কলকাতার চিঠি

ওয়াক্‌ফ বিল নিয়ে মোদি সরকারের আগ্রহের নেপথ্যে

পরিতোষ পাল, কলকাতা | এক্সক্লুসিভ
ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫
ওয়াক্‌ফ বিল নিয়ে মোদি সরকারের আগ্রহের নেপথ্যে

ইসলামী আইন অনুসারে, দাতব্য ও ধর্মীয় সম্পত্তি হলো ‘ওয়াক্‌ফ’। ভারতে সেনাবাহিনী ও রেলের পরে দেশে সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি হলো ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি। নিবন্ধিত ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির সংখ্যা হলো ৮ লাখ ৭২ হাজার। এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, কবরস্থান, দোকান, মাজার ও হাজার হাজার একর জমি। 
ওয়াক্‌ফ হওয়া মানে যেই সম্পত্তি আল্লাহ’র নামে অর্পিত হওয়া। সেই সম্পত্তি বিক্রি করা বা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। ওয়াক্‌ফ হলো ইসলামী সভ্যতার বিশেষ নিদর্শন। 
এই সম্পত্তি দেখভালের দায়িত্ব রয়েছে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের হাতে। ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য স্বাধীন ভারতে ১৯৫৪ সালে প্রথম ওয়াক্‌ফ কাউন্সিল ও ওয়াক্‌ফ বোর্ড গঠনের ব্যবস্থা হয়। ১৯৯৫ সালে বর্তমান ওয়াক্‌ফ আইন তৈরি করা হয়। ২০১৩-এর সংশোধনীতে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছিল। এবার সেই ওয়াক্‌ফ আইনে সংশোধনী এনে বিল এনেছে ভারত সরকার। এই বিল সংসদে পেশ করার পর থেকে শুরু হয়েছে নানা বাদ-প্রতিবাদ। সংসদ থেকে শুরু করে বিধানসভা, সর্বত্রই বিরোধীরা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সোচ্চার হয়েছে। ওয়াক্‌ফ সংশোধনী বিল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভাতে প্রস্তাবও পাস করানো হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসের উদ্যোগে। 
কিন্তু কেন ওয়াক্‌ফ বিল নিয়ে এত প্রতিবাদ? বিরোধীদের অভিযোগ, ওয়াক্‌ফ বোর্ডের ক্ষমতা খর্ব করা এবং ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ আনার লক্ষ্যে ভারত সরকার অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা করে এসেছে। আসলে সৌদি আরব বা আরব দেশগুলোতে ওয়াক্‌ফ বোর্ডের তেমন দাপট না থাকলেও ভারতে বোর্ড যথেষ্ট ক্ষমতাশালী। রাজ্যে রাজ্যে ওয়াক্‌ফ বোর্ডগুলো ভোগ করে এসেছে অসীম ক্ষমতা। বোর্ডের হাতে রয়েছে সম্পত্তিকে ওয়াক্‌ফ ঘোষণা করার প্রধান ও একমাত্র ক্ষমতা। সেই ক্ষমতায় লাগাম পরাতে চাইছে সরকার। সরকারের মতে, বোর্ড পরিচালনায় আধুনিকতা ও স্বচ্ছতা আনার লক্ষ্যেই সংশোধনী আনা হচ্ছে।  

 

তবে গত ২৮শে আগস্ট সংসদে বিলটি পেশ করা হলেও পরে তা যৌথ সংসদীয় কমিটিতে (জেপিসি) পাঠানো হয়েছিল। সেই কমিটি সারা দেশে বিভিন্ন অংশীদারদের সঙ্গে কথা বলেছে। কমিটির ৩৮টি বৈঠক হয়েছে। তবে এই সব বৈঠকে গত চার-পাঁচ মাসে নানা নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে। শাসক দল ও বিরোধীদের মধ্যে তুমুল সংঘাত, গ্লাস ছোড়া, হাত কেটে রক্ত ঝরা, সাসপেনশনের মতো ঘটনা ঘটেছে শাসক জোটের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিফলন হিসেবে। শেষ পর্যন্ত বিরোধীদের আনা ৪৪টি সংশোধনী খারিজ করে দিয়ে শুধুমাত্র শাসক জোটের আনা ১২টি সংশোধনীকে গ্রহণ করে বিলের খসড়ায় অনুমোদন দেয়া হয়। গত ২৯শে জানুয়ারি সেটি জেপিসি’র বৈঠকে ১৫-১১ ভোটে চূড়ান্ত করা হলেও বিরোধী দলগুলোর ১১ জন সদস্যই ডিসেন্ট নোট দিয়েছেন। ৩০শে জানুয়ারি কমিটির রিপোর্ট সহ খসড়া বিলটি লোকসভার অধ্যক্ষের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। এবার তা সংসদে পাস করানোর জন্য পেশ করা হবে। সংখ্যাধিক্যের জোরে সরকার বিলটি পাস করাতে সমর্থ হবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা। জেপিসি’র চেয়ারম্যান তথা বর্ষীয়ান বিজেপি সাংসদ জগদম্বিকা পালের বক্তব্য- এমন কয়েকটি সংশোধনীতে অনুমোদন দেয়া হয়েছে, যা বিরোধী সাংসদদেরও উদ্বেগ দূর করবে। প্রস্তাবিত সংশোধনী বিল যখন আইনে পরিণত হবে, তখন আরও স্বচ্ছতার সঙ্গে ও কার্যকরীভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে ওয়াক্‌ফ বোর্ড। কিন্তু মুসলিম সংগঠনের নেতারা মনে করেন, সংশোধনীর ফলে বিভাজনের বীজ রোপিত হবে। ধর্মীয় স্বাধীনতাও খর্ব হবে। ২৬১ পৃষ্ঠার ডিসেন্ট নোট দিয়ে অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিনের প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, সংশোধনী বিলে যা প্রস্তাব আছে, তা ওয়াক্‌ফ বোর্ডকে ধ্বংস করে দেবে।      
বিরোধের প্রধান ইস্যুগুলো কি কি?
 

বিলের সংশোধনীতে কেন্দ্রীয় ওয়াক্‌ফ কাউন্সিল ও রাজ্যের বোর্ডের গঠন প্রক্রিয়ায় বড় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এতদিন যেখানে ওয়াক্‌ফ কাউন্সিল ও বোর্ডের সদস্যরা সকলে মুসলিম সমপ্রদায়ের হতেন সেখানে এবার থেকে মুসলিম নন এমন ব্যক্তিকেও সদস্য করা হবে। রাজ্যের ওয়াক্‌ফ বোর্ডগুলোতে অন্তত দুজন করে অমুসলিম সদস্য রাখতে হবে। 
ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির নিরীক্ষার কাজেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতদিন যেখানে বোর্ড নিযুক্ত সার্ভে কমিশনার নিরীক্ষার কাজ করতেন এবার থেকে এই কাজের দায়িত্ব থাকবে সরকারি আধিকারিক কালেক্টরের উপর। 
 

সরকারি সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ হিসেবে চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ আর থাকবে না। এখন যে সব সরকারি সম্পত্তি ওয়াক্‌ফ হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে সেগুলোর মালিকানা কালেক্টর নিরুপণ করবেন। এবং তার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
এ ছাড়া সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রে এতদিন মুসলিম আইনের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত ট্রাইব্যুনাল যে দায়িত্ব পালন করতো এবার থেকে সেই ট্রাইব্যুনালই তুলে দেয়া হচ্ছে। কোনো বিরোধ নিষ্পত্তির প্রয়োজন হলে সরাসরি হাইকোর্টে আবেদন করতে হবে।
তবে ওয়াক্‌ফ করতে হলে সেই ব্যক্তিকে ৫ বছর ইসলাম ধর্ম মেনে চলতে হবে। এই বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। কেননা, ৫ বছরের কম মুসলিম ধর্ম পালন করছেন এমনরা কেন ওয়াক্‌ফ করতে পারবেন না তা স্পষ্ট নয়।
 

বিলের সংশোধনীতে আরও বলা হয়েছে, সম্পত্তির মূল্যায়নের সুবিধার্থে প্রতিটি ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি নিবন্ধিত হতে হবে। 
ধর্মীয় কারণে ব্যবহৃত জমি বা সম্পত্তি এতদিন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ওয়াক্‌ফ বলে বিবেচিত হতো। যুগ যুগ ধরে এটাই হয়ে এসেছে। এবার থেকে সেটা হবে না। আর তাই দ্রবিড়া মুন্নেত্রা কাঝাঘাম দলের সাংসদ এ রাজা ও এম এম আসাদুল্লাহ এই ব্যবস্থাকে ওয়াক্‌ফ বিনাশকারী বিল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
অমুসলিমদের বোর্ডের সদস্য করার বিষয়টিকে অসাংবিধানিক বলে মনে করছেন বিরোধীরা। সংবিধানে সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার যে অধিকার দেয়া হয়েছে তা নতুন ব্যবস্থায় খর্ব করা হচ্ছে। এমনকি ধর্মীয় স্বায়ত্তশাসনের অধিকারও কেড়ে নেয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন মুসলিম আইনের বিশেষজ্ঞরা।
বিলের সংশোধনীতে কেন্দ্রীয় সরকারকে যেকোনো সময় যেকোনো ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির অডিট করানোর অধিকার দেয়ার অধিকার দেয়া হচ্ছে। আরও অনেক পরিবর্তন আনা হয়েছে।
আসলে সরকারের বিল সংশোধনের নামে প্রতিটি পদক্ষেপই কোনো না কোনো ভাবে মুসলিমদের অধিকারে হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ওয়াক্‌ফ সংক্রান্ত অধিকারে সরাসরি সরকারি নাক গলানোর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে এই বিলের মাধ্যমে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম সমপ্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
এই বিলের ফলে নতুন নতুন বিরোধ দেখা যাবে এবং ওয়াক্‌ফ সম্পত্তিগুলো ঘোরতর বিপদের মুখে পড়বে। মুসলিম নেতাদের মতে, ওয়াক্‌ফ সম্পত্তি কব্জা করার লক্ষ্য এবার থেকে সক্রিয় হবে।  
প্রশ্ন উঠেছে, এই বিল পাস করানোর পেছনে কি হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা কার্যকর করার সুপ্ত অভিলাষ কাজ করছে? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ হলো, বিলটি পাস করানোর জন্য শাসক দলের তাড়াহুড়ো নিয়েই সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের অভিপ্রায় স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন এই বলে যে, ভারতের সংবিধানে ওয়াক্‌ফ বলে কিছু নেই। এই প্রসঙ্গে জামায়াতে উলেমা-ই হিন্দের সভাপতি আর্শাদ মাদানি অভিযোগ তুলে বলেছেন, আগামী দিনে কি প্রার্থনা, রোজা, হজ, যাকাতের মতো বিষয়গুলো সংবিধানে নেই বলে নিষিদ্ধ করা হবে কি?
এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলোচনায় বলেন, সারা দেশে যে বিভাজনের পরিবেশ তৈরি হয়েছে সেখানে এই বিলের মাধ্যমে সংশোধনীগুলো আনা জরুরি ছিল না। ওয়াক্‌ফ সম্পত্তির অপব্যবহার ও দুর্নীতির অভিযোগ বহু। কিন্তু সে সব অন্যভাবে মোকাবিলা করা যেতো। কিন্তু বিলে এমন সব পরিবর্তন আনা হয়েছে তাতে বিরোধ বাড়বে বৈকি কমবে না। তার মতে, এই বিলের ফলে বিচার বিভাগের দায়িত্বের চেয়ে বড় হবে সরকারি আধিকারিকদের দায়িত্ব। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে ওয়াইসির বক্তব্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মুসলিম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, এমন সময়ে বিলটি আনা হয়েছে যখন বিভাজনকারী শক্তি মুসলিম ধর্মীয় উপাসনা স্থান হিসেবে শত শত বছর ধরে ব্যবহৃত মসজিদ, দরগাগুলোর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এই বিলের ফলে আদালতেও এই সব বিরোধের ক্ষেত্রে মুসলিমদের আত্মপক্ষ সমর্থনের দাবিকে দুর্বল করবে। এর ফলে কি সহজেই হিন্দুত্ববাদীদের দাবি অনুযায়ী দরগা-মসজিদ মন্দিরে পরিণত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে চলেছে?

 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর