বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কথা বলেছেন। তিনি এমন কথাও বলেছেন যে, ভারতকে ফিরিয়ে দিতেই হবে হাসিনাকে। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনা সহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে বিচারও শুরু হয়েছে। এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গোটা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় হাসিনার বিরুদ্ধে আড়াইশ’র বেশি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে দু’শটির বেশি খুনের মামলা।
হাসিনাকে বিচারের মুখোমুখি করতে বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে রেড নোটিশ জারি করে গ্রেপ্তার করার অনুরোধ জানিয়েছে। এক সপ্তাহের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও ইন্টারপোলের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া-শব্দ পাওয়া যায় নি।
ভারতের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার সরাসরি ভারতের কাছে শেখ হাসিনাকে হস্তান্তরের অনুরোধ না জানিয়ে ইন্টারপোলের দ্বারস্থ হওয়ার পর থেকে ভারতের কূটনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকদের মতে জোর আলোচনা চলছে। প্রশাসনের অন্দরেও চলছে নানা আলোচনা। বাংলাদেশ ঘুরপথে হাসিনাকে নিয়ে যাবার চেষ্টা করলো কেন তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তির অবতারণা চলছে। তবে বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকরা একটি বিষয়ে একমত যে, শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করানো অসম্ভব।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ইন্টারপোলের কাছে অনুরোধ জানানো হলেও সব বিচারের ভার এসে পড়বে ভারতের উপরই। এবং সেই প্রত্যর্পণ চুক্তিই হবে শেষ মাধ্যম। তাছাড়া ইন্টারপোলের মাধ্যমে হলেও প্রত্যর্পণের বিষয়টি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। দশকের পর দশক ধরে চলতে পারে সেই প্রক্রিয়া। প্রত্যর্পণের ইতিহাসে এমন নজির রয়েছে ভূরি ভূরি।
আইনজ্ঞদের মতে, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে একটি সতর্কবার্তা মাত্র। এটি কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও নয়। ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে স্পষ্টই বলা রয়েছে, কোনো দেশের আইনরক্ষাকারী সংস্থাকে রেড নোটিশভুক্ত কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য করতে পারে না। প্রত্যর্পণ করতেও বলতে পারে না। সবটাই নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশ সেই রেড নোটিশের আইনি মূল্য দিচ্ছে কতোটা তার উপর। তাছাড়া রেড নোটিশ জারি করার আগে ইন্টারপোলও সবদিক বিচার বিবেচনা করে তাদের কাছে পাঠানো সমস্ত তথ্যের ভিত্তিতে।
এক আইন বিশেষজ্ঞ আলাপচারিতায় বলেন, এখানে হাসিনাকে নিয়ে রেড নোটিশ দেয়ার ক্ষেত্রে অনেক প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রথমত হাসিনা কি পালিয়ে গিয়েছেন নাকি তাকে নিরাপত্তার অজুহাতে ভারতে পাঠানো হয়েছে? তিনি যে দেশ ছাড়ার আগে লিখিতভাবে পদত্যগপত্র জমা দেন নি সেটা তো বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কথাতেই স্পষ্ট হয়েছে। আর দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার করার এখতিয়ার রয়েছে কি? স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্তদের বিচারের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছিল।
অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রত্যর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৩ সালে। এরপর ২০১৬ সালে সংশোধনও করা হয়। তবে এই চুক্তিতে একটি বড় বাধা হয়ে রয়েছে ‘রাজনৈতিক প্রকৃতি’ কথাটি। অর্থাৎ কোনো প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে রাজনীতিই যদি বড় হয়ে দেখা দেয় তাহলে প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা যেতে পারে। আর বাংলাদেশ তো এখন পর্যন্ত ভারতের কাছে কোনো অনুরোধই করে নি। তাই হাসিনাকে ফেরত দেয়ার কোনো বাধ্যবাধকতা ভারতের রয়েছে বলে মনে করেন না পর্যবেক্ষক মহল।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে নিয়ে ভারত সরকার কোন পথে হাঁটতে চলেছে। তিন মাস পার হয়ে গেলেও হাসিনাকে নিয়ে ভারত সরকার স্পষ্টভাবে তাদের কোনো অবস্থান জানায় নি। একমাত্র পররাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে তিনি ভারতেই রয়েছেন। আর প্রত্যর্পণের প্রশ্নটিকে হাইপোথেটিক্যাল বলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
তবে ভারত হাসিনা এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ নীতি নিয়ে চলেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চৌধুরী এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ কালে স্পষ্ট করেই বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কোন পথে চলেছে তার উপর ভারত নজর রেখেছে। যেভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি অস্থির হয়ে উঠছে তাতে ইউনূসের সরকার কতোদূর যেতে পারবে সেটাই দেখতে চাইছে ভারত। তবে তাই বলে ভারত কোনো কঠিন পদক্ষেপ নেয়ার পথেও যাচ্ছে না। বরং সবক’টি সাপ্লাই লাইন খোলা রেখেছে। তেল, বিদ্যুৎ থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ভারত কোনোভাবে বিঘ্নিত হোক তা চায় নি।
তবে হাসিনাকে রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই রাজনীতি করার জন্যই বাংলাদেশ সরকার হাসিনাকে লাগাম পরানোর অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে যে সব ফোনালাপ ফাঁস হচ্ছে তাতে বোঝা যাচ্ছে শেখ হাসিনা দিল্লিতে নিশ্চিন্তে সময় কাটানোর মনোভাব নিয়ে চলছেন না। দলকে তিনি কীভাবে সংগঠিত করবেন তা স্পষ্ট নয়। তবে হাসিনার সঙ্গে যে আওয়ামী লীগের বিদেশে থাকা বা আত্মগোপনে থাকা নেতাদের যোগাযোগ রয়েছে সেটা দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। ভারত সরকার এক্ষেত্রে হাসিনাকে কতোটা ছাড় দেবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এই সপ্তাহেই সুইডেন প্রবাসী আওয়ামী লীগ কর্মীদের জমায়েতে ফোনে হাসিনার ভাষণের একটি অডিও ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে। সেই ভাষণে হাসিনা সরাসরি নিশানা করেন বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও অন্যান্য উপদেষ্টাদের। তাছাড়াও আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে অনুগামীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফেসবুকে নিয়মিত নানা প্রতিবাদের ছবি ও ভিডিও তুলে ধরা হচ্ছে। তাতে হাজার হাজার লাইক পড়ছে। মন্তব্য আসছে।
অধ্যাপক ধর চক্রবর্তী অবশ্য মনে করেন, হাসিনার পক্ষে এই ৭৭ বছর বয়সে দলকে পুনর্গঠিত করা খুবই কঠিন কাজ। তিনি বলেন, হাসিনা যে কাজেকর্মে স্বৈরাচারী হয়ে উঠেছিলেন সেটা সকলেই জানতেন। দুর্নীতির সুযোগে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা যেভাবে লুটতরাজ চালিয়েছেন তাতে মানুষ বিক্ষুব্ধই ছিলেন। তাই দেশের মানুষের আস্থা ফেরানোর পক্ষে হাসিনার কাজটি খুবই কঠিন। তাছাড়া ইতিহাসের পাতায় দেখা গিয়েছে স্বৈরাচারীর পতনের পর তার পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় থাকেই না।
তবে হাসিনার ভবিষ্যৎ এখন সবটাই ভারতের উপর নির্ভরশীল। ভারত সরকার বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দিহান বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহলের একাংশ। আর হাসিনাকে ফেরত না পাঠানোর পক্ষে ভারতের হাতে মজুত রয়েছে অনেক যুক্তি। সেই সব যুক্তির ভিত্তিতে সব রকম প্রত্যর্পণের অনুরোধ দীর্ঘ সময় নানা জটিলতার অজুহাতে ঝুলিয়ে রাখা বা প্রত্যাখ্যান করা ভারতের পক্ষে কোনো কঠিন কাজ নয়।
অন্যদিকে গত ১৫ বছর ধরে ভারত সরকার হাসিনার কাছ থেকে যে রাজনৈতিক ও আর্থিক সুবিধা পেয়েছে, যা সম্পর্ককে সোনালি অধ্যায় বলে বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল সেক্ষেত্রে ভারতের পক্ষে কোনো ভাবেই হাসিনাকে হিংস্র থাবার সামনে ঠেলে দেয়া সম্ভব নয় বলেই মনে করেন বিশ্লেষক মহলের একটি বড় অংশ। তাহলে কি হাসিনাকে ফেরত পাওয়া বাংলাদেশ সরকারের কাছে একরকম অনিশ্চিত? ভারতের একদল পর্যবেক্ষক মনে করেন, সবটাই মানুষের ক্ষোভকে চাঙ্গা রাখার কৌশল মাত্র।