প র্যা লো চ না

হাসিনা-আসাদের মিল ও অমিল

শহীদুল্লাহ ফরায়জী | এক্সক্লুসিভ
ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫
হাসিনা-আসাদের মিল ও অমিল

পরাক্রমশালী শেখ হাসিনা এবং বাশার-আল-আসাদের ক্ষমতার মসনদ ও সাম্রাজ্য তছনছ হয়ে গেছে। অহমিকার রাজকীয় সিংহাসন এবং অভূতপূর্ব ক্ষমতা ধুলোয় মিশে গেছে। যারা রাষ্ট্র ও সমাজে ঘৃণা-বিদ্বেষের বিষবাষ্প ছড়াতেন, জনগণের অধিকার ও মর্যাদাকে নির্মমভাবে ধ্বংস করতেন, সেই তাদেরকে সংগ্রামের আগুনে ঋদ্ধ ছাত্র এবং জনগণ উচ্ছেদ করেছে। আজ তারা ইতিহাসের কাছে করুণাযোগ্য, গণহত্যায় অভিযুক্ত, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নির্দেশদাতা। মানুষ হত্যাকারী কসাই এবং তাদের সহযোগীদের বিচারের মুখোমুখি করাই হবে গণ-অভ্যুত্থান কালপর্বের অন্যতম কর্তব্য। এই মুহূর্তে প্রভুদের সমর্থনপুষ্ট ভীরু-পলায়নপর ক্ষমতাহীন, অসহায়, বিপজ্জনক দুই শাসক নিয়ে বিপুল মাত্রায় আলোচনা/সমালোচনা হচ্ছে। অন্যদিকে অভ্যুত্থান বা বিপ্লব স্বল্পকালের মধ্যে সমগ্র জাতিকে যেভাবে সমৃদ্ধ ও শিক্ষা দেয় তার জন্য ক্ষমতাচ্যুতদের কার্যকলাপ পর্যালোচনার প্রয়োজন হয়। এদের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চূর্ণ করতে না পারলে- মুক্তি, অর্জন, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিপর্যয় ঘটবে। জনগণের বিজয়কে নতুন করে সর্বনাশের দিকে নিয়ে যাবে। জনগণ কর্তৃক উৎখাতকৃত দুই স্বৈরশাসকের তুলনামূলক সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ:-
মিল
১) শেখ হাসিনা ও বাশার-আল-আসাদ; দু’জনই এই শতকের আলোচিত/সমালোচিত  স্বৈরাচার। দু’জনই নিষ্ঠুর ও নির্মমতার  প্রতিচ্ছবি। দু’জনই হত্যা-দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের পাপে গুরুতর পাপী।
২) অভূতপূর্ব বিপর্যয়-প্রতিরোধে দু’জনই সর্বোচ্চ মাত্রায় শক্তি প্রয়োগ করার পরও একজন ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে এবং অন্যজন সশস্ত্র অভ্যুত্থানে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়েছেন।
৩) দু’জনই প্রতিপক্ষকে নির্মমভাবে উপড়ে ফেলতে চেয়েছেন, পরিশেষে দু’জনকেই জনগণ ছুড়ে ফেলেছে। দু’জনেই প্রতিপক্ষকে হত্যা এবং নির্মূলের চেষ্টা করেছেন।
৪) শেখ হাসিনা ভাবতেন- ক্ষমতা অবিনশ্বর। বাশার-আল-আসাদ ভাবতেন- ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী এবং আজীবন। 
৫) দু’জনই ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য দেশের নাগরিক হত্যাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছেন। 
৬) দু’জনই ঠাণ্ডা মাথায় প্রতিপক্ষকে খুন, গুম ও কারাগারে রেখে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার অপকৌশল প্রয়োগ করেছিলেন। 
৭) দু’জনেরই তাসের ঘর ভেঙে গেছে। তাদের দাম্ভিকতাপূর্ণ সরকারের পতন হয়েছে। দু’জনেই দেশ ছেড়ে পরিবার-সহ  বিমান-যোগে পলায়ন করেছেন।
৮) দু’জনই ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে বিদেশি প্রভুর আনুগত্যে মশগুল ছিলেন।
৯) দু’জনে বিশ্বাস করতেন- জনগণ নয়, ক্ষমতার উৎস সশস্ত্র শক্তি এবং বিদেশি প্রভু। 
১০) দু’জনেই প্রভুর আশ্রয়ে আশ্রিত হয়ে আছেন। 
১১) নিজ অপকর্মের দায়ে দু’জনের পিতার স্থাপত্যই জনগণ ভূলুণ্ঠিত করেছে। বিক্ষুব্ধ জনতা একজনের পিতার বাসস্থান গুঁড়িয়ে দিয়েছে, অন্যজনের পিতার সমাধিস্থল পুড়িয়ে দিয়েছে।
১২) এবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাশার বলেছিলেন- ‘আমাদের কারাগারে কোনো ব্যক্তিকে রাজনৈতিক বিবেচনায় আটক রাখা হয়নি।’ তেমনি শেখ হাসিনা বলেছিলেন-  
বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক মামলা নেই, রাজনৈতিক মামলায় কেউ কারাগারেও নেই।
১৩) তারা দু’জনেই ভগ্নিপতির প্রতি বেশ আস্থাশীল ছিলেন। জেনারেল আসেফ শাওকাত, সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান, তিনি ছিলেন বাশার-আল-আসাদের ভগ্নিপতি এবং জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, সেনাবাহিনীর প্রধান, তিনি ছিলেন শেখ হাসিনার ভগ্নিপতি। কিন্তু কেউই করুণ পরিণতি ঠেকাতে পারেননি।
১৪) দু’জনের পিতাই ছিলেন প্রেসিডেন্ট। পিতার মৃত্যুতে উত্তরাধিকার সূত্রে রাজনীতিতে তাদের আগমন। হাসিনা এবং আসাদ রাষ্ট্রকে একনায়কতান্ত্রিক ও একচ্ছত্রবাদী বংশানুক্রমিক শাসনব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত করার স্বপ্ন দেখতেন।
১৫) দু’জনের শাসনামলকেই দেশবাসী মনে করে- অন্ধকার যুগের অবসান ঘটেছে এবং এক নতুন যুগের সূচনা ঘটেছে। দু’জনের দেশেই তাদের পতনে পথে-পথে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে উল্লাস করতে দেখা গেছে।
১৬) হিটলার এবং পল জোসেফ গোয়েবলসের অনুগত ছিলেন শেখ হাসিনা ও আসাদ। কিন্তু হিটলার এবং গোয়েবলস পালাননি বরং আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কিন্তু হাসিনা ও বাশার আল-আসাদ দু’জনেই কাপুরুষের মতো পালিয়েছেন, আত্মহত্যা করেননি।
১৭) দু’জনেরই প্রাসাদ জনগণ দ্বারা আক্রান্ত। 
১৮) হত্যা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য দু’জনকেই বিচারের মুখোমুখি করা হবে।
১৯) তারা দু’জনেই তাদের স্ব-স্ব রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সম্ভাবনা বিনষ্ট করেছেন।
২০) দু’জনই ক্ষমতাচ্যুত। শেষ পর্যায়ে এসে প্রভুরা তাদের সুরক্ষা দেয়নি কিন্তু তাদের ক্ষমতাচ্যুতি প্রভুদের মনে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। পরাজয়ের গ্লানি তারা ভোগ করছেন। 
২১) দু’জনেরই ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে অতি গোপনে পালিয়ে যাওয়ার সময়- ভয়ে-আতঙ্কে বিমানের ট্রান্সপন্ডার বন্ধ রাখা হয়েছিল।
২২) দু’জনকেই নিজ দেশে গণহত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করা হবে, দু’জনের ভবিষ্যৎই অনিশ্চিত।
২৩) দু’জনই জনগণ দ্বারা বিতাড়িত। তবে একজন ভারতে থেকেও এখনো অতি উৎসাহ নিয়ে ক্ষমতা থাকাকালীন সেই অপপ্রচার-প্রোপাগান্ডা এবং গোয়েবলসীয় মিথ্যাচারের কৌশল অব্যাহত রেখেছেন। অন্যজন রাশিয়ায় আত্মগোপনে থেকেও প্রোপাগান্ডার আশ্রয়ে  আছেন। একজন পলায়নপর থেকেও কথা বলে দেশকে অস্থিতিশীল করছেন, আরেকজন কথা বলার সুযোগ খুঁজছেন। 
২৪) বাশার-আল-আসাদ দেশের নাগরিক খুন করে গণকবরে পুঁতে রেখেছে, আর শেখ হাসিনার সরকার গুম করে লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছে।

অমিল
১) শেখ হাসিনা ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদের জননী, বাশার-আল-আসাদ ২৪ বছরে স্বৈরাচারের রাজা। দু’জনের মসনদই বিদ্রোহের ঝড়ো হাওয়ায় তছনছ হয়ে গেছে। একজন ৩৬ দিনের, অন্যজন ১২ দিনের আন্দোলনে উৎখাত।
২) শেখ হাসিনা পালাবো না বলে দৃঢ় অঙ্গীকার করে পালিয়েছেন আর বাশার-আল-আসাদ প্রতিশ্রুতি না দিয়েই পালিয়েছেন।
৩) দু’জনই গণহত্যায় অভিযুক্ত। একজন অস্বীকার করার মাঝে আত্মতৃপ্তি খোঁজেন, অন্যজন গণহত্যার প্রশ্নে নীরবতা পালন করছেন। 
৪) শেখ হাসিনার বিবেকের বিচারালয় চুরমার হয়ে গেছে। বিচারশক্তি, ন্যায্যতার শক্তি এবং চিন্তাশক্তি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাশার-আল-আসাদের এখনো হয়তো নিয়তির লিখন উপলব্ধি করার সক্ষমতা বিলীন হয়নি।
৫) একজন বিদেশের মাটিতে বসে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করেন, অন্যজন দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তে বিরতিতে আছেন।
৬) সিরিয়ার ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার-আল-আসাদের পিতা প্রয়াত হাফিজ-আল-আসাদ পাঁচবার গণভোটে বিজয়ের মাধ্যমে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখেন। কিন্তু শেখ হাসিনার পিতা  জনগণ, সংসদ বা গণভোট ছাড়াই রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
হাফিজ-আল-আসাদ রাষ্ট্রপতি ছিলেন ৩০ বছর আর শেখ মুজিবুর রহমান একদলীয় বাকশাল করে রাষ্ট্রপতি ছিলেন মাত্র ৭ মাস। 
৭) একজনের পিতা ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন; আরেক জনের পিতা ৫৫ বছর বয়সে খুন হয়েছেন।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে, হত্যার নির্দেশদাতাদের বিরুদ্ধে, যুগে যুগে ফাঁসি, কারাগার এবং গুলি অগ্রাহ্য করে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে জেগে উঠে জনতা। অত্যাচার এবং ভয় দেখিয়ে মানুষকে শৃঙ্খলিত রাখা যায় না। ইতিহাসের এই ঐতিহাসিক শিক্ষা শেখ হাসিনা এবং বাশার-আল-আসাদ নেয়নি। বাস্তবতাহীন শ্রেষ্ঠত্ব বোধের কারণে তারা এখন অনিবার্য নিয়তির শিকার। ইতিহাস তাদের করুণা করছে, তারা পরাজিত। ন্যায্যতাকে অপসারিত করে ক্ষমতা চর্চা একজন মানুষকে ক্রমাগত দয়াহীন ও বর্বর করে তোলে।
জীবনের মহাকাব্য অনেক বড়ো, অনেক মহান, তাই জীবনের মহাকাব্যের দিকে বারবার ফিরে তাকাতে হয়। ্ত
লেখক: গীতিকবি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
faraiæees@gmail.com

 

 

এক্সক্লুসিভ'র অন্যান্য খবর