বি ত র্ক

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানেই কি আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন?

মোহাম্মদ আবুল হোসেন | মতামত
মার্চ ১৫, ২০২৫
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানেই কি আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন?

৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পানি অনেকদূর গড়িয়েছে। মাঝে মাঝেই উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠছে। আবার শীতল হচ্ছে। কিন্তু  ভেতরে ভেতরে যে একটি অস্বস্তিকর অবস্থা চলছে তা সচেতন মানুষমাত্রেই বুঝতে পারেন। এমনিতেই শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগের প্রতি ভারতের সফটকর্নার আছে। এর কারণ আলোচনা করলে লেখার কলেবর বিশাল হয়ে যাবে। আশা করি পাঠকরা এসব বিষয়ে জানেন। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে ভারতের মাথাব্যথা এই দেশটির জন্মের সময় থেকেই। হয়তো,  ভেতরে ভেতরে তারও আগে থেকে চলছে এই খেলা। দেশটি স্বাধীন করতে ভারত যে সহযোগিতা করেছে, তা বাংলাদেশিমাত্রেই স্বীকার করেন। এটা নিয়েও আছে বিস্তর বিতর্ক। কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশকে ভারত স্বাধীন হতে সহায়তা করেছে নিজেদের স্বার্থে। তবে সে যা-ই হোক, তারা আমাদের বিপদের সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছে- এটা তো কম কিছু নয়। তবে বেদনা দেয় তখনই যখন ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ভারত আখ্যায়িত করে ‘ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ’ হিসেবে। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ, তথা বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করা হয়। সেই বিতর্কেও না যাই। আসি বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের ভাবনায়। শেখ হাসিনা পালিয়ে গিয়ে নয়াদিল্লিতে কোনো এক গোপন ডেরায় অবস্থান করছেন। তাকে ফেরত চাইছে বাংলাদেশ। কারণ, তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা হয়েছে। এসব মামলা তাকে মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের কাছে সরকার অনুরোধ করেছে শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে। সম্প্রতি বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়সীমা ঘোষণা করেছেন। সে অনুযায়ী এ বছরের ডিসেম্বরে এবং আগামী বছরের জুনের মধ্যে নতুন নির্বাচন হতে পারে বলে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। ঠিক এমন সময়ই ভারতের টনক নড়েছে। এরপর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দাবি করেছেন। বলেছেন, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশকে সমর্থন করি আমরা, যেখানে সব সমস্যার সমাধান হতে হবে গণতান্ত্রিক উপায়ে, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে। আসলে এই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে তিনি বা ভারত কী বুঝাতে চাইছে, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় ভারতের প্রভাবশালী টেলিগ্রাফ পত্রিকায় সাংবাদিক দেবাদীপ পুরোহিত একটি প্রতিবেদনে লিখেছেন, ৭ই মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দু’টি তীক্ষ্ণ ইঙ্গিত দিয়েছেন। তা হলো- শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগকে কোনোভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে রাখা উচিত নয়। অন্যটি হলো বাংলাদেশের সঙ্গে জ্বালানি চুক্তির প্রসঙ্গ।  
দেবাদীপ পুরোহিত লিখেছেন, শেখ হাসিনার দলের প্রতি অন্তর্র্বর্তী সরকারের বিদ্বেষ আছে। দেশ জুড়ে এ দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে যে দমনপীড়ন চলছে, তাতে সেই বিদ্বেষ প্রতিফলিত হয়। ফলে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাস করছেন নির্বাচন হওয়া উচিত একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালে যতবার নির্বাচন হয়েছে তার আগে, পরে এবং স্বাভাবিক সময়ে বিরোধীদলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গণহারে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেই গ্রেপ্তার এড়াতে ভিন্নমতাবলম্বীরা মাঠে, জঙ্গলে রাত কাটিয়েছেন। এসব ছবি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। ওইসব ভিন্নমতাবলম্বী বা বিরোধী নেতাকর্মীদের একটাই চাওয়া ছিল একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। তাদের সেই গ্রেপ্তার নিয়ে ভারত একটি কথাও বলেনি। বলেনি যে, এদেরকে গণহারে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার গুলশানের ফিরোজার চারপাশে বাসা থেকে বের হওয়ার রাস্তা বালুর ট্রাক দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছিল। কই তখন কিন্তু ভারত টুঁ- শব্দটি করেনি। তখন কি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি তুলেছিল তারা?  


ভারতের আজকের এই ভূমিকায় নিশ্চয়ই আপনি বিস্মিত হবেন, যদি ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকে। ২০০৮ সালের নির্বাচন বাদে বাকি সবটা নির্বাচন নিয়ে তীব্র বিতর্ক আছে। কোনোটাতে নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি সহ বড় রাজনৈতিক জোট। কোনোটাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৩ জন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। অর্থাৎ ওইসব আসনের ভোটারদের ভোট দেয়ার কোনো প্রয়োজন হয়নি। আবার কোনো নির্বাচনে ভোট হয়েছে মাঝরাতে। সর্বশেষ নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্র অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর তাগিদ দেয়। কিন্তু ভারতের কাঁধে কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছে আওয়ামী লীগ। আন্তর্জাতিক মহল এসব নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলে, সমালোচনা করলেও ভারত এতে বৈধতা দিয়েছে। তখন কিন্তু তাদের কাছে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কোনো বুলি ছিল না। থাকলেও সেটা ছিল মুখে, তাদের কাজে তার প্রমাণ মেলেনি। 


২০০৮ সালের পর অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচন নিয়ে প্রহসন হয়েছে। নির্বাচন কমিশন ঘুমের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ ভোট পড়ার খোয়াব দেখতে পেয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ সর্বশেষ তিনটি নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি। নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা- অথচ সবার আগে ভারত বৈধতা দিয়েছে। তারা নির্বাচনের পরে প্রশ্ন তোলেনি- নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। অথচ, এখন তাদের এই যে অবস্থান তা সম্ভবত সাংবাদিক দেবাদীপ পুরোহিত যথার্থই তার বিশ্লেষণে তুলে ধরেছেন। তিনি বুঝাতে চেয়েছেন, ভারত এখন যে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে- তার অর্থ হলো আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই হবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। কেউ হয়তো প্রশ্ন করবেন- ভারত তো নির্বাচনের আগেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেছে! কিন্তু প্রশ্ন সুজাতা সিংয়ের ঝটিকা সফর কি প্রমাণ করেছে! তারা যেকোনো মূল্যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে। 


আওয়ামী লীগ যেমন তার নিজের কোনো ভুল দেখতে পায় না, ঠিক তেমনই তাদের চোখ দিয়ে এ দলটিকে বিচার করে ভারত। ফলে আওয়ামী লীগ ক্রমশ দৈত্যে পরিণত হয়। এতে স্পষ্ট করে বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে, ক্ষমতার পালাবদলে ভারতের যথেষ্ট প্রভাব আছে। এ কথার সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের ঠিক দশ মাস আগে বাংলাদেশের তখনকার সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে যান। এ সময় তিনি সাক্ষাৎ করেন প্রণব মুখার্জীর সঙ্গে। সে সময় শেখ হাসিনা ও বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দেয়ার জন্য জেনারেল মইনের প্রতি আহ্বান জানান। প্রণব মুখার্জী তার  ‘দ্য কোয়ালিশন ইয়ার্স (১৯৯৬-২০১২)’ আত্মজীবনীতে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা ছাড়া পেলে তাকে (মইন) বরখাস্ত করে দেবেন, এটা ভেবে  জেনারেল (মইন) একটু উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাকে বলি,  শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে এলেও তার (মইন) চাকরি বহাল থাকবে। এমনকি (রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির বিষয়ে) মার্কিন  প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপ চেয়ে আমি তার সঙ্গেও অ্যাপয়েনমেন্টের ব্যবস্থা করি’। শেষ পর্যন্তু দুই নেত্রী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর পেছনে ভারতের ভূমিকার কথা স্বীকার করেছেন ভারতের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জী। 
২০২৩ সালে বিবিসি এক প্রতিবেদনে লিখেছে- খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০১-০৬) অনেকটা সময় ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন বীণা সিক্রি। তিনি বলেছিলেন, ‘এটা কোনো গোপন কথা নয় যে সে সময় দিল্লি ও ঢাকার সম্পর্ক একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, যাতায়াত, সহযোগিতা সবই লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছিল। ভারতের উত্তর-পূর্বের জঙ্গিরা সরাসরি মদত পাচ্ছিল। এই অবস্থাটা যে অবিলম্বে পাল্টানো দরকার তা নিয়ে দিল্লিতে কোনো দ্বিমত ছিল না।’ বীণা সিক্রি এটাও মনে করিয়ে দেন যে, বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য ভারতকে কিছুই করতে হয়নি। কারণ ‘বাংলাদেশের জনগণের বিপুল সমর্থনেই’ তিন-চতুর্থাংশের বেশি আসনে জিতে আওয়ামী লীগ সেবার ক্ষমতায় এসেছিল। শেখ হাসিনার বিপুল জয়লাভের পর ভারত সরকার তাকে স্বাগত জানিয়ে নির্বাচনের পরদিন (৩০শে ডিসেম্বর) যে বিবৃতিটি দিয়েছিল সেটিও প্রণিধানযোগ্য। প্রণব মুখার্জীর মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওই বিবৃতিতে সেদিন বলা হয়, ‘ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যেভাবে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটলো, তাতে ভারত বাংলাদেশের মানুষকে অভিনন্দন জানায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের এই ঐতিহাসিক বিজয় সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটি বিরাট মাইলফলক।’


এরপরই সামনে আসে ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন। ওই বছর ৫ই জানুয়ারি নির্বাচন হয় দেশে। এতে ভারতের তথাকথিত ‘হস্তক্ষেপ’ সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এর কারণ হিসেবে বিবিসি এক রিপোর্টে বলেছিল-  “এর কারণ হলো নির্বাচনের ঠিক এক মাস আগে ভারতের তৎকালীন শীর্ষ কূটনীতিকদের বিতর্কিত ঢাকা সফর। ভারতের তখনকার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং ২০১৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর সরকারি সফরে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশে আসেন। এই সফরেই তিনি একে একে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তৎকালীন বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়া ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান (প্রয়াত)  জেনারেল এইচ এম এরশাদের সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেন। সুজাতা সিং আলোচনায় বসেন বাংলাদেশের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী ও পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের সঙ্গেও। এ ছাড়াও বাংলাদেশের প্রথম সারির সব গণমাধ্যমের সম্পাদকের সঙ্গেও তার একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সেই সফরের আগেই প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জানিয়ে দিয়েছিল তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। নির্বাচন  থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা জানিয়েছিল জাতীয় পার্টিও। ওই সময় ভারত ও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে লেখা হয়েছিল, জাতীয় পার্টিকে চাপ দিয়ে নির্বাচনে নিয়ে আসতে এবং নির্বাচনকে একটি ‘গ্রহণযোগ্য’  চেহারা দিতেই সুজাতা সিং জেনারেল এরশাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। জাতীয় পার্টির প্রধান নিজেও সে রকমই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে জেনারেল এরশাদ প্রথমে  সেই অনুরোধে রাজি না হলেও পরে সরকারের চাপে নির্বাচনে আসতে বাধ্য হন এবং বিএনপি’র অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টিই প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা নেয়। ৫ই ডিসেম্বর ২০১৩ তারিখেই ঢাকায় সাংবাদিকদের সামনে সুজাতা সিং অবশ্য দাবি করেছিলেন, যেকোনো গণতন্ত্রে বিরোধী দলের একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে এবং খালেদা জিয়া ও জেনারেল এরশাদের সঙ্গে তার বৈঠক বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভারতের ‘চলমান সংলাপ প্রক্রিয়া’রই অংশ। ঢাকায় তখনকার ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পঙ্কজ শরণকে পাশে নিয়ে সুজাতা সিং  সেদিন আরও বলেন, ‘ভারত যে একটি স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও প্রগতিশীল বাংলাদেশকে দেখতে চায় এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সফল সম্পাদনের ওপর গুরুত্ব  দেয়, আমার এই বৈঠকগুলোতে আমি সেই বিষয়টির ওপরেই জোর দিয়েছি।” ঢাকার মিডিয়াতে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সেই মন্তব্যের ব্যাখ্যা করা হয়েছিল এভাবে- বাংলাদেশের নির্বাচনকে ‘ইনক্লুসিভ’ বা ‘অংশগ্রহণমূলক’ দেখানোর জন্যই ভারত সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দিল্লিতে একটি থিঙ্কট্যাঙ্কের সিনিয়র ফেলো ও বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ স্মৃতি পট্টনায়ক অবশ্য মনে করেন, সুজাতা সিংয়ের সেই সফরকে গণমাধ্যমে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিকই যে তার উদ্যোগকে অনেকেই ‘হস্তক্ষেপ’ হিসেবে  দেখেছিলেন। কিন্তু আমি মনে করি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের প্রধান লক্ষ্য ছিল ঘরের পাশে বাংলাদেশে একটি সাংবিধানিক বিপর্যয় এড়ানো।’ বিরোধী দলগুলোকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন হলে তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃতি পাবে না এবং বাংলাদেশ একটা সংকটের মুখে পড়বে, যা ভারতের জন্যও কাঙ্ক্ষিত নয়- এই আশঙ্কা থেকেই দিল্লি ওই পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে ড. পট্টনায়কের অভিমত।
শেষ পর্যন্ত বিএনপিবিহীন ওই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের হিসেবে প্রায় ৪০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পড়ে ও আওয়ামী লীগ ২৩৪টি আসনে জেতে। ভারত মনে করেছিল, বিএনপি না-এলেও জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনী ময়দানে নিয়ে আসতে পারায় এবং মোটামুটি ‘রিজনেবল’ একটা ভোট প্রদানের হার নিশ্চিত হওয়ায় বাংলাদেশের ওই নির্বাচনের মান্যতা পেতে সমস্যা হবে না। ঠিক এক সপ্তাহ পর আবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন  শেখ হাসিনা। যে বিশ্বনেতারা তাকে সবার আগে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-ও।” প্রশ্নটা থেকে যায় এখানে- তাহলো বিএনপিবিহীন সেই নির্বাচন কী অংশগ্রহণমূলক ছিল? তখন কেন ভারত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলেনি। নির্বাচনের পর সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে! এর সহজ উত্তর হতে পারে- ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। আর নেই ভাবনা। 


এরপর আসে ২০১৮ সালের ৩০শে ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে অনেক আশা নিয়ে অংশ নিতে আসে বিএনপি সহ বিরোধী দলগুলো। তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দেন একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের। কিন্তু পরে দেখা গেল, সেই নির্বাচনের আগে মাঝরাতে হয়ে গেছে ভোট। কেন্দ্রে গিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে ভোটারদের। এ বিষয়ে প্রামাণ্য ভিডিও প্রকাশ করে বিবিসি। ওই সময় ঢাকায় ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ছিলেন পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী। তিনি নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, বাংলাদেশের ওই নির্বাচন যেহেতু অনেকটাই অংশগ্রহণমূলক হতে যাচ্ছে তাই ভারতেরও  সেটা নিয়ে ‘অত মাথা ঘামানোর কোনো প্রয়োজন নেই’!


প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করলেও নির্বাচনে ভারতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের দিকেই ছিল, তা অবশ্য দিল্লিতে কোনো গোপন বিষয় ছিল না। বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়, যখন ৩০শে ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ভোটগ্রহণের দিনই মাঝপথে এই ‘মধ্যরাতের নির্বাচন’কে বয়কট করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়ায় বিরোধী দল বিএনপি। এই নির্বাচন কি অংশগ্রহণমূলক ছিল? এই নির্বাচনের পরেও বিজয়ী আওয়ামী লীগের সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে দিল্লি। ভারত থেকে আসা ‘পর্যবেক্ষক’রা তখন বাংলাদেশে ছিলেন, তাদের রিপোর্টেও এই সব কারচুপি বা জালিয়াতির কোনো উল্লেখ ছিল না। বিবিসি লিখেছে, ৩১শে ডিসেম্বর সকালে দিল্লি থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ফোন আসতে একটু দেরি হচ্ছিল বলে ঢাকায় মৃদু অস্বস্তিও তৈরি হচ্ছিল।


অবশেষে বাংলাদেশ সময় বেলা এগারোটা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী মোদি ঢাকায় ফোন করে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে অভিনন্দন জানান। দু’জনের মধ্যে বেশ খানিকক্ষণ ধরে অত্যন্ত ‘বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনা’ হয়। বিশ্বনেতাদের মধ্যে নরেন্দ্র মোদিই যেহেতু প্রথম তাকে  ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন, সে জন্য  শেখ হাসিনাও তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। 


সর্বোপরি ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারিতে নির্বাচনের নামে আরেক প্রহসন হয়। সাংবাদিকরা সারাদিন সরজমিন ভোটের যে সংখ্যা পান, বিকাল নাগাদ তা ঘুমের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগে পৌঁছে যায়। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ঢাকায় নিযুক্ত তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস্‌ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছিলেন এবং দিয়েছেন। তা নিয়ে পুরো ২০২৩ সাল সরগরম ছিল ঢাকার রাজনীতি। তখন অভিযোগ করা হয়েছিল, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে পিটার হাস্‌ ও যুক্তরাষ্ট্র বিএনপিকে ক্ষমতায় আনতে চাইছেন। তা নিয়ে পানি ঘোলাতে ঘোলাতে যখন তা কাদায় পরিণত হলো, তখন ভারতের প্রভাবে উত্তেজনা কমে আসে। বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে। সমমনা দলগুলো নির্বাচন বর্জন করে। আওয়ামী লীগ এক ‘ফ্রাজিল’ সরকার গঠন করে। এ নির্বাচনকেও বৈধতা দেয় ভারত। তারা এরপরও বলেনি- অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়নি। অথচ এখন আওয়ামী লীগ দৃশ্যত নির্বাসনে। এখন তাদের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ। এ জন্যই সাংবাদিক দেবাদীপ পুরোহিত বলতে চেয়েছেন, এই অংশগ্রহণমূলক মানে হলো আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে নিয়ে আসা। তাদেরকে পুনর্বাসন করা। 


লেখার ইতি টানতে চাই এই বলে যে, আমি বা আমরা একটি শান্তিপূর্ণ, সব ধর্মবর্ণের মানুষের সহাবস্থানমূলক বাংলাদেশ চাই। সেখানে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি, জাতীয় ন্যাশনাল পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন সহ সব রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হবে এক ও অভিন্ন। তা হলো- দেশের উপকার করা। মানুষের কল্যাণ করা। আমাদেরকে ‘বড় ভাই’রা পরামর্শ দিতে পারে, কিন্তু তারা দূত পাঠিয়ে কাউকে জোর করে নির্বাচনে পাঠিয়ে দিয়ে শান্তি আনতে পারবে না। এটা প্রমাণিত। বাংলাদেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসে, তৈরি পোশাক থেকে যে অর্থ আসে- যদি দেশটাতে নৈতিকতা থাকতো, যদি দুর্নীতিমুক্ত থাকতো, তাহলে অনেক আগেই বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা হংকং হয়ে যেতে পারতো। তা পারেনি, কারণ আমাদের ‘পিয়ন’দের ৪০০ কোটি টাকা থাকে। তা নিয়ে আমরা গর্ব করে কথা বলি। আমাদের সাবেক কোনো মন্ত্রীর লন্ডনের মতো জায়গায় সাড়ে তিনশ’ ফ্ল্যাট থাকে। টাকা যা, সবই দেশের বাইরে। তাহলে সেই ‘তলাবিহীন ঝুড়িতে’ তলা লাগাবে কে? 

মতামত'র অন্যান্য খবর