বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আড়াই মাস পেরিয়ে গেল। জগৎ বিখ্যাত অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে যতটা সুস্থিতি আশা করা গিয়েছিল কেন যেন এখনো ততটা দেখা যাচ্ছে না। নানাজনের নানারকম হুমকি-ধামকি, অনেকেই বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। কেমন যেন এখনো অনেকেরই নিজেকে জাহির করা নিয়ে ব্যস্ত। কিছুদিন আগে ঊর্মি নামে এক নিম্নস্তর সরকারি কর্মচারী অধ্যাপক ড. ইউনূসের সরকারের পতনের কাউন্টডাউন শুরু করেছিলেন। আন্দোলনের সময় রংপুরের আবু সাঈদকে নিয়ে নানা রকমের কটূক্তি করেছেন, যার ভাবনা যেমন তার কথা বা বক্তব্য তেমনটাই হবে। এক্ষেত্রে কারও কোনো কথা বা বক্তব্য নিয়ে শোক আফসোস্ থাকার কথা নয়। কিন্তু সরকারি কাজে নিয়োজিত সরকারি কর্মকর্তা স্বাধীন না, সে রাষ্ট্রের অধীন, আইনকানুনের নিয়ন্ত্রণে। তিনি ইচ্ছা করলেই যা খুশি তা করতে বা বলতে পারেন না। অথচ এক্ষেত্রে তেমনটাই করেছেন। সরকার অবৈধ, না বৈধ- এটা কোনো সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তার বিবেচ্য হতে পারে না। যদি সরকারকে পছন্দ না হয় তাহলে পদত্যাগ করে তিনি যা খুশি তা বলতে পারেন। যেখানে সবাই এক হবেন সেটা যতক্ষণের জন্যই হোক ইস্পাতকঠিন ঐক্য যেকোনো বিজয়ের চাবিকাঠি। জুলাই-আগস্টের সফল আন্দোলন তার প্রমাণ। সাধারণ মানুষের প্রতি এক সময় কতো অবহেলা, কতো তাচ্ছিল্য সেই মানুষ যখন একত্র হয়েছিল সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। এই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী ছিল। সুতো টানলে ছিঁড়ে যায়। অন্যকে উপেক্ষা করলে একটা সময় তার বদলা পেতে হয়। যে যাই বলুন, শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মতো, বঙ্গবন্ধুর কন্যার মতো কখনো কোনো আচরণ করেননি। বাংলার সংসারে সতীনের যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বা ঘৃণা তার চাইতে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। যার ফল ভোগ করছে জাতি। কোনো সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ বলতে পারে, ‘আমি সীমান্তের কাছাকাছি আছি, টুপ করে ঢুকে পড়বো।’ এসব কি ছেলেখেলা! একটু ভেবে দেখার দরকার ছিল না? মনে রাখা উচিত, কথাই কর্তৃত্ব করে, কথাই নেতৃত্ব করে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কখনো কোনো কথা ভালোভাবে ভেবে বলতে চাননি, বলেনওনি। যিনি জীবনে বহুবার ‘ছাতার বাংলাদেশ, ছাইয়ের আওয়ামী লীগ’ এরকম গুরুতর অবমাননাকর কথা বলেছেন। তার কাছ থেকে দেশ এবং জাতি কী আশা করতে পারে। সেদিন তার এক ভিডিও শুনলাম। এসব করে লাভের চাইতে ক্ষতিই বেশি হবে। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই তিনি ভাবতে পারেন, তিনি আবার ফিরবেন, আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন। মূর্খের দলের মানুষ আমি। আমার তেমন অনেক কিছুই জানা নেই। নিজের জীবনের কড়কড়ে অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু বলতে পারি, তাতে তাকে আবার ক্ষমতায় আসতে হলে ১৫-২০ বছর সময় দিতে হবে। তার মধ্যে ১০ বছর জেলেও থাকতে হতে পারে। এই ১৫-২০ বছরে একজন সফল রাজনীতিক হিসেবে তার কোনো ভুল করা চলবে না। প্রতিটি ভুল তার রাজনীতিতে ফিরে আসা মানুষের অন্তরে জায়গা নেয়া এক বছর করে পিছিয়ে দেবে। আমার এই কড়কড়ে সত্য হয়তো অনেকের ভালো লাগবে না। কিন্তু এটাই বাস্তব- এটাই সত্য। আজ যারা পাদপ্রদীপের নিচে তাদেরও সংযত হয়ে চলতে হবে। সব অসংযতের একই পরিণতি। কোনো হেরফের নেই। যে সংযত থাকতে পারবে- যে কান পেতে মানুষের আনন্দ-বেদনার কথা শুনতে পারবে- তাদের পাশে দাঁড়াতে পারে সেই বা তারাই টিকে থাকে। তবে কেউ কিয়ামত পর্যন্ত নয়। সবাইকে একটা সময় পর্যন্ত সুনাম ও দুর্নাম নিয়ে টিকে থাকতে হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এখনো তেমন গতি দেখছি না। ঊর্মিকে প্রথম ওএসডি করা হয়েছিল। এখন শুনছি বরখাস্ত করা হয়েছে। কোনো রাষ্ট্রদ্রোহীর বরখাস্ত তো শেষ কথা হতে পারে না। তার প্রতি আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সে কার বেটি-ভাতিজি এসব দেখার সুযোগ নেই। সুযোগ একটাই- আইনের শাসন, ন্যায়ের শাসন, সত্যের শাসনে যা করা দরকার তা করতে হবে। গত কয়েক বছর প্রতি মুহূর্তে শুনছি, বাংলাদেশ নাকি উন্নয়নের রোল মডেল। এটা সত্য দালানকোঠা, রাস্তাঘাটে দেশটা ছেয়ে গেছে। কিন্তু যেভাবে সাধারণ মানুষের মাথায় ঋণের বোঝা চাপানো হয়েছে সেটা একটু বিবেচনা করে দেখা দরকার। বেশি দূরে যাচ্ছি না, আন্দোলনের সময় মেট্রোরেলের দু’টি স্টেশন ধ্বংস হয়েছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে একজন শহীদকেও দেখতে যাননি। তিনি ধ্বংসপ্রাপ্ত স্টেশন দেখতে গিয়েছিলেন এবং প্রচুর কেঁদেছিলেন। নেত্রী হাসিনার জায়গায় আমি হলে পুরো মেট্রোরেল ধ্বংস হয়ে গেলেও একজন শহীদের জন্য যতটা চোখে পানি ঝরতো, মেট্রোরেলের জন্য তার কানাকড়িও ঝরতো না বা পড়তো না। সমস্যা হলো এখানেই। সমস্যা হলো চেতনার, অনুভূতির। তার চোখে পানি আসে মেট্রোরেল ধ্বংসে, আমাদের চোখে পানি আসে একটি আত্মার বিসর্জনে। এক্ষেত্রেও দেখুন কতো খেল। কাঁদতে কাঁদতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, স্টেশন দুটো চালু করতে দু’এক বছরের কম লাগবে না, খরচ হবে ৫-৭ শ’ কোটি টাকা। অথচ একটি ২০ দিনে, আরেকটি ৮৮-৯০ দিনে চালু হয়েছে। একটিতে খরচ হয়েছে ২০ লাখ ৫০ হাজার, অন্যটিতে ১ কোটি ২৫ লাখ। যেহেতু এদিক ওদিক থেকে এটা ওটা এনে চালু করা হয়েছে এসবের জন্য আরও ১৬-১৭ কোটি টাকা খরচ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৭+১=১৮ বা ১৯-২০ কোটি, অন্যদিকে ৫০০-৭০০ কোটি কি এক? শেখ হাসিনা থাকলে, তার সরকার থাকলে ৭০০ কোটি টাকা খরচ হতো, টাকাটা কোথায় যেতো? এভাবে দেশের টাকা, সাধারণ মানুষের টাকা আত্মসাৎ করার জন্য কারও কোনো বিচার হবে না? হওয়া উচিত না? মানলাম দাঙ্গা-হাঙ্গামার জন্য প্রতিদিন মামলা হচ্ছে। মন্ত্রী, এমপি, নেতা, পাতি নেতা আসামি হচ্ছে। কিন্তু দেশের অর্থ তছরুপের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো কিছু হচ্ছে না। শেখ হাসিনার প্রচণ্ড অহংকার ছিল। এখন যারা সরকার চালান তারাও কি অহংকারী? তা তো হওয়ার কথা না। পদ্মা সেতু আমাদের জন্য গৌরবের, গর্বের। ধ্বংসপ্রাপ্ত মেট্রোস্টেশন মেরামতে যা দেখছি পদ্মাতেও যে তা হয়নি তা কে বিচার করবে? অবিবেচকের মতো পদ্মাতে অধ্যাপক ইউনূসকে টুপ করে চুবিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। কথাটা মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। ৬৩ ফুট প্রস্থ পদ্মা সেতুতে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি প্রস্থ রেললাইন করা হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এখন সিঙ্গেল লাইনের মূল্য নেই। পদ্মার উপর দিয়ে অনায়াসে ৪-৬টি লাইন বসানো যেতো। ৪টির বদলে ৩টি, একেবারে না হলেও ২টি লাইন বসালে কিছুদিন নিরাপদে চলা যেতো। শুনেছি, এখনই নাকি রেলের পারাপার হতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। দু’এক বছর পর ঢাকা শহরের যানজট পদ্মা সেতুতে রেললাইনেও লাগবে। তাই ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। বিষয়টা খুবই দৃষ্টিকটুর এবং অবিবেচনাপ্রসূ হয়েছে। এসবের প্রতিকার হওয়া বাঞ্ছনীয়। না হলে এই ধরনের ঘোড়া রোগ বাড়তেই থাকবে। সত্যিই আমরা সঠিক পথে এগুতে পারলে খুব অল্প সময়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারতাম। কিন্তু মনে হয় আমরা নিজেরাই জানি না আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য কি। নেত্রী শেখ হাসিনার গোঁ ছিল, বিএনপি যা করে সব খারাপ, জামায়াত যা করে সব খারাপ। তিনি ছাড়া অন্যেরা যা-ই করে সবই খারাপ। এখনো যদি তেমনটাই হয় তাহলে তো মারাত্মক মুশকিল। দেশ কি চায়, জাতি কি চায়, বিশ্ব কি চায়- আমাদের সেদিকে একটু ভেবে দেখা দরকার। যদি আমরা তা পারতাম তাহলে এই যে অস্বস্তি-অশান্তি এর অনেকটাই আপনা-আপনি দূর হয়ে যেতো। কিন্তু তা আমরা পারছি কই? যেভাবে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে তাতে অনেক কিছু ওলটপালট হবে- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যা উল্টানোর নয় তেমন কাজ করতে যাওয়া কোনোমতেই উচিত হবে না। আর কখনো অনুচিত কাজের ফল ভালো হয় না। অনেকেই মনে করে এবং বলবার চেষ্টা করে শেখ হাসিনার পতন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফসল। আমাদের দৈনন্দিন জীবন যেমন চলে ঠিক তেমনি জীবন পরিক্রমার মতো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সব সময় থাকবে। বিরোধী দলের কাজ হবে সরকারকে অপ্রিয় করা। আর সরকারের কাজ চমৎকার ভাবে বিরোধী দলকে নিয়ন্ত্রণে রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা। এ দ্বন্দ্ব সর্বকালের। এটাকে যারা সহজভাবে নিতে পারবে- তারাই প্রকৃত নেতা রাষ্ট্র পরিচালক। যারা এসবের ব্যত্যয় ঘটাতে যাবেন তারা শেখ হাসিনার মতো ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এই আন্দোলনে ষড়যন্ত্রের চাইতেও সাধারণ মানুষের সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। একটা সময় এমন হয়েছিল যে, মানুষ শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের ওপর সন্তুষ্ট ছিল না। মানুষের অসন্তুষ্টি শেখ হাসিনার পতনের অন্যতম কারণ। কারণ যখন সব মানুষ অসন্তুষ্ট হয়ে যায় তখন কারও পক্ষেই সেই অসন্তোষ চাপা দেয়া তো দূরের কথা ধামাচাপা দেয়াও সম্ভব হয় না।