অ র্থ নী তি

সংস্কারকদের সমাবর্তন ও যথোচিত কর্তব্য

সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ | এক্সক্লুসিভ
মার্চ ১, ২০২৫
সংস্কারকদের সমাবর্তন ও  যথোচিত কর্তব্য

গত ৫ই আগস্ট (২০২৪ সাল)-এ কিশোরদের যে বিজয় হলো, তা দেখে মহাকবি মধুসূদন দত্তের মেঘনাথ বধ কাব্যের একটি পংক্তি মনে পড়লো ‘ফুলদল দিয়া কাটিলা বিধাতা শালমলী তরুবরে।’
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনকালে আমরা দেখেছি মাসব্যাপী ঢাকা অবরোধ। করাত দিয়ে ঢাকা শহরের সড়কের বৃক্ষ কর্তন। কিন্তু কোনো পরিবর্তনের লক্ষণ চোখে পড়েনি। ফ্যাসিবাদীরা নিজেদেরকে অজেয় মনে করেছিল। কিন্তু কয়েক মুহূর্তে সব ফেলে পালিয়ে গেল পুষ্পের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে যে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেত লেখাপড়া করতে কোনো রাজনৈতিক ধান্দাবাজি যাদের মাথায় ঢোকেনি; তারা দেখলো বৈষম্য, দেশমাতৃকার অবমাননা আর লাঞ্ছনা। তাই এই পুষ্প ফুটলো না, স্ফুলিঙ্গ হলো। পুড়ে ছারখার করে দিলো স্বৈরাচারের সকল দাম্ভিকতা, অন্যায়, অবিচার।
এই মহাবিজয়ীরা যাদের দায়িত্ব দিলেন রাষ্ট্রের; তাদের প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব হলো হাজার শহীদের প্রতি যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসন। আর যারা এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে তাদের বিচারের আওতায় আনা। শুধু আনয়ন নয়, দ্রুত এই বিচারকার্য সম্পাদন করা। এরপর দ্বিতীয় দায়িত্ব হলো বিশৃঙ্খল বিপথগামী, পাচারে জর্জরিত অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা।


বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর আহসান এইচ মনসুর যথার্থই বলেছেন যে, বিশ্বে আর কোথাও এক সঙ্গে এত ব্যাংকের টাকা লুট হয়নি। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন। আজ কিন্তু চতুর্দিকে আর্তনাদের আওয়াজ ক্রমাগত বেশি শোনা যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষের প্রতিধ্বনির ধীরগতিতে হলেও আগমন শোনা যাচ্ছে। তবে এর ইঙ্গিত কিন্তু পতিত সরকারের শেষের দিক থেকে শোনা যাচ্ছিল। তখন রুদ্ধশ্বাস পরিবেশ বিরাজ করায় ক্ষীণস্বরে আসছিল। নিম্নবিত্ত তো বটে মধ্যবিত্তরাও অভাবের তাড়না অনুভব করছিল। এর কারণ গত এক যুগের বেশি সময় ধরে মেগা প্রকল্পের অর্থায়নের নামে ব্যাপক ভাবে টাকা পাচার হচ্ছিল। এনিয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা করা প্রয়োজন।
তবে মোটের উপর এটা অপরিহার্য যে, অর্থনীতিকে টেনে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য বলা হলো এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এরপর অবশ্য আসে অনেক বিষয়। গণতন্ত্র চালু রাখতে হলে কিছু প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় থাকতে হবে। বর্তমান সরকার শহীদদের মর্যাদা ও তাদের প্রতি করণীয় সম্পর্কে সজাগ রয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টা তো বিশ্ব অঙ্গনে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন আমাদের এই কিশোর, তরুণ ছাত্রদের অপরিসীম অবদানের কথা। বস্তুত পৃথিবীতে এরকম নজির কমই আছে যে, তরুণরা এত ভয়াবহ দুর্নীতিপরায়ণ ফ্যাসিবাদকে এত সংক্ষিপ্ত সময়ে ধরাশায়ী করতে পেরেছে।


সরকারের হাতে সক্রিয় কর্মপরিকল্পনা রয়েছে শহীদদের মর্যাদা দেয়া এবং আহতদের উপযুক্ত চিকিৎসা ও তাদের পরিবারের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয়া। এরপরও আমরা মাঝে মাঝে এদের প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখছি। এব্যাপারে সরকারের আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
দ্বিতীয় বিষয়টিতে আসি। অর্থনৈতিক অবস্থা। একটি গ্রাম্য কথা চালু আছে। বলা হয় যে, সারা শরীরে পাঁচড়া, মলম লাগাবে কোথায়? এতদিন একটা ধারণা ছিল যে সরকারি ব্যাংক পরিচালনায় শৈথিল্য থাকায় নানা অনিয়ম, দুর্নীতি বেশি হয়। বেসরকারি ব্যাংকে এমনটি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সেই মিথ উধাও হয়ে গেছে। বাংলাদেশে এখন প্রতিযোগিতা দিয়ে সরকারি- বেসরকারি ব্যাংকগুলো নিয়ম ভঙ্গ করেছে। নিজ ব্যাংকে আদর্শ পরিচালক, অন্য একটি ব্যাংকে সহস্র কোটি টাকার ঋণগ্রহীতা। সবাই নন, তবে এরূপ বহুরূপীর সংখ্যা একেবারে কম নয়।
বাংলাদেশে আর একটি বিষয় খুব সহজলভ্য। যেমন ব্যাংক, বীমা এবং এ ধরনের পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি নিবন্ধন করার জন্য বেশ কিছু কাগজপত্র চাওয়া হয়। যেমন আয়কর প্রদানের প্রমাণ, সক্রিয় ব্যবসায়ী হিসেবে ব্যাংক সার্টিফিকেট। যিনি প্রার্থী, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করছেন, কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সব কিছু সংগ্রহ করা হয়ে যাচ্ছে। কাগজপত্র জমা দিতে কোনো অসুবিধা হয় না, তথা নিবন্ধন পেতেও কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় না। কোম্পানি আইনে রয়েছে যে, বোর্ড একজন পরিচালককে নিয়মিত বোর্ড সভা থেকে অনুপস্থিত থাকার জন্য ঊী-ইধহমষধফবংয খবধাব দিতে পারে। কিন্তু কতোদিনের জন্য, সে কথা উল্লেখ নেই। এভাবে এদেশে যতই আইনকানুন তৈরি করা হোক না কেন, তাকে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া যায়- কথায় বলে যত মুশকিল, তত আছান।


বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দুজনই নিজ নিজ বিষয়ে পারদর্শী। অর্থ উপদেষ্টা তো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। এদের আগে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তারা কিছু জানতেন না, এরকম বলার দৃষ্টতা আমার নেই। যেটা প্রয়োজন তাহলো যে জ্ঞান-দক্ষতা রয়েছে, তা কল্যাণের নিমিত্তে কাজে লাগানো। সংকটকে যথাযথ উপলব্ধি করা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সাহেব একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন- তাহলো এক সঙ্গে এত ব্যাংক লুটপাট হওয়ার ঘটনা বিশ্বের আর কোনো দেশে ঘটেনি। তবে ওনার সাক্ষাৎকারের একটি কথার সঙ্গে আমি বিনয়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি। উনি হয়তো কথাটি প্রতিষ্ঠানের বৃহত্তর স্বার্থে বলেছেন। পদত্যাগের কথা। একটি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি বা অনিয়মের জন্য সবাই পদত্যাগ করবেন, তা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু যিনি সাংবিধানিক ভাবে কিংবা সার্বিক দায়িত্ব নিয়ে পদে আসীন হয়েছেন, তার নৈতিক দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতে হবে। তিনি ড. ফস্টাসের মতো পদ ও  ক্ষমতা ভোগ করতে চান, তাহলে তার এবং দেশের কপালে দুঃখ আছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আমি একবার এক সেমিনারে উপস্থিত ছিলাম ভিআইপি নয় ভিঅপি হিসেবে (াবৎু ড়ৎফরহধৎু ঢ়বৎংড়হ)। সভায় অর্থমন্ত্রী বললেন যে, যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের শর্ত এবং বিধি হিসেবে এখন কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক চালু করার অবস্থা নেই, তবুও বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি ব্যাংক চালুর অনুমতি দেবে। কথাটা শুনে হতবাক হলাম।
কিন্তু এ নিয়ে কোনো ভিআইপি বা কথিত বাকপটু কোনো ইলেক্ট্রনিক বা প্রিন্ট মিডিয়ার কেউ কোনো প্রশ্ন করলেন না। তখন যিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, তার বিবেকে কোনো আঘাত লেগেছিল বলে মনে হয় না। কোনো পদত্যাগপত্র দেখেছি, না কোনো মৌখিক প্রতিক্রিয়া শুনেছি।
বর্তমানে অর্থ উপদেষ্টা ও গভর্নর যেভাবে কাজ করছেন, তাতে আমরা আশাবাদী যে, দেশের অর্থনীতি ঠিক পথে নিয়ে আসবে। যদি তারা কোনো অযাচিত কিংবা কথিত রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন, তাহলে দেশের স্বার্থে, শহীদদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবেন। 
 

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তা

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর