রা জ নী তি

বিএনপি’র চ্যালেঞ্জ বাইরে নয়, ভেতরে

সোহরাব হাসান | এক্সক্লুসিভ
জানুয়ারী ১৮, ২০২৫
বিএনপি’র চ্যালেঞ্জ বাইরে নয়, ভেতরে

অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতে নির্বাচন নিয়ে কেউ তেমন বিচলিত ছিলেন না। সবাই মনে করেছিলেন, দেশের পুনর্গঠন কাজটা ঠিকমতো এগিয়ে নিতে, ভেঙে পড়া অর্থনীতির চাকা সচল করতে ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে অন্তর্বর্তী সরকারকে অন্তত ‘যৌক্তিক সময়’ দেয়া উচিত। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গেল বছর বিজয় দিবসে যখন জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে ২০২৫ সালের শেষে অথবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি নির্বাচনের কথা বললেন, তখনো সবাই তাকে ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিলেন। বিএনপিও ২০১৫ এর মধ্যে নির্বাচন মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল।
এরই মধ্যে বিএনপি’র নেতাকর্মীরা দু’টি কারণে নির্বাচনের দাবিকে সামনে নিয়ে এসেছে। প্রথমত, অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রত্যাশার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার বিদেশ যাত্রা ও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আনীত মামলাগুলো পর্যায়ক্রমে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি।


জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ ও সংবিধান বাতিলের দাবির বিষয়ে বিএনপি শক্ত অবস্থান নিয়ে এটাই প্রমাণ করতে চেয়েছে, তাদের উপেক্ষা করে গায়ের জোরে কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না। অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্রনেতারা সংস্কার নিয়ে যতই তোড়জোড় করুক না কেন, মানুষ এখন নির্বাচন চায়। নির্বাচন ছাড়া সংস্কার কাজ এগিয়ে নেয়া যাবে না।
নির্বাচন নিয়ে আগে দুটো সম্ভাব্য সময়ের কথা বলা হয়েছিল। এক. চলতি বছরের মধ্যে। দুই. আগামী বছরের মাঝামাঝি। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর চলতি বছরের জুলাই-আগস্টের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বারবার করে বলছি যে, নির্বাচিত সরকারের কোনো বিকল্প নাই। এটা গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা মনে করি যে, এই বছরের মাঝামাঝি সময়ে অর্থাৎ জুলাই-আগস্টের মধ্যেই নির্বাচন সম্ভব। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই আসে না।


এর অর্থ বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন মেনে নেবে না। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি জাতীয় নির্বাচনের  আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছিল। বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে বিএনপি ও ছাত্রনেতারা মুখোমুখি অবস্থানে। ছাত্রনেতাদের দাবি, একটি বড় দল  জুলাই-আগস্টের বিপ্লব ব্যর্থ করতে সচেষ্ট।
আওয়ামী লীগ মাঠ ছাড়া হওয়ার পর বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ না থাকলেও দলের ভেতর থেকে যেসব চ্যালেঞ্জ আসছে, সেটা কীভাবে সামাল দেবে- সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জুলাইয়ে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি’র একশ্রেণির নেতাকর্মী দখলবাজি ও চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ছেন বলে প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে খবর আসছে। অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে বিএনপি’র বেশ কয়েকজন কর্মীও মারা গেছেন। বিএনপি’র নেতৃত্ব মনে করে, নির্বাচন যত বিলম্ব হবে স্থানীয় পর্যায়ে সংঘাত আরও বাড়বে। বিএনপি’র দ্রুত নির্বাচন দাবির পেছনে এটাও কারণ বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।


যেসব রাজনীতিক ক্ষমতার বাইরে থেকেও ব্যাপক সংখ্যক মানুষের শ্রদ্ধা ও সমীহ পেয়েছেন, নিঃসন্দেহে খালেদা জিয়া তাদের একজন। এমন বহু মানুষ পাওয়া যাবে, যারা বিএনপি’র রাজনীতি করেন না, বিএনপি’র নীতি-আদর্শেরও সমর্থক নন, তারাও রাজনীতিক হিসেবে খালেদা জিয়াকে পছন্দ করেন। এটি তিনি অর্জন করেছেন ব্যক্তিগত শিষ্টাচার ও সৌজন্যবোধের মাধ্যমে। তিনি কম কথা বলেন, এটাও তার গুণ হিসেবে ধরে নেয়া যায়।
সমকালীন বাংলাদেশে তার সমতুল্য জনপ্রিয় রাজনীতিক কেউ আছেন বলে মনে হয় না। ১৯৯১ সাল থেকে খালেদা জিয়া কোনো নির্বাচনে হারেননি। এমনকি যেসব নির্বাচনে বিএনপি হেরে গেছে, সেসব নির্বাচনেও তিনি সব ক’টি আসনে রেকর্ডসংখ্যক ভোট পেয়েছেন।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা করে এবং একপর্যায়ে তাদের গ্রেপ্তারও করা হয়। পরে ঘরে ও বাইরে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে তাদের ছেড়ে দিতেও বাধ্য হয় তারা।


ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কোয়ালিশন ইয়ার্স বইয়ে এ বিষয়ে চমকপ্রদ কিছু তথ্য আছে। সেনা সমর্থিত সরকারের টার্গেট ছিলেন দুই নেত্রী ও দুই দল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে করা সব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হলেও খালেদা জিয়ার মামলাগুলো থেকে যায়। ২০১৮ সালে দু’টি ‘বিতর্কিত’ মামলায় তাকে শাস্তি দিয়ে জেলে পাঠানোর পর থেকে খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কার্যক্রম থেকে দূরে আছেন। তা সত্ত্বেও  তাকেই বিএনপি’র প্রধান শক্তি ও ভরসা ভাবা হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। এরপর কয়েক মাস ধরে প্রস্তুতি নিয়ে তিনি ৭ই জানুয়ারি কাতারের আমীরের দেয়া একটি এয়ার এম্বুলেন্সে ঢাকা থেকে লন্ডন যান। বর্তমানে দ্য লন্ডন ক্লিনিকে তার চিকিৎসা চলছে।


ডিসেম্বরের শেষ দিকে খালেদা জিয়ার বিদেশযাত্রার বিলম্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপি’র একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘ম্যাডামের এখন যে শারীরিক অবস্থা, তাতে বিদেশে যেতে কোনো বাধা নেই। তবে দেশে তার উপস্থিত থাকা না থাকার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।’ এ মুহূর্তে দলের প্রধান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিদেশে থাকা নিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা কিছুটা চিন্তিতও। তাদের সঙ্গে দেশবাসীও আশা করেন, খালেদা জিয়া চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে ফের দল ও দেশের হাল ধরবেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কোনো বাধা নেই। শেখ হাসিনা দণ্ডিত হলে নির্বাচন করতে পারবেন না।’
বিএনপি নিজেকে মধ্যবর্তী দল মনে করে। তারা ডান বা বাম কোনো দিকে ঝুঁকতে চায় না। নেতাদের দাবি, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের বিরোধ নীতিগত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে জামায়াতের সঙ্গে তারা যে জোট করেছিল, সেটাও কৌশলগত। নব্বই দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যখন আন্দোলন হয়, তখন আওয়ামী লীগও জামায়াতের সঙ্গে কৌশলগত আন্দোলন করেছিল।


আওয়ামী লীগ মাঠ ছাড়া হওয়ার পর জামায়াতে ইসলামী নিজেকে বিএনপি’র বিকল্প শক্তি হিসেবে দেখাতে চাইলেও বিএনপি’র নেতৃত্ব তাদের বড় প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে না। তাদের দাবি, সাংগঠনিকভাবে জামায়াত ভোটের মাঠে যত শক্তিই দেখাক কিংবা দলের আমীর যত সদুপদেশই দিন না কেন ভোটের মাঠে তারা সুবিধা করতে পারবে না। জামায়াতের সর্বোচ্চ ভোটের হার ১০ শতাংশ। এককভাবে নির্বাচন করে তারা তিনটি আসন পেয়েছে। বিএনপি’র সঙ্গে জোট করে তারা ১৭/১৮টি আসন পেয়ে সরকারের অংশীদারও হয়েছে।


জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অন্যান্য ইসলামী দলে মিলমিশ ছিল না কখনো। এবারে দলটি যে অন্যান্য ইসলামী দলের সঙ্গে ঐক্য বা সমঝোতার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাও সফল হবে না বলে মনে করেন বিএনপি’র নেতৃত্ব। গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট ও গণঅধিকার পরিষদ নামে আরও যেসব দল আছে, বিএনপি তাদের সঙ্গে নিয়েই নির্বাচনী মাঠে নামবে বলে ধারণা করা হয়। এক্ষেত্রে তাদের নীতি হলো- একসঙ্গে আন্দোলন, একসঙ্গে নির্বাচন ও একসঙ্গে সরকার গঠন। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অনেক আগেই জাতীয় সরকারের আওয়াজ তুলেছেন। বিএনপি’র শাসনামলে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই কৌশল নিয়েই ১৪ দলীয় জোট করে সুফল পেয়েছিল। সে সময়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বিএনপি ও চার দলীয় জোট। এবারে আওয়ামী লীগ মাঠে নেই ফলে বিএনপি’র পক্ষে নির্বাচনী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।


ছাত্রনেতাদের প্রস্তাবিত দল সম্পর্কেও বিএনপি খুব একটা ভাবিত নয়। প্রথমত, এই দলের কাঠামো কী হবে এখনো পরিষ্কার নয়। ছাত্রনেতারা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কিংবা নাগরিক কমিটি দল হবে না। তারা জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করতে চান, যাতে এই দুই সংগঠন উদ্যোক্তা হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই প্ল্যাটফরম বা জোটরাজনীতি কতোটা কার্যকর হবে সে বিষয়ে সন্দেহমুক্ত হওয়া যাচ্ছে না।


এসব বিবেচনায় বিএনপি জামায়াতে ইসলামী কিংবা প্রস্তাবিত দল নিয়ে খুব চিন্তিত নয়। তাদের চ্যালেঞ্জটা আসবে ভেতর থেকেই। বিএনপি নেতৃত্ব যেই উদার রাজনীতির কথা বলছে, গণতান্ত্রিকভাবে দল ও দেশ পরিচালনার কথা বলছে, সেটা করতে হলে দলের ভেতরকার উপদলীয় কোন্দল দূর করতে হবে। দলীয় প্রার্থিতা নিয়ে ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্থানে সংঘাত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে। বিএনপি’র দু’জন সাবেক সংসদ সদস্য বলেছেন, তাদের এলাকার জনবিচ্ছিন্ন নেতারা কেন্দ্রীয় নেতাদের ম্যানেজ করতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করছেন, এলাকায় নানা উন্নয়ন প্রকল্পের গল্প শোনাচ্ছেন। এ অবস্থায় মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে তারা চিন্তিত আছেন।  


একটি ভালো দিক হলো- আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গে যে ব্রাকেটবন্দি করা হতো, বিএনপি নেতৃত্ব তা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে, অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছে বলা হয়। যেই বিএনপি বাহাত্তরের  সংবিধানের কঠোর সমালোচনা করতো, সেই বিএনপি এখন বাহাত্তরের সংবিধান রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তারা বাস্তববাদী নীতি নিয়েছে। তারা বলেছে, ভারত সরকার এতদিন একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে গিয়ে দেশের জনগণের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে হেঁটেছে। তাদের উচিত- বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কথা ভাবা।


১১ই জানুয়ারি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ও সহযোগিতা প্রসঙ্গে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী বলেছেন, দুই দেশের পারস্পরিক সার্বিক সম্পর্ক তখনই স্বাভাবিক হবে, যখন সে দেশে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে। এই বক্তব্য বিএনপি’র নেতৃত্বের প্রত্যাশার প্রত্যুত্তর কিনা, সেই প্রশ্নের জবাব ভবিষ্যৎই দিতে পারে। 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর