সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের থাকা না থাকার বিষয়টি রাজনৈতিক প্রশ্ন। সাংবিধানিক প্রশ্ন নয়। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। কিন্তু এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ আছে। বিএনপি’র প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, ‘সাংবিধানিক সমস্যা তৈরি হয় এমন কিছু করা যাবে না। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী বা এবি পার্টি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদচ্যুতি ও দেশত্যাগের পর তাঁর মনোনীত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন স্বপদে থাকতে পারেন কি-না, বিতর্কটা শুরুতেও উঠেছিল। তবে সেই সময়ে আন্দোলনে বিজয়ী শক্তির মনোনীত উপদেষ্টা পরিষদ রাজনৈতিক বিতর্ক এড়িয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। ৮ই আগস্ট রাষ্ট্রপতির কাছেই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা শপথ নেন।
বিতর্কটা নতুন করে ওঠে সমপ্রতি মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সম্পাদিত জনতার চোখ-এ প্রকাশিত রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎকারমূলক একটি লেখা থেকে। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে পদত্যাগ করেছেন, তার দালিলিক প্রমাণ তাঁর কাছে নেই। তিনি শুনেছেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে গেছেন। একই কথা মাসখানেক আগে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও বলেছিলেন। সে সময় তেমন প্রতিক্রিয়া হয়নি। এবার হলো।
এখানে রাষ্ট্রপতির দু’টি ভিন্ন বক্তব্য। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। অন্যদিকে সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছেন, পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই। প্রথমটি সত্য হলে দ্বিতীয়টি অসত্য। আর সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র কোথায়?
অতীতেও পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপে পূর্বসূরি রাষ্ট্রপতিরা যে সব সময় সত্য কথা বলেছেন, তা নয়।
১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের ভাষণের কথা আমরা মনে করতে পারি। তিনি তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারকে অথর্ব ও দুর্নীতিবাজ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পরে বিচারপতি স্বীকার করেছেন, এটা তাঁকে দিয়ে এরশাদ জোর করে বলিয়েছেন। একইভাবে ২০০৭ সালে ১/১১-তেও রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তাঁর নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ ভেঙে দেয়ার সময়ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর দোষ চাপিয়েছিলেন।
মো. সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের ২৩তম রাষ্ট্রপতি। এর আগে আরও ২২ জন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁদের বিদায় হয়েছে বিষণ্ন ও করুণ। আমাদের দুজন সাবেক রাষ্ট্রপতি হত্যার শিকার হয়েছেন, একাধিক রাষ্ট্রপতি অপমানজনকভাবে বিদায় নিয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রথম দফায় ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৯৭২ সালের ১২ই জানুয়ারি পর্যন্ত এই পদে ছিলেন (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী)। যদিও তিনি পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকার কারণে এই সময়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দেশে ফিরে সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং ১২ই জানুয়ারি রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। একই সময়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। সরকারের সঙ্গে কাজ করতে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর টক্কর লাগে।
১৯৭৩ সালের ২৪শে ডিসেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ালে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মোহাম্মদউল্লাহ। ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সংসদীয় পদ্ধতি বাতিল করে একদলীয় রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসন জারি করেন এবং নিজেই রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁর এই দায়িত্বও স্থায়ী হয়নি।
একই বছরের ১৫ই আগস্ট এক রক্তাক্ত সেনা অভ্যুত্থানে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। এই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেন ফারুক-রশীদসহ একদল তরুণ সেনা কর্মকর্তা এবং তাঁরা নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেন খন্দকার মোশ্তাক আহমদকে, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা।
খন্দকার মোশ্তাক আহমদের শাসনও ছিল অস্থায়ী। ৩রা নভেম্বর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থান হলে ৬ই নভেম্বর মোশ্তাককে পদত্যাগ করতে হয়। নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নেয়া হয় সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে। এরপর ৭ই নভেম্বর ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লবে’ খালেদ মোশাররফ ও তাঁর দুই সহযোগী নিহত হন। ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হন জিয়াউর রহমান। সে সময় তিনি নিজে রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধান সামরিক শাসকের পদ না নিয়ে সেই পদে বিচারপতি সায়েমকেই রেখে দেন।
১৯৭৭ সালের ২১শে এপ্রিল জিয়াউর রহমান নিজেই এই পদে বসেন এবং সায়েমকে পদত্যাগে বাধ্য করেন, যার বিবরণ ‘অ্যাট বঙ্গভবন: লাস্ট ফেইজ’ বইয়ে আছে।
এরপর জিয়া সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। ১৯৮১ সালের ৩০শে মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। একই দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। পরে ওই বছরের ১৫ই নভেম্বরের নির্বাচনে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
কিন্তু নির্বাচনের আগেই সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দেশ পরিচালনায় অংশীদারত্বের দাবি সামনে আনেন এবং ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে তিনি ক্ষমতা দখল করেন। এরশাদও সেদিন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব না নিয়ে বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে এই পদে বসান। ১৯৮৩ সালের ১১ই ডিসেম্বর তাঁকে সরিয়ে নিজেই রাষ্ট্রপতি হয়ে বসেন। দুই সেনা শাসকের রাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রক্রিয়া প্রায় একই রকম। তাঁরা এ জন্য গণভোটও করেন।
এরপর ১৯৮৬ সালের ২৩শে অক্টোবর প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের মাধ্যমে সেটাকে জায়েজ করেন। গণ-অভ্যুত্থানে নব্বইয়ের ৬ই ডিসেম্বর পদত্যাগের আগ পর্যন্ত এরশাদ রাষ্ট্রপতি পদে বহাল ছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্যের ভিত্তিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত হয় প্রথম অন্তর্বর্তী সরকার, যাঁরা একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করে প্রশংসিত হন। এই নির্বাচনে বিএনপি ১৪৬টি আসন পেয়ে জামায়াতের সহায়তায় সরকার গঠন করে।
বিচারপতি সাহাবুদ্দীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯১ সালের ৯ই অক্টোবর পর্যন্ত। ওই দিন বিএনপি’র মনোনীত প্রার্থী আবদুর রহমান বিশ্বাস নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ৯ই অক্টোবর পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনিই প্রথম ৫ বছরের মেয়াদ পূরণ করেছেন। তাঁর সময়ে একটি সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা হলেও সফল হয়নি।
আবদুর রহমান বিশ্বাসের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে রাষ্ট্রপতি হয়ে আসেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। প্রথমদিকে সরকারের সঙ্গে তাঁর কর্মসম্পর্ক মোটামুটি ভালো ছিল। কিন্তু ২০০১-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। আওয়ামী লীগের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশন ও লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে মিলে আওয়ামী লীগকে হারিয়েছেন। তারা নির্বাচন বাতিল করতে তাঁকে চাপও দিয়েছিলেন। কিন্তু সাহাবুদ্দীন আহমদ রাজি হননি।
ওই বছরের ১৪ই নভেম্বর পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি পদে বহাল ছিলেন। একই দিন বিএনপি’র মনোনীত প্রার্থী বদরুদ্দোজা চৌধুরী নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধের কারণে ২০০২ সালের ২১শে জুন তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। ৬ই সেপ্টেম্বর নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তিনি ২০০৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই পদে বহাল ছিলেন। এরপর রাষ্ট্রপতি হন জিল্লুর রহমান। তাঁর মেয়াদকাল ছিল ২০০৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ২০শে মার্চ।
এরপর সংসদের স্পিকার হিসেবে মো. আবদুল হামিদ মাত্র কয়েকদিনের জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং ২৪শে এপ্রিল ২০১৩ থেকে ২৩শে এপ্রিল ২০২৩ পর্যন্ত দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গভবনে একমাত্র তাঁর বিদায়ই ছিল বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ। যদিও স্বাভাবিকভাবেই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী দলগুলোর কোনো নেতা সেই বিদায় অনুষ্ঠানে যাননি।
২০২৩ সালের ২৩শে এপ্রিল নতুন রাষ্ট্রপতি হন মো. সাহাবুদ্দিন। এর আগে সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে যাদের নাম শোনা গিয়েছিল- তাদের মধ্যে সাহাবুদ্দীন ছিলেন না। কেন শেখ হাসিনা তাঁকেই মেনে নিয়েছিলেন, সেটা রহস্য বটে।
আমাদের সরকারগুলো রাষ্ট্রপতিকে কী ধরনের মর্যাদা দেয়, তার একটি উদাহরণ তুলে ধরেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। বিএনপি সরকারের আমলে অর্থ মন্ত্রণালয় দুর্নীতির অভিযোগে একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সরিয়ে দেয়া এবং সেই পদে অপর একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ সংবলিত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠালে তিনি সেটি আটকে দেন। রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস ও অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের সম্পর্ক ভালো ছিল না। এই পটভূমিতে অর্থমন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘তুমি কি মনে করো বঙ্গভবনের বাঁটকু লোকটি দেশ চালাচ্ছেন?
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি কেবল প্রধানমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ব্যতীত অন্য সব কাজ করবেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একবার বলেছিলেন, মিলাদ পড়া ও মাজার জেয়ারত করা ছাড়া তাদের কোনো কাজ নেই। বিএনপি সরকারের আমলে নির্বাচিত একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবন থেকে রওনা হয়েছিলেন, পরে তাঁকে রাষ্ট্রাচারের কথা বলে ঠেকানো হয়।
অনেকে মনে করেন, যেই প্রধানমন্ত্রী দেশত্যাগ করেছেন, তাঁর পদত্যাগ করা আইনি দৃষ্টিতে কোনো গুরুত্ব বহন করে না। সোমবার বঙ্গভবন থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বিষয়টি মীমাংসিত বলে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু সেই বিবৃতির পরও যে মো. সাহাবুদ্দিনের রাষ্ট্রপতি পদে থাকা না থাকার প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি। আন্দোলনকারীদের একাংশ বঙ্গভবন ঘেরাও করেছেন, আরেক অংশ বলছেন, ঘেরাও করার প্রয়োজন নেই- জনগণের মনোভাব তারা জেনে গেছেন।