তখনো সবকিছু হাসিনা সরকারের নিয়ন্ত্রণে। চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে ছাত্ররা। সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ঘটেছে মাত্র। গণমাধ্যমে একের পর এক লাশের খবর। জুলাই মাস শেষ হতে তখনো বাকি দু’দিন। এমন সময়ে বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ঘুরে রেকর্ড করে যাওয়া সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনার এক সাক্ষাৎকার বেশ আলোচনায় আসে। যার মূল মেসেজ ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন শক্তির উত্থান ঘটতে পারে!
অবিশ্বাস্য সেই বার্তা মুহূর্তেই ছড়ায় দেশের সর্বত্র। ট্রান্সলেশন হয়ে যায় সীমান্তের ওপারেও। ৩রা আগস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে একদফা ঘোষণা করে ছাত্র-জনতা। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দোসররা। শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের বৈরী আচরণের মধ্যে বাংলাদেশে সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার সাক্ষাৎকারটি ছিল নিউ ইয়র্কের প্রতিষ্ঠিত বাংলা চ্যানেল টাইম টেলিভিশনের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারে তার ভাষ্যটি ছিল এমন “বাংলাদেশে নতুন রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটতে পারে। আবার পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোও পুনরুজ্জীবিত হতে পারে। এটা হতেও পারে, না-ও হতে পারে।” সেই রাজনৈতিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় তিনি বলেছিলেন- “বাংলাদেশে কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছে। এটা ভাঙা উচিত। এ জন্য প্রয়োজন অর্থপূর্ণ সংস্কার।”
অভ্যুত্থানে সফলতা আসার পর নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কারের মতো কঠিন কাজে হাত দেয়। যা মোটেও পছন্দ নয় রাজনীতির প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোর। আপৎকালীন সরকার শপথ নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ক্ষমতার সিঁড়িতে থাকা জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রধান সমন্বয়ক বিএনপি’র তরফে সমাবেশ করে দ্রুত নির্বাচনের দাবি উত্থাপন করা হয়। পতিত স্বৈরাচারের অনুসারীরাও তাদের সমর্থকদের মাঠে নামায় কৌশলে। তারা যৌক্তিক দাবি-দাওয়া নিয়ে সরব বিভিন্ন সংগঠনের ঘাড়ে সওয়ার হতে থাকে। যার ফলশ্রুতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফিং অনুষ্ঠানের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে উপস্থিত হওয়ার পথে প্রায় আড়াই ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকতে হয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের মাথায় তার সরকারকে ফেলে দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা হয়। অবশ্য এখন তা অনেকটাই স্থিতিশীল।
নতুন সরকারের বড় সমর্থক আন্দোলনকারীরা। বিশেষত সম্মুখ যোদ্ধারা। শহীদের রক্তের উত্তরাধিকার এই সরকার। তবে জাতির জন্য কষ্টের বিষয় হচ্ছে সেই যোদ্ধাদের মধ্যে যারা প্রাণে বেঁচে গেছেন অর্থাৎ সেই জীবন্ত লাশগুলোর সঠিক মর্যাদা না পাওয়া। অনেকে এখনো হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন। প্রকৃত চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ আসছে প্রায়শই। উল্টোদিকে আন্দোলনের নেতা অর্থাৎ স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানে অক্ষত থেকে নেতৃত্ব প্রদানকারীরা সরকারে ঢুকেছেন। তারা নানারকম সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রয়েছেন। হেলিকপ্টার ব্যবহার থেকে শুরু করে নানা রকম বিলাসিতা তাদের পেয়ে বসেছে। এই সময়ে ‘সংস্কার’ টেকসই করতে মাঠে সরব আন্দোলনকারী ছাত্রদের একটি অংশ। তারা সরকারের পরোক্ষ মদতে নতুন দল গঠনে তৎপর। যার মহড়া হয়েছে গত ৩১শে ডিসেম্বর, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এই দল গঠন তথা নতুন শক্তির উত্থান চেষ্টার খবরে নড়েচড়ে বসেছে দেশের প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলো। তারা এটাকে থ্রেট মনে করছে। ওয়াকিবহাল সূত্র বলছে, বাংলাদেশে নতুন শক্তির উত্থান চেষ্টা প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোর রোষানলে পড়বে- এটাই সঙ্গত। শুরু থেকেই জুলাই আন্দোলন এবং অভ্যুত্থানে সফলতার ভাগ দাবি করে আসছে প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলো। যদিও বিদেশি পর্যবেক্ষণ ছিল এটি ‘ননট্রেডিশনাল’ ফোর্সের আন্দোলন। এখানে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর স্টেক সামান্য। বিশ্লেষকরা বলছেন- সময় যত গড়াবে জুলাই আন্দোলনের রিয়েল পিকচার ততই খোলাসা হবে। যে যাই বলুক, এতে বিদেশিদের অনুমান সত্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর নতুন শক্তির উত্থান চেষ্টা। সেটার সফলতা বা ব্যর্থতা- নানা কিছুর ওপর নির্ভর করছে। বলাবলি আছে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের পেছনে ধর্মভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থন রয়েছে। সেই শক্তি প্রতিষ্ঠা পেলে ভবিষ্যতে ওই দলের সঙ্গে ভোটের জোটও হতে পারে। যাক, এটা বলা অমূলক নয়, যে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠিত শক্তিগুলোকে অনবোর্ডে রেখেই সেই শক্তিকে এগোতে হবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা এই ব-দ্বীপে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ডান বা বামের চেয়ে মধ্যপন্থার প্রতিই সমর্থন থাকবে কাছের, দূরের প্রতিবেশী এবং আরও দূরের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর।