ধের একটি “আকর্ষণীয় প্রদর্শন” এবং দেশীয় অস্ত্রের সাফল্যের প্রদর্শনী হিসেবে অভিহিত করে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভবিষ্যতের যুদ্ধগুলো কেবল সৈন্য বা অস্ত্রের মজুত দ্বারা নয় বরং উদীয়মান প্রযুক্তি দ্বারা পরিচালিত হবে বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
গতবারে দ্বিবার্ষিক যৌথ কমান্ডার্স সম্মেলন হয়েছিল ভূপালে। কিন্তু এবারের সম্মেলনে কলকাতায় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের সদর দপ্তর ফোর্ট উইলিয়ামে তথা বিজয় দুর্গে অনুষ্ঠিত হওয়াকে পর্যবেক্ষক মহল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছেন। অপারেশন সিঁদুর অভিযানের পর চারদিকের পরিস্থিতি যেভাবে দ্রুত বদলাচ্ছে তাতে ভারতের সামনে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ হাজির হয়েছে। এরই মধ্যে ভারতের বন্ধু ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব থাকা সৌদি আরব যেভাবে পরমাণু শক্তিধর দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে তাতে ভারতের চিন্তা বেড়েছে। আরেক বন্ধু দেশ ইরানও সৌদি আরব ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা চুক্তিকে সমর্থন দিয়েছে। অনেকের আশঙ্কা, ইসলামিক ন্যাটো জোট তৈরির লক্ষ্যে এই সব চুক্তির ভূমিকা থাকবে।
যৌথ কমান্ডার্স সম্মেলনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা এই সম্মেলনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, এর মূল লক্ষ্য ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করা এবং একই সঙ্গে পাকিস্তান ও চীন- দুই দিক থেকে আসা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হওয়া। এ ছাড়া নেপাল, বাংলাদেশ ও চীন সংক্রান্ত সীমান্ত সমস্যাও আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছিল। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ভারতের পূর্ব সীমান্তে তৈরি হওয়া চ্যালেঞ্জকে গভীর উদ্বেগের বিষয় বলে অভিহিত করেছে। গোয়েন্দা ব্যুরোর এক কর্মকর্তা নিকট সীমান্ত প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেছেন, সেখানে সরকার পরিবর্তনের পর উগ্রপন্থি উপাদানের উত্থান, পাকিস্তান ও চীনের প্রভাব বিস্তারের সক্রিয় চেষ্টা এবং দেশটিতে ক্রমবর্ধমান ভারতবিরোধী মনোভাবের তীব্রতা আমাদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ। তিনি আরও উল্লেখ করেন, বছরের পর বছর বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ বেড়েছে, যা পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের সীমান্তবর্তী জেলার জনসংখ্যাগত ভারসাম্যে প্রভাব ফেলেছে এবং ভারতের নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। শীর্ষ সামরিক নেতৃত্ব লাদাখের পূর্বাঞ্চল এবং পূর্ব সেক্টরে চীনের সঙ্গে সীমান্ত অচলাবস্থার সার্বিক পর্যালোচনাও করেছেন। আবার হঠাৎ করে নেপালের জেন-জি আন্দোলনের ফলে পরিস্থিতির যে পরিবর্তন ঘটেছে তার দিকেও ভারতকে নজর রাখতে হয়েছে।
ইন্দো-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের আক্রমণাত্মক অবস্থান এবং লাদাখ, অরুণাচল প্রদেশ ও সিকিম সীমান্তে পিপলস লিবারেশন আর্মির সঙ্গে চলমান অচলাবস্থা ভারতের জন্য পরোক্ষ হুমকি তৈরি করছে। অতি সমপ্রতি চীন ভারত মহাসাগরে একটি ক্ষেপণাস্ত্র এবং উপগ্রহ ট্র্যাকিং জাহাজ মোতায়েন করেছে। মোতায়েন করা ইউয়ান ওয়াং-৫ হলো তৃতীয় প্রজন্মের একটি চীনা ‘গুপ্তচর’ জাহাজ। এটি পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) শাখা স্ট্র্যাটেজিক সাপোর্ট ফোর্স (এসএসএফ) দ্বারা পরিচালিত হয়।
এই সার্বিক জটিল নিরাপত্তা হুমকিজনক পরিস্থিতির বিচারে ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতোটা প্রস্তুত, পরিকাঠামোগত দুর্বলতাই বা কেমন তা নিয়ে আলোচনাই সম্মেলনে প্রাধান্য পেয়েছিল। ভবিষ্যৎ সক্ষমতা গড়ে তোলা, যৌথ ও সমন্বিত প্রতিক্রিয়ার জন্য সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি এবং শান্তি ও যুদ্ধ- উভয় সময়ে কাজের প্রক্রিয়ায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার বিষয়গুলোও আলোচিত হয়েছে।
আর সেই আলোচনাতেই প্রতিরক্ষা খাতে নানা দুর্বলতা বিভিন্ন কর্তাব্যক্তিদের আলোচনায় উঠে এসেছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বহুমুখী নিরাপত্তা হুমকি ও গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। শীর্ষ সেনা আধিকারিকরাও স্বীকার করেছেন, প্রতিরক্ষা সক্ষমতায় উদ্বেগজনক ঘাটতি বিদ্যমান।
তেজস যুদ্ধবিমান সরবরাহে উৎপাদক সংস্থা দেরি করায় ভারতীয় বিমান বাহিনী উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। অথচ চীন ইতিমধ্যেই তার ষষ্ঠ প্রজন্মের স্টেলথ যুদ্ধবিমান প্রদর্শন করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে। অন্যদিকে ভারতের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এখনো নকশা ও উন্নয়ন পর্যায়ে রয়েছে। নৌবাহিনীও পর্যাপ্ত যুদ্ধবিমান ছাড়াই বিমানবাহী রণতরী পরিচালনা করছে এবং অন্য ঘাটতির সঙ্গেও লড়ছে।
ভারতের সশস্ত্র বাহিনীতে জনবলের ঘাটতিও উদ্বেগজনক। সরকারি সূত্রে জানানো হয়েছে, সেনাবাহিনীতে এক লাখেরও বেশি সৈন্যের ঘাটতি রয়েছে। তিন বাহিনীতে মিলিতভাবে মোট প্রায় ১.৪০ লাখ জনবলের অভাব রয়েছে।
এর আগে ভারত ফ্রান্সের কাছ থেকে ৩৬টি রাফাল যুদ্ধবিমান ও ছয়টি স্করপিন শ্রেণির সাবমেরিন ক্রয় করেছে। এ বছরের এপ্রিল মাসে ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য ২৬টি রাফাল-এম যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি হয়েছে। অবশ্য বিশ্বের নানা দেশ থেকে যুদ্ধাস্ত্র আমদানি করার পাশাপাশি ভারত নিজস্ব উদ্যোগেও যুদ্ধ বিমান তৈরির কাজে হাত দিয়েছে। এর ইঞ্জিনের জন্য ফ্রান্স ও রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনাও চলছে।
বিশেষজ্ঞরা জোর দিয়ে বলেন, আধুনিক যুদ্ধ ও প্রতিবেশী অঞ্চলে তৈরি হওয়া হুমকি মোকাবিলায় ভারতকে জরুরি ভিত্তিতে সমরাস্ত্রের যোগান বাড়ানো সহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার কাজে গুরুত্ব দিতে হবে।
প্রায় দুই বছরের স্থবিরতার পর ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থার (ডিআরডিও) ব্যাপক পুনর্গঠন পরিকল্পনা আবারো আলোচনা শুরু হয়েছে। উদ্দেশ্য হলো এই সংস্থাকে জাতীয় নিরাপত্তার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে আরও দক্ষ এবং কৌশলগতভাবে ক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা।
ভারতের সামরিক নেতৃবৃন্দ মনে করছেন, সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা জরুরি। সেজন্যই তৈরি করা হচ্ছে অভিন্ন ‘এডুকেশন কোর-এর অধীনে তিনটি সংযুক্ত সামরিক কেন্দ্র (জয়েন্ট মিলিটারি স্টেশন)। স্থলসেনা, নৌসেনা এবং বায়ুসেনার জন্য অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার সমন্বয় ব্যবস্থা আরও সুসংহত করবে বলে মনে করছেন সামরিক পর্যবেক্ষকেরা।
বর্তমানে ভারতীয় স্থলসেনা, নৌসেনা এবং বায়ুসেনার দেশ জুড়ে পৃথক পৃথক কমান্ড রয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো, ‘থিয়েটারাইজেশন ‘পদ্ধতির মাধ্যমে তিন বাহিনীর ভিন্ন ভিন্ন কমান্ডের পরিবর্তে অভিন্ন ‘থিয়েটার কমান্ড’ গঠন। আমেরিকা, রাশিয়া, চীনের মতো দেশের সশস্ত্র বাহিনীতে এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এর ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার। বাড়বে শত্রুর মোকাবিলার ক্ষমতাও।
কিন্তু এই সব পদক্ষেপ কার্যকর করতে সময় লাগবে। তাই জরুরি ভিত্তিতে বর্তমান নিরাপত্তা হুমকির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা ভারতের পক্ষে বেশ কঠিন বলেই মনে করছেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। অবশ্য অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, কেবল প্রতিরক্ষা প্রস্তুতি নয় বরং পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রযোজন একটি সক্রিয় কৌশলও। যে দেশ প্রযুক্তি, কৌশল এবং অভিযোজন ক্ষমতার ত্রিভুজ আয়ত্ত করবে, তারাই প্রকৃত বিশ্ব শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে।