সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের মন্তব্যে বাংলাদেশ তো বটেই, পুরো দুনিয়া, বিশেষ করে ভারতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন যে কথা বলেছেন, তার সারমর্ম হলো শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনো দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই। প্রকৃতপক্ষে তিনি হাসিনার পদত্যাগপত্র পাননি। তার এ মন্তব্য ঘিরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। উল্লেখ্য, দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপকালে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন বলেন, তিনি শুনেছেন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তাঁর কাছে কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। সাক্ষাৎকারধর্মী এই প্রতিবেদনটি রাজনৈতিক সাপ্তাহিক ‘জনতার চোখ’-এ ২০শে অক্টোবর সংখ্যায় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রকাশের পর দেশ ও দেশের বাইরে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যেও অস্বস্তি দেখা দেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চেয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ও আল্টিমেটাম দেয়।
ভারতের অনলাইন স্ক্রল প্রশ্ন তুলেছে- তাহলে হাসিনাকে কি এখনো বাংলাদেশের বৈধ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করা যায়? তাদের শিরোনাম- ক্যান হাসিনা স্টিল বি কনসিডারড বাংলাদেশজ লেজিটিম্যাট প্রিমিয়ার? প্রেসিডেন্টস রিমার্কস স্পার্কস স্টর্ম। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার প্রায় আড়াই মাস পরে নতুন এক বিতর্কের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রশ্ন উঠেছে নোবেল পুরস্কার পাওয়া প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকলেও শেখ হাসিনা কি এখনো বৈধ প্রধানমন্ত্রী কিনা তা নিয়ে। শুরুর দিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন বলে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন। কিন্তু এখন তার মন্তব্যের ফলে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিনকে কঠিন এক পরিস্থিতিতে ফেলেছে। তার ওই মন্তব্যের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সোমবার বলেছেন, এমন দাবি করে প্রেসিডেন্ট অসততার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। ওদিকে আনন্দবাজার পত্রিকার শিরোনাম- ‘বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের প্রচ্ছন্ন হুমকি! হাসিনা-পদত্যাগ মন্তব্যে খুশি নয় অন্তর্র্বর্তী সরকার’। হাসিনা আদৌ প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন কিনা, তা নিয়েই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে ওই মন্তব্যে। দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, হাসিনার পদত্যাগের কোনো প্রামাণ্য নথি তার হাতে নেই। সাহাবুদ্দিনের এমন মন্তব্যে অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের একাংশ উষ্মা প্রকাশ করেছেন। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের অভিযোগ, রাষ্ট্রপতি ‘মিথ্যাচার’ করছেন। রাষ্ট্রপতির এই ধরনের মন্তব্যে ক্ষুব্ধ আসিফ বলেন, এটি তার (রাষ্ট্রপতির) শপথ লঙ্ঘনের শামিল। এতে বলা হয়, তিন মাসের বেশি সময় অতিক্রান্ত, হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়েছেন। বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সম্মতিক্রমে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনেরও আড়াই মাসের অধিক সময় পার হয়ে গিয়েছে। এতদিন পর প্রেসিডেন্টের এই মন্তব্যকে ‘স্ববিরোধী’ বলেও কটাক্ষ করেছেন আইন উপদেষ্টা। প্রেসিডেন্টকে অপসারণের প্রচ্ছন্ন ‘হুমকি’-ও দিয়ে রেখেছেন তিনি। আসিফ বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী যদি আপনার শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা না থাকে, বা যদি কোনো গুরুতর অসদাচরণ করেন- সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি পদে আপনি থাকতে পারেন কিনা, তা বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে।”
কী কারণে রাষ্ট্রপতির মন্তব্যকে ‘স্ববিরোধী’ বলছে অন্তর্র্বর্তী সরকার? তার আভাস পাওয়া যেতে পারে ৫ই আগস্ট জাতির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের ভাষণে। হাসিনা দেশ ছাড়ার পর তিনি সেই ভাষণ দিয়েছিলেন। সাহাবুদ্দিন নিজেই সেই দিনের ভাষণে জানিয়েছিলেন, হাসিনা তার কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং তিনি তা গ্রহণ করেছেন। সেই মন্তব্যের প্রায় আড়াই মাস পর এসে তিনি সাক্ষাৎকারে জানালেন, হাসিনার পদত্যাগের কোনো প্রামাণ্য নথি তার হাতে নেই। তিনি কেবলই শুনেছেন যে হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। এই বিতর্কের আবহেই বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের বাসভবন ‘বঙ্গভবন’ থেকে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। তবে এই বিবৃতির পরও বিতর্ক থামছে না। অন্তর্র্বর্তী সরকারের অন্দরে তো বটেই, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরাও এই মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। সমাজমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করেছেন অনেকেই। ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ’র বক্তব্য, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ‘হাসিনা এবং অবৈধ সরকারকে’ উৎখাত করা হয়েছে। এখানে পদত্যাগের কোনো ভূমিকা নেই বলেই মনে করছেন তিনি।
অনলাইন টাইমস অব ইন্ডিয়ার শিরোনাম- ‘নো কপি অব শেখ হাসিনাস রিজাইনেশন লেটার’: বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট রিকাউন্টস মেহেম অব আগস্ট ৫। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বলেছেন, শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী পদ ত্যাগ করার কোনো দালিলিক প্রমাণ তার কাছে নেই। ৫ই আগস্ট যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে তিনি হয়তো সময় পাননি। সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে তাদের দু’জনের মিটিং হওয়ার কথা ছিল। তিনি বলেছেন, এর এক ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি ফোন আসে। তাতে বলা হয়, তিনি আসছেন না। তিনি এক পর্যায়ে আমাকে কিছু না জানিয়ে পালিয়ে গেছেন বলে শুনেছি। ওই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় মানবজমিন পত্রিকার সাপ্তাহিক প্রকাশনা জনতার চোখ-এ। সাক্ষাৎকারে তিনি যেসব কথা বলেছেন, তা তুলে ধরা হয় এই রিপোর্টে।
ওদিকে বার্তা সংস্থা পিটিআই-এর সংবাদের শিরোনাম- ‘নো ডকুমেন্টারি এভিডেন্স অব হাসিনাজ রিজাইনেশন অ্যাজ পিএম, সেজ বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট’। এতে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন বলেছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আগস্টের শুরুতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেছেন শেখ হাসিনা এমন কোনো দালিলিক তথ্যপ্রমাণ তার কাছে নেই। তিনি শুনেছেন হাসিনা পালানোর আগে পদত্যাগ করেছেন। দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, তার কাছে এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই। তিনি ডকুমেন্ট হাতে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট বলেছেন, সম্ভবত তিনি সময় পাননি। এ রিপোর্টেও ওই সাক্ষাৎকারের বেশির ভাগ অংশ তুলে ধরা হয়েছে। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার সাপ্তাহিক প্রকাশনা ‘জনতার চোখ’-এ। সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্টের মন্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ্ত