এক রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্যেই এসেছিল নয়া সরকার। পতন হয়েছিল শেখ হাসিনার ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের। আন্দোলনের মূল শক্তি ছাত্ররা বেছে নিয়েছিল প্রফেসর ড. ইউনূসকে। শুরুতে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসের ঘোরতর আপত্তি ছিল। প্যারিসে বসেই তিনি প্রথম দফা আলোচনায় জানিয়েছিলেন তার পক্ষে দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। ২০০৭ সনেও তার সামনে এই অফার এসেছিল। উপায়ান্তর না দেখে ছাত্ররা ফের যোগাযোগ করে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গে। অব্যাহত চাপের মুখে প্রফেসর ইউনূস সায় দেন। কেটে যায় সব অনিশ্চয়তা। সরকার গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হয়। ৮ই আগস্ট প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস দেশে ফেরেন। সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে শপথ নেন। তার হাতে তখন একাধিক তালিকা। রাজনৈতিক দলগুলোও উপদেষ্টাদের তালিকা দিয়েছে। ছাত্রদের তরফেও কিছু নাম চূড়ান্ত করা হয়। সিদ্ধান্ত নেন ড. ইউনূস। নিজ হাতে কেটে দেন পাঁচটি নাম। তখনো রাজনৈতিক দলগুলো জানতো না তিনি একক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। বঙ্গভবনে শপথ নেয়ার সময় উপদেষ্টাদের নাম দেখে অনেকেই হতবাক হন। বেশির ভাগই তো দেখা যাচ্ছে হয় গ্রামীণের কর্মকর্তা না-হয় কিছু এনজিও ব্যক্তিত্ব। পরবর্তীকালে যেটা ‘এনজিওগ্রাম’ সরকার হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। তখন থেকেই সমালোচনা শুরু। বলা হয়, এটা ভুল সিদ্ধান্ত। এরমধ্যে কয়েকজন আছেন যারা দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে একটি শব্দও বলেননি। এমন কি উপদেষ্টাদের বৈঠকেও তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুপ থাকেন। এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা আছেন যিনি গোড়া থেকেই সরে যাওয়ার জন্য এখানে-সেখানে তদবির করছেন।
অতি সমপ্রতি একজন ইউটিউব তারকার কাছে নিজেই বলেছেন- আমি ব্যর্থ। আমার ওপর একটা রিপোর্ট লিখে দাও। কী অসহায় অবস্থা দেখুন! অথচ জনগণ বলছে উপদেষ্টা বদলান। কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেও বলা হচ্ছে। সরকারপ্রধান শুনছেন না। তার সঙ্গে যারা দীর্ঘদিন কাজ করেন এমন কয়েকজন বললেন, তিনি যখন একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন তখন আর পেছনে ফিরে তাকান না। হাজার সমালোচনা হলেও তিনি থাকেন নিশ্চুপ, অনড়। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানে এটা সম্ভব। রাজনীতিতে এটা আত্মঘাতী।
সময় যত গড়াচ্ছে ততই সংকট তীব্র হচ্ছে। নির্বাচনের দাবি জোরালো হচ্ছে। সংস্কার মাঝপথে যেকোনো সময় হোঁচট খেতে পারে এই আশঙ্কা চারদিকে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর রেহমান সোবহান সংস্কারকে উচ্চাভিলাষী বলে মন্তব্য করেছেন। পতিত স্বৈরাচার নানা খেলায় লিপ্ত। বিদেশে বসে গুজব আর দেশে নানা তৎপরতা। এ পর্যন্ত শতাধিক ছোট-বড় নানা অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। যে সব ছিল সরকার হটানোর কৌশল।
রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ না দেখে ড. ইউনূসের স্বার্থ দেখবে কেন? এরমধ্যে একটি রাজনৈতিক দল আছে যারা আগামী দশ বছরেও নির্বাচন চায় না। কারণ তারা মনে করে নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে ততই তাদের লাভ। এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে তারা ত্রিশ আসনের বেশি পাবে না। অপরদিকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দলটি ক্ষমতায় না গিয়েও কাদার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। হাজার চেষ্টা করেও শীর্ষ নেতৃত্ব ব্যর্থ হচ্ছেন। পতিত আওয়ামী লীগ পর্দার আড়ালে বসে খেলছে।
অনেকেই বলছেন দলটি আগামী দশ বছরেও সামনে আসতে পারবে না। বাস্তব অবস্থা কি তাই? গ্রামের মানুষ কী ভাবছে। শহরের মানুষ হিসেব করে কথা বলে। তারা ভোটে গেলে কী করবে। এটা সত্যিই অস্পষ্ট। এই যখন অবস্থা তখন মার্কিন গণমাধ্যম ভয়েস অফ আমেরিকা এক জরিপে বলছে, ৫৭ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে দেয়ার পক্ষে। এই পরিস্থিতি কেন তৈরি হলো? মোটাদাগে বলা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার যত ব্যর্থ হবে, ততই আওয়ামী লীগের সম্ভাবনা বাড়বে। বাংলাদেশে এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বিপ্লবোত্তর বহু দেশে এমনটা হয়েছে। নিকট অতীতে মিশর, তিউনেশিয়া ও ফিলিপাইনে একই পরিস্থিতি দেখা গেছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শুরুতেই ভুল করেছে। বিপ্লবী সরকার হবে নাকি আধা বিপ্লবী, আধা সাংবিধানিক সরকার হবে- এটা নিয়ে বিতর্ক ছিল। কেউ কেউ এখন বলছেন, প্রেসিডেন্টের কাছে শপথ না নিয়ে শহীদ মিনারে কিংবা রাজু ভাস্কর্যের সামনে শপথ নিলে আজ হয়তো এই পরিস্থিতি হতো না। এটা যে অভিজ্ঞতার অভাব তা বোধকরি কারও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। তাছাড়া মৌলিক কিছু বিষয়ে হুটহাট সিদ্ধান্ত নেয়াটাও ভুল ছিল। নিত্যপণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। ব্যাংকে টাকা নেই। বিনিয়োগ বন্ধ। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যবসা গোটানোর চেষ্টা করছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তলানিতে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে কোনো লাভ যে হয়নি- তা কি আর বলতে হয়! শুধু কথা বলার জন্য একজন মানুষকে এভাবে সরিয়ে দেয়ার মধ্যে প্রশাসনিক দক্ষতার কোনো ছাপ নেই। বরং চাপের কাছে নতি স্বীকার করার একটি বাজে উদাহরণ। এই চাপ বাইরের নয়, ঘরের ভেতর থেকেই এসেছিল।
ঘরের ভেতরের চাপে প্রফেসর ড. ইউনূস ক্লান্ত। এককভাবে কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারছেন না। একজন একান্ত সচিব নিয়োগ দিয়েও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন। অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে কেন জানি মনে হয়, তিনি নাটকীয় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। যেমনটা করেছিলেন জরুরি জমানায়। যাদের দিয়ে রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম তৈরি করতে চেয়েছিলেন তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করেই তিনি দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। যা এখনো ইতিহাস হয়ে রয়েছে।
কথায় কথায় দাবি আদায়ের আন্দোলন। শ্রমিক আন্দোলন তো নিত্যদিনের ঘটনা। বন্ধ হচ্ছে কলকারখানা। ছাত্ররাও তুচ্ছ ঘটনায় সবকিছু ওলটপালট করে দিচ্ছে। এর ফলে বন্ধ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ চট্টগ্রামে যা ঘটে গেল তা কিন্তু অশনিসংকেত। পরিকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে। সরকার হটানোর অন্য এক কিসিমের ষড়যন্ত্র। রাজনীতিবিদরা সরকার বাঁচাতে মরিয়া। অথচ তাদেরকে সন্দেহের চোখেই দেখছে অন্তর্বর্তী প্রশাসন। গোড়াতেই বলা হয়েছিল জাতীয় সরকারই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ। কিন্তু এক অদৃশ্য কারণে সে পথে তারা হাঁটেন নি। আবেগের কাছে তারা হেরে বসেছিলেন। এখন তো বুড়িগঙ্গায় অনেক পানি গড়িয়ে গেছে। এই অবস্থায় একটাই পথ-আশু নির্বাচন। যত দেরি হবে নির্বাচন ততই রাজপথ উত্তপ্ত হবে। ঘেরাও-অবরোধ পুরোদমে চালু হয়ে যাবে। মানুষ বিকল্প পথ খুঁজবে। পুরনো স্মৃতি খুঁজে বেড়াবে। সংকট কি তাহলে এভাবেই জাতিকে গ্রাস করবে? সেনাবাহিনী সামনে আসতে চায় না। তারা পর্দার আড়ালেই থাকতে চায়। এই সরকারের সাফল্যের উপর নির্ভর করে আগামী দিনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে সামনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। টানেলের অপরপ্রান্ত এখনো অন্ধকার। নিজের ইমেজ রক্ষায় কী করা উচিত প্রফেসর ড. ইউনূস তা ভালো করেই জানেন। আসলে তার হাতেই ট্রাম্প কার্ড।