নির্বাচন মার্কিন মুল্লুকে। চাপান-উতোর বাংলাদেশে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে। প্রশ্ন একটাই ট্রাম্পের জয় বাংলাদেশের ওপর কী প্রভাব পড়বে? আরও স্পষ্ট করে বললে, মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের ভরাডুবি ৩৬ জুলাই খ্যাত ৫ই আগস্ট ২০২৪ এ ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে পরাজিতরা যেন প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছে। তাদের মুখে হাসির ঝিলিক। যা সাইবার দুনিয়ায় ‘ইমোজি’র মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। হোয়াইট হাউসে ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে তারা যতটা না খুশি তারচেয়ে বেশি আনন্দিত ডেমোক্রেটদের পরাজয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিবর্তন বিশ্ব রাজনীতির হিসাবনিকাশ জটিল হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশ বা ঢাকা কতোটা ফোকাস পাবে তা নিয়ে বিতর্ক চলছে কূটনৈতিক পাড়ায়। আলাপটা বেশ বিস্তৃত, সনির্দিষ্টও বটে। এক সময় রসায়নের সূত্র টেনে ডিপ্লোম্যাসির আলাপ হতো। এখন সেখানে গণিতের প্রাধান্য। টু প্লাস টু সব সময় ফোর হবে এমনটা নয়। কথা উঠছে- ট্রাম্পকার্ডে কতোটা চাপে পড়বে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার? আদৌ কি সরকার এ নিয়ে বিচলিত? প্রশ্নটির ভিত্তি ভোটের ৫ দিন আগে বাংলাদেশকে নিশানা করে ট্রাম্পের বার্তা। ওয়াকিবহাল সূত্রের মতামত হচ্ছে- নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশ সরকার চাপে পড়বে। না বিপ্লবী না পুরোপুরি সাংবিধানিক, আপৎকালীন ওই সরকারের ওপর নির্বাচনের চাপ বাড়বে। নানা সিদ্ধান্তে দেশে সমালোচনার মুখে ড. ইউনূস সরকার। ১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে বিএনপি-জামায়াত। তারা দ্রুত নির্বাচন চায়। ডিসেম্বরের মধ্যে রোডম্যাপ চেয়েছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। সংস্কার এবং নির্বাচন দুটোই চায় ইসলামী দল জামায়াত। বাইরে আছে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্ররা। তারা পরাজয় মানতে পারছে না। তাদের ক্ষোভ বিএনপি নয়, বরং ইউনূস সরকারের ওপর। বর্তমান সরকারকে চাপে ফেলতে তারা দেশ-বিদেশে সক্রিয়। লবি তো আছেই। সেখানে ভারত কী করে তা দেখার বিষয়। ট্রাম্প প্রশাসনকে সক্রিয় করতে পারে ভারত। বাড়াতে পারে নির্বাচনের জন্য চাপও। এটা সত্য যে, দেশের মানুষ কাঙ্ক্ষিত ভোটের জন্য মুখিয়ে আছে। শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনে বহুকাল মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত। সব মিলে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে নির্বাচন নিয়ে একটি বিবৃতিই ইউনূস সরকারের সব পরিকল্পনা ওলটপালট করে দিতে পারে। রেকর্ড বলছে, বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের আগ্রহ তার প্রেসিডেন্সির প্রথম জমানা থেকে। দিল্লির সঙ্গে মধুর সম্পর্ক সত্ত্বেও ওয়াশিংটন সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে। সেই সময়ই বলা হয়, আর দিল্লির চোখে নয়, ওয়াশিংটন এখন থেকে নিজের লেন্সেই বাংলাদেশকে দেখবে। ভোট শেষ হয়েছে আগামী বছরের শুরুতে ট্রাম্প সরকার দায়িত্ব নিবে। বিজয় উল্লাসের পাশাপাশি এখন তারা প্রশাসনের সেটআপে ব্যস্ত। বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে সেগুনবাগিচা। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের প্রতিক্রিয়ায় সেই ইঙ্গিত স্পষ্ট। বিশ্লেষকরা বাংলাদেশের সরকারি পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে নন। তবে তারা সতর্ক ভিন্ন কারণে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক আ ন ম মুনীরুজ্জামান। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ-এর কর্ণধার। তার মতে, ডনাল্ড ট্রাম্প এবারে ভূমিধস বিজয় নিয়ে ফিরেছেন। যা মার্কিন ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ট্রাম্পের দল সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ট্রাম্পকে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা দিয়েছে। ফলে ট্রাম্প যা বিশ্বাস করেন তা বাস্তবায়নে বাধা কম। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তিনি অভিবাসনের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করতে পারেন। সেখানে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। জ্বালানি, পরিবেশ এবং কর নীতিমালায় পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরাইল-হামাস সংঘাতের কি হবে তা বলা মুশকিল। যদিও যুদ্ধ বন্ধ করবেন বলে ট্রাম্প আগে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে যুদ্ধ কীভাবে বন্ধ হবে- সেটি তার নীতিমালায় পরিষ্কার করেননি। ট্রাম্পের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে, তবে এটাকে অনেক ক্ষেত্রেই অতিরঞ্জিত করে দেখা হয়। বৈদেশিক সম্পর্ক, বিশেষ করে পরাশক্তির সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্কে ব্যক্তিগত আবেগ মূল্যহীন। বাস্তবতা বা রিয়েল পলিটিক মুখ্য। জাতীয় স্বার্থই নিয়ামক। মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামানের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে বাংলাদেশ বেকায়দায় পড়ার যে আশঙ্কা ছড়ানো হচ্ছে- তা আকাশকুসুম কল্পনা। তার মতে, কেউ কেউ হয়তো নিজের কর্মীদের চাঙ্গা করতে এ ধরনের কথাবার্তা বলছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা উদ্ভট চিন্তা। ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে কতোটা প্রভাব পড়বে বলে মনে করে সরকার? এমন প্রশ্ন ছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের কাছে। তার জবাব- আমাদের স্পেকুলেট বা অনুমান অর্থহীন। আগামী দুই-তিন মাস দেখি। ট্রাম্প দায়িত্ব নেবেন, আমরা অপেক্ষা করবো। নতুন প্রশাসন কী করে তা দেখেই পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিবো। প্রয়োজন মতো সম্পৃক্ত হবো। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। নির্বাচনে জয়ের পরপরই ট্রাম্পকে বার্তা পাঠিয়ে অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিনও অভিনন্দন জ্ঞাপন করেছেন। ট্রাম্পের জয়ের পর বাংলাদেশে যে আলোচনা চলছে তা নিয়ে একটি রিপোর্ট করেছে বিবিসি বাংলা। রিপোর্টে বলা হয়, মানবাধিকার ইস্যুতে বাইডেন আমলে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। যা ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বক্তব্যে প্রকাশ পাচ্ছিলো। তবে ৫ই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কে অনেকটাই উষ্ণতা দেখা গেছে। সদ্য সমাপ্ত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ড. ইউনূসের উচ্ছ্বসিত ছবি তার প্রতিফলন। যদিও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন যে, শুধু ডেমোক্রেট নয়, রিপাবলিকান পার্টির নেতাদের সঙ্গেও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুসম্পর্ক রয়েছে। তার মতে, ডনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিদ্যমান সম্পর্ক আরও উচ্চ শিখরে পৌঁছাবে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে অবধারিতভাবেই এই প্রশ্ন আসছে যে গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বরফ যেভাবে গলতে শুরু করেছিল, এখনো তা অব্যাহত থাকবে কিনা? বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের ওপর রাতারাতি কোনো প্রভাব না পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব পড়বে। কারণ ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সম্পর্ক ততটা উষ্ণ নয়, যতটা বাইডেন, কমালা বা হিলারি ক্লিনটন কিংবা ডেমোক্রেটদের সঙ্গে রয়েছে। এ নিয়ে বিবিসি বাংলা একটি রেফারেন্স হাজির করেছে। ২০১৬ সালে ডনাল্ড ট্রাম্প প্রথম নির্বাচিত হওয়ার পর ফ্রান্সে এইচইসি প্যারিস নামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য রাখছিলেন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ড. ইউনূস। বিবিসি’র দাবি, সেখানে নাকি ডনাল্ড ট্রাম্পের জয়কে ‘সূর্যগ্রহণ’ বা অন্ধকার সময় হিসেবে বর্ণনা করে তিনি। এবারের প্রেক্ষাপট অবশ্য ভিন্ন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ট্রাম্পের জয়ের পরপরই সম্পূর্ণ ইতিবাচকভাবে তিনি তাকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কতোটা উষ্ণ হবে বা চাপ তৈরি করবে সে বিষয়ে বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের মূল্যায়ন হচ্ছে- ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি হতে পারে- এটি সত্য। কিন্তু কোনো এক দেশের রেজিম চেঞ্জের (শাসনব্যবস্থা না সরকার পরিবর্তন) জন্য মি. ট্রাম্প অন্য কোনো এক দেশের পক্ষে চলে যাবেন, এমনটা বিশ্বাস করতে তার সন্দেহ আছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম. হুমায়ুন কবির মনে করেন চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে বলেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। এশীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে কূটনীতি আছে, বাংলাদেশকে তার-ই একটি উপাদান হিসেবে দেখে তারা। সেই উপাদানের প্রেক্ষাপট হলো চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ট্রাম্পের আমলে সেটি আরও ধারালো হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এখানে বাংলাদেশকে নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতে চাইবে না। ট্রাম্পের নীতির কী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশে তা বিশ্লেষণ করেছেন আটলান্টিক কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়া সেন্টারের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো রুদাবেহ্ শহীদ। তিনি অনেকগুলো ‘যদি’ ‘কিন্তু’ ‘তবে’র ব্যবহার করেছেন। তার মতে, ক্ষমতাসীন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক পছন্দগুলোর জোরালো পরিবর্তনের প্রতিফলন। এগুলোর মূলে নবায়নকৃত রিপাবলিকান নেতৃত্বের আন্তর্জাতিক প্রভাবের পাশাপাশি অর্থনৈতিক হতাশা, অভিবাসন ঘিরে উদ্বেগ ও জাতিগত সমীকরণও ছিল। ভোটারদের মধ্যে ট্রাম্পের নতুন করে আবেদনের জোরালো কারণ এবং দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাবগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অগ্রাধিকার ও বিদেশে এর কৌশলগত বিন্যাসের মধ্যে গভীর আন্তঃসম্পর্কের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। তার মতে, ক্লিনটন, ওবামাসহ ডেমোক্রেট নেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততার জন্য পরিচিত ড. ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের সময় তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জিং মনে করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহনাজ মোমেন মনে করেন ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। ট্রাম্প যেভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সম্পর্কে বিশ্বাসী, তাতে করে ভ্লাদিমির পুতিনের মতো নরেন্দ্র মোদিকেও তিনি সমর্থন করবেন বলে মনে করেন মেহনাজ মোমেন। এতে এ অঞ্চলে ভারতের প্রভাব বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখেন তিনি। ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন বাংলাদেশ নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্য নির্বাচনী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেই দেখা উচিত। তবে ট্রাম্পের জয় যে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে সেটা সেদিনও বলেছেন তিনি।