৫ই আগস্টের আগে রাজনীতিতে ব্যাক ফুটে ছিল দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের মধ্য দিয়ে নবতর জীবনের উত্থান ঘটে দলটির। চলে আসে ফ্রন্ট লাইনে। আলোচনায় কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ২০১৫ সালের পর এদিনই ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইনসহ সব গণমাধ্যমে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বক্তব্য একযোগে প্রচার করা হয়। প্রতিনিয়তই রাজনীতি নিয়ে কথা বলছেন তিনি। রাষ্ট্র পরিচালনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দিচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ। এখন গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে লিপ্ত রয়েছে তার দল বিএনপি। তাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। শুরু থেকেই এই সরকারকে সমর্থন দিয়ে আসছে দলটি। তবে সংস্কার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করে নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবিও জানাচ্ছেন তারা। বলছেন, নির্বাচন দীর্ঘায়িত হলে ফ্যাসিবাদ আবারও ফিরে আসার সুযোগ পাবে। এই অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে দেশ ব্যর্থ হবে বলেও মনে করছে দলটির হাইকমান্ড।
গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ৬ই আগস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সাজা থেকে পুরোপুরি মুক্তি পান। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দণ্ড মওকুফ করেন। ২০২০ সাল থেকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্ত ছিলেন তিনি। দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি কারাগারে যেতে হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। মুক্তি পাওয়ার পরের দিন দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর পর বেগম খালেদা জিয়া মুক্তভাবে দলীয় নেতাকর্মীদের সামনে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি’র সমাবেশে ভার্চ্যুয়ালি বক্তব্য রাখেন। ভিডিও বার্তায় দেয়া ওই বক্তব্যে তিনি বলেন, ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, প্রতিহিংসা নয়। আসুন ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।
এরপর ২১শে নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের আমন্ত্রণে সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনীর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ ৬ বছর পর খালেদা জিয়ার প্রথম সশরীরে কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান।
ওদিকে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রভাবে সারা দেশে বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাগুলো প্রত্যাহার হচ্ছে। এরফলে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিএনপি’র নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা করা হয় ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৮৩টি। এসব মামলায় আসামির সংখ্যা ৫৯ লাখ ২৯ হাজার ৪৯২ জন। ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এই মামলাগুলো প্রত্যাহার হওয়া শুরু হয়েছে। মামলা প্রত্যাহারে নেতাকর্মীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানেরও মামলাগুলো প্রত্যাহার হচ্ছে। সবমিলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে এখন ৩০ থেকে ৩২টি মামলা রয়েছে বলে মানবজমিনকে জানিয়েছেন বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। এই মামলাগুলো প্রত্যাহার হলেই বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশে ফিরবেন বলে জানা গেছে।
এদিকে সরকার পতনের দাবি এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার করেছে বিএনপি। ৭ই জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করায় এই ভোটে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই নির্বাচন বর্জন, অবৈধ আওয়ামী সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয় বিএনপি। নির্বাচনের আগে এবং পরে অসহযোগ আন্দোলনের পক্ষে হরতাল ও অবরোধসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। ৮ই মে শুরু হওয়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনও বর্জন করে দলটি। এমন পরিস্থিতিতে দলটির নেতাকর্মীরা মনে করেছিলেন যে, আরও পাঁচ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেই চলতে হবে।
তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরুর আগে বিএনপি’র তৃণমূলের নেতাকর্মীরা ভাবতেই পারেননি যে, শেখ হাসিনা সরকারের পতন এভাবে হবে। অবশ্য শুরু থেকেই এই আন্দোলনের সমর্থন দেয় বিএনপি। দলের নেতাকর্মীদের এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানায় দলটি। এর আগে থেকেই ছাত্রদলসহ বিএনপি’র অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা ছাত্রদের প্রতিটি কর্মসূচিতে রাজপথে থেকে পালন করেছেন। ওদিকে দলটির সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন সভা, সেমিনার এবং সমাবেশে বক্তব্যে বলেছিলেন, রাজপথের আন্দোলনেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হবে। এই লক্ষ্যে সংগঠনকে গোছানোর কার্যক্রম শুরু করেন বিএনপি’র হাইকমান্ড। এরই অংশ হিসেবে ২৪শে মে থেকে দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোকে মাঠে নামান বিএনপির হাইকমান্ড। ছাত্রদল জেলাভিত্তিক কর্মী সম্মেলন করে, যুবদলও দেশের ৮২টি সাংগঠনিক জেলা সফর করে। পাশাপাশি জাতীয়তাবাদী কৃষকদল এবং স্বেচ্ছাসেবকদলও সাংগঠনিক সফর করে। এ সময়ে কেন্দ্রীয় বিএনপি বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ জনসম্পৃক্তমূলক বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচি পালন করে।
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান মানবজমিনকে বলেন, স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছে। নেতাকর্মীদের গুম ও খুন করা হয়েছে। এরপরও তারা বিএনপিকে ভাঙতে পারেনি। বিএনপি বাংলাদেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষায় আন্দোলন করেছে। নির্বাচনও বর্জন করেছে। এই আন্দোলনে বিএনপি’র সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও ছিল। আর বিএনপি জনগণের একমাত্র আস্থাভাজন দল। বিএনপি এবং গণতন্ত্র একে-অপরের পরিপূরক। বাংলাদেশের অন্যতম বড় প্রধান রাজনৈতিক দল হচ্ছে- বিএনপি। সুতরাং হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর রাজনৈতিক দল হিসেবে তো বিএনপি সামনে চলে আসবে এবং চলে এসেছে।