রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। স্থায়ী নয় ক্ষমতা, জৌলুস বা সুবিধাজনক অবস্থান- কোনোটাই। এটা রিভলভিং চেয়ারের মতো। ঘুরে- আজ আপনার তো কাল অন্যজনের। সরকার ও রাজনীতি বিজ্ঞানের সব থিওরির মূল কথা এটাই। ৪ঠা আগস্টের রাতেও কেউ জানতো না শেখ হাসিনাকে এভাবে দেশ ছাড়তে হবে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন বরাবরই শোচনীয়। যুগে যুগে, দেশে দেশে এটাই হয়ে আসছে। ইতিহাসে তাদের নাম যেভাবে সন্নিবেশিত হওয়ার কথা সেভাবেই হয়েছে। শেখ হাসিনা সেই ভাগ্যই বরণ করেছেন।
২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী এক আড্ডায় বলেছিলেন- আমার বোনকেই (শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি তার নামটা ইতিহাসের পাতায় কোথায় রেখে যেতে চান? তিনি কি এ দেশে ন্যূনতম গণতন্ত্র অর্থাৎ মুক্তভাবে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ রাখবেন? নাকি বিরোধী দল-মতকে দমন করে নিজের ক্ষমতাটাই শুধু বুঝবেন?
আমি জানি, আমার বোন বিপদে, তার সংকট ঘরে-বাইরে।
আমি এটাও জানি- তার জন্য সুষ্ঠু ভোট করা কঠিন, কারণ তিনি হেরে যাবেন। তবে এই কঠিনকে যদি গ্রহণ করতে পারেন তবে তিনি তার রাজনীতিকে বাঁচাতে পারবেন। অন্যথায় আমার বোন এবং তার আশীর্বাদপুষ্টদের রাজনীতির ইতি ঘটবে! হয়তো পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ কাদের সিদ্দিকীর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হতে চলেছে।
কাদের সিদ্দিকীর রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, কিন্তু তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ কম। আরেক বিজ্ঞ রাজনীতিক বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাকে অপদস্থ করেছিলেন শেখ হাসিনা। পিলখানা বিডিআর গেটে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু তৎকালীন রেলমন্ত্রী বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের গাড়ি এবং তার এপিএসকে সেদিন জোর করে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। তল্লাশি চালিয়ে ‘রেলের কালোবিড়াল’ ধরার চেষ্টা হয়। খ্যাতিমান ওই পার্লামেন্টারিয়ান সেদিন চরম বিব্রত হয়েছিলেন এপিএস-এর দুর্নীতির কারণে। তিনি অসহায় অবস্থায় পড়েছিলেন।
পরদিন রেলভবনে সংবাদ সম্মেলনে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আফসোস করে বলেন, ‘‘আমার ৫৫ বছরের রাজনীতি ‘তারা’ ৫৫ মিনিটে শেষ করে দিলো।’’ সেই তারা কারা? এই প্রশ্ন নিয়ে ক’মাস পরে হাজির হয়েছিলাম সুরঞ্জিত সেনের ঝিগাতলার বাসায়। সাক্ষাৎকার গ্রহণের অ্যাসাইনমেন্টটি ছিল শ্রদ্ধেয় প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর। ‘দাদা’ আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার প্রদানে রাজি হলেন না। জোরাজুরি করলাম। প্রতিউত্তরে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বললেন ‘মতি (শ্রদ্ধেয় মতিউর রহমান চৌধুরী) তো সব জানে। তারপরও তোমাকে পাঠালো কেন? ঠিক আছে আমি তাঁর সঙ্গেই কথা বলছি।’ ফোনটা শেষ করে যে বাক্যটি বলেছিলেন তা হলো- ‘আমি কি বেটির বিরুদ্ধে বলতে পারি। বাঘে ধরলে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না।’ আজ সবই অতীত। বাবু সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত জীবন সায়াহ্নে রাজনীতি নিয়ে অনেক কথা বলে গেছেন। তার একটি কথা এখনো কানে বাজে। ‘আফটার শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ হবে ১৯ টুকরো।’ তিনি মাইনাস শেখ হাসিনা বলেননি। আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার লিগ্যাসি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতোটা প্রাসঙ্গিক থাকবে সেটা সময়ই বিচার করবে।
রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো শেখ হাসিনা এখন ভারতের আশ্রয়ে। বৃটিশ আমলে নির্মিত দিল্লির একটি ঐতিহাসিক বাংলো বাড়িতে রাখা হয়েছে তাকে। ওই বাংলোয় শেখ হাসিনা গৃহবন্দি নন। বরং স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। টেলিফোন, ইন্টারনেট সংযোগসহ যোগাযোগের সব ফ্যাসিলিটি রয়েছে তার। এটা ব্যবহার করে তিনি দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারছেন। তবে তার দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ। কারণ নিরাপত্তা। তার সরকারের মন্ত্রী-এমপি এবং দলের প্রথম ও দ্বিতীয় সারির নেতারা পলাতক, আত্মগোপনে। কয়েকজন জেলে। পলাতকদের বড় অংশ ভারতে। তাদের অনেকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় শেখ হাসিনার। বাংলাদেশে যেসব নেতাকর্মী অবশিষ্ট রয়েছেন তাদের কাছে ভায়া মিডিয়া দলীয় সভানেত্রীর বার্তা পৌঁছায়। আওয়ামী রাজনীতি এখনো শেখ হাসিনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। তার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করার দুঃসাহস কেউ দেখাননি।
তবে বিশ্লেষকরা সাম্প্রতিক সময়ে এটা বলার চেষ্টা করছেন যে, রাজনীতি বাঁচাতে হলে দেশের ভেতরে থাকা কাউকে দলের আপৎকালীন দায়িত্ব দিতে হবে শেখ হাসিনাকে। সেটা দলের মুখপাত্র বা অন্য যে নামেই হোক। ভারতের আতিথেয়তায় থেকে শেখ হাসিনা যেনো বাংলাদেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করতে না পারেন সেজন্য নয়াদিল্লির ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছে ড. ইউনূস সরকার। গণমাধ্যমের খবর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র সঙ্গে নয়াদিল্লির এক ধরনের বোঝাপড়া চলছে। সম্প্রতি যোগাযোগ শুরু হয়েছে বিএনপির এক সময়ের জোটসঙ্গী জামায়াতের সাথেও। বিএনপি’র মধ্যে ভারত বিরোধিতা থাকায় উভয়ের সম্পর্কে প্রতিবন্ধকতা ছিল বিশ্বাসের ঘাটতি। জামায়াতকে সঙ্গে রাখা নিয়েও নয়াদিল্লির রিজারভেশন ছিল। অবশ্য দিল্লির মন পেতে জামায়াতকে ক’বছর আগে নিজে থেকেই ত্যাগ করে বিএনপি।
জনশ্রুতি আছে, দিল্লির পরামর্শে ’১৮ সালের নির্বাচনের আগে জামায়াতকে দূরে সরিয়ে সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে মিলে বৃহত্তর একটি জোট করে বিএনপি। কথা ছিল সেই ভোটে ৮০-১০০টি আসনে জয়ের জন্য সুবিধা দিবে হাসিনা সরকার। কিন্তু নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পর সব পাল্টে যায়। ভারত নাকি শেষ পর্যন্ত ৪০টি সিট ছাড়তে অনুরোধ করেছিল! সেই নির্বাচনের পর চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সেখানে কথার ছলে তিনি বিষয়টা বলেই ফেলেন। উপস্থিত সূত্র জানায়, কাদেরের আক্ষেপ ছিল ‘৪০টা সিট ছাড়লেও এমন কি হতো? বিদেশিদের কাছে আমরা এখন কি বলবো?’ মাত্র সাত সিট পেলো ড. কামাল জোট। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত বরাবরই প্রাসঙ্গিক। ’১৪ সালে নির্বাচনে তৎকালীন বিদেশ সচিব সুজাতা সিংয়ের ভূমিকা সবার জানা। ৫ই আগস্টের পর ভারতের প্রভাব কমেছে এটা অনুমানে রকেট সাইন্টিস্ট হওয়া জরুরি নয়। কিন্তু কতোটা কমেছে? ভারতের বর্তমান বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রি সারাদিন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে কথা বলার পরও যখন সেনাপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের প্রাসঙ্গিকতা থাকে, তখন ভিন্ন বার্তা পায় জাতি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ভারত বিরোধিতা’ কেবলমাত্র একটা কার্ড না বাস্তবতা সেটা বিতর্কের দাবি রাখে।
তবে ক্ষমতার সিঁড়িতে থাকা দলগুলোর বিদেশনীতি বলে যদি কিছু থাকে তাহলে অবশ্যই সেখানে ভারত থাকবে। তাদের পরিত্যাগ করা যাবে না বরং তাদের ডিল করতে হবে। তবে হ্যাঁ, ৫ই আগস্টের রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে মেরূকরণ ঘটেছে তাতে ভারতের ভূমিকা শেষ পর্যন্ত কি বা কেমন হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। ওয়াকিবহাল সূত্র মতে, ভারত থেকে শেখ হাসিনা বা তার দলের নেতারা কথা বলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে তেমন সুবিধা করতে পারবেন না। বরং এটা আরও ক্ষতির কারণ হবে। ভারতের আশ্রয়ে থেকে ভবিষ্যতে শেখ হাসিনা রাজনীতিতে কতোটা ফুটপ্রিন্ট রাখতে পারবেন- তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ভারত রাষ্ট্র শেখ হাসিনার ব্যাগেজ টেনে কি বাংলাদেশকে হারাতে চাইবে? সেই প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। ‘বিন বুলায়ে মেহমান’ অর্থাৎ বিনা আমন্ত্রণে ঘরে পৌঁছা অতিথি হাসিনার ‘মেহমানদারি’ বা আতিথেয়তায় কোন ঘাটতি রাখছে না ভারত। তবে দিল্লির জন্য এটা ‘ডেলিকেট ডিলেমা’ বা খুব স্পর্শকাতর দ্বিধার বিষয়। কারণ দিল্লিতে হাসিনার উপস্থিতি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে এরইমধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছে।
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি বিষয়ক গবেষক অবিনাশ পালিওয়ালের মতে, ‘যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অভ্যুত্থান ঘটলো সেই শেখ হাসিনাকে ভারতের আশ্রয় প্রদান অবশ্যই কূটনীতির জলকে আরও ঘোলা করবে।’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সেদিনও বলেছেন ভারতকেই ঠিক করতে হবে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক চায়। বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে সম-মর্যাদার সম্পর্ক চায়, এ নিয়ে কোনো অস্পষ্টতা নেই। ভারতের হেজিমনির বিরুদ্ধে নতুন দলগুলোর এক ধরণের অবস্থান তৈরি করেছে। কিন্তু ভোটের মাঠে নতুনরা কতোটা নিজেদের গোছানোভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন সেটা দেখার বিষয়। প্রতিষ্ঠিত দুই শক্তি বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে তাদের ক্ষমতায় যেতে হলে অবশ্যই ভোটারদের মন জয় করতে হবে। কাজটি অসম্ভব নয়- তবে কঠিন। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। মাঠের রাজনীতির হাওয়া দ্রুতই পাল্টাচ্ছে। ’২৪ বিপ্লবের চেতনা ভোটারদের মাঝে কতটা রেখাপাত করে তা দেখার বিষয়। আপাতদৃষ্টিতে ঢাকার নানা ঘটনায় ভোটাররা দ্বিধান্বিত।