সাংবিধানিক সামরিকীকরণ

পাকিস্তানে বিপজ্জনক নজির

শহীদুল্লাহ ফরায়জী | মতামত
ডিসেম্বর ৬, ২০২৫
পাকিস্তানে বিপজ্জনক নজির

পাকিস্তানের ২৭তম সাংবিধানিক সংশোধনীর মাধ্যমে শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তনই নয়-দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন ও বিপজ্জনক এক ধরনের ক্ষমতা-কাঠামোর জন্ম হলো। এতে শীর্ষ সামরিক-নেতৃত্বকে এমনভাবে আইনি ও সাংবিধানিক মর্যাদা দেয়া হয়েছে, যা আধুনিক দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসে নজিরবিহীন এবং গভীর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার ইঙ্গিতবাহী।
পাকিস্তান আগে থেকেই সামরিক প্রভাবিত রাষ্ট্র-কিন্তু এই সংশোধনী প্রথমবারের মতো এটিকে সাংবিধানিক করে তুলেছে। একে বলা যায় ‘Constitutional Camouflage’ বা সাংবিধানিক ছদ্মবেশে সামরিক ক্ষমতার স্থায়ীকরণ।
১. সামরিক কাঠামোর মৌলিক পুনর্গঠন: ‘সুপার জেনারেল’-এর আবির্ভাব
২৭তম সংশোধনীর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন। এর মাধ্যমে সেনাপ্রধানকে ‘ঈযরবভ ড়ভ উবভবহপব ঋড়ৎপবং’ (CDF) হিসেবে অভিষিক্ত করা হলো। এতে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী একক কমান্ডের অধীনে চলে গেছে। এই সংশোধনীতে ‘চেয়ারম্যান জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটি’ (CJCSC) পদটি বিলুপ্ত করে ‘চিফ অফ ডিফেন্স ফোর্সেস’ (CDF) পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ‘চিফ অফ ডিফেন্স ফোর্সেস’ (CDF)-এর দায়িত্ব সেনাবাহিনী প্রধান (ঈঙঅঝ)-এর সঙ্গে একীভূত করে দেয়া হয়েছে। ফলে নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর উপর সেনাপ্রধানের প্রভাব নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের বেসামরিক-সামরিক ভারসাম্যে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে।
২. আজীবন আইনি সুরক্ষা ও সংবিধানের ঊর্ধ্বে
ফিল্ড মার্শাল-সহ শীর্ষ সামরিক পদগুলোকে আজীবন আইনি সুরক্ষা, সুবিধা ও সাংবিধানিক মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এতে করে রাষ্ট্রপতির মর্যাদা গৌণ হয়ে পড়েছে। ফলে পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হলো- ‘Legal Absolutism’ বা আইনি চরমপন্থা। এই পন্থায়-
ক. তাদের বিরুদ্ধে মামলা কার্যত অসম্ভব,
খ. বিচার বা তদন্ত সীমিত,
গ. রাষ্ট্রের এই শক্তিশালী স্তরটি আইনগত পর্যালোচনার সম্পূর্ণ ঊর্ধ্বে অবস্থান করে।
এতে কেবল জবাবদিহির মৃত্যু নয়-ন্যায়, আইন এবং ক্ষমতার নৈতিক ভারসাম্যকেও সম্পূর্ণ ভেঙে দেয়া হলো। St. Augustine-এর ভাষায়-যখন আইন নৈতিক ভিত্তি হারায়, তখন প্রশ্ন জাগে-‘An unjust lwa is no lwa at all’ (একটি অন্যায় আইন, আইনই নয়)।
৩. বিচারব্যবস্থার পুনর্গঠন 
নতুন ‘Federal Constitutional Court’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পাকিস্তান কার্যত সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক কর্তৃত্বকে খণ্ডিত করেছে। যে-আদালত একসময় সাংবিধানিক রক্ষাকবচ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তাকে এখন নির্বাহী-সামরিক সমন্বিত কাঠামোর অধীনে “বিভক্ত কর্তৃত্ব”-এর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
এই পুনর্গঠনের ফলে-সামরিক ও নির্বাহী সিদ্ধান্তের ওপর বিচারিক তদারকি নরম হয়ে গেছে, এতে রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রীভূত অপব্যবহারকে চ্যালেঞ্জ করার সাংবিধানিক শক্তি দুর্বল হয়েছে। আদালতের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কারণ সুপ্রিম কোর্টের বিচারিক পরিধি কমিয়ে এনে এমন একটি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে যেখানে সেনাবাহিনী-নির্বাহী জোটের সিদ্ধান্তগুলো কার্যত “পরীক্ষার বাইরে” চলে যায়। সাংবিধানিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্র সরাসরি রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাবের অধীনে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা সংবিধানকে রক্ষার বদলে ক্ষমতার প্রয়োজনে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা বাড়াবে।
ফলে জন্ম নিচ্ছে-একটি নমনীয়, ক্ষমতাসম্মত আদালত ব্যবস্থা, যা জনগণের অধিকার রক্ষা নয়, বরং শক্তিধরদের সংকেত বুঝে সিদ্ধান্ত দিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠবে।
একটি রাষ্ট্রের নৈতিক মেরুদণ্ড তখনই ভেঙে পড়ে, যখন আদালত আর প্রহরী থাকে না, বরং ক্ষমতার পরোক্ষ অংশীদার হয়ে ওঠে; বিচার আর ন্যায়ের অনুসন্ধান নয়, বরং বৈধতার নাট্যমঞ্চে পরিণত হয়; এবং নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণের সর্বশেষ আশ্রয় সংবিধান ব্যাখ্যাকারী আদালত-সামরিকীকরণের ছায়া থেকে বের হতে পারে না। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যতটা তার নির্বাচনের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, তার চেয়ে বেশি দাঁড়িয়ে থাকে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সাহসী বিচারব্যবস্থার ওপর। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংশোধনী সেই ভিত্তিটিই ক্ষয় করেছে-এবং দক্ষিণ এশিয়ার পুরো অঞ্চলে বিপজ্জনক এক দৃষ্টান্ত তৈরি হলো।
৪. কেন ‘সাংবিধানিক সামরিকীকরণ’ বলা হচ্ছে
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতার মধ্যে যে-সীমারেখা থাকার কথা, পাকিস্তানের ২৭তম সংশোধনী সেই মৌলিক বিভাজনকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলুপ্ত করেছে। এই সংশোধনী সামরিক প্রভাবকে আর অঘোষিত বা পরোক্ষ রাখেনি; বরং সংবিধানের ভেতরেই তার স্থায়ী স্থান নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ, সামরিক শক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তৈরি সাংবিধানিক কাঠামো এখন উল্টো সামরিক শক্তিকেই বৈধতা ও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা দিচ্ছে।
এটাই “সাংবিধানিক সামরিকীকরণ”। যেখানে সামরিক নিয়ন্ত্রণকে আইনের ভাষায় স্বীকৃতি দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল স্থাপত্যে বসিয়ে দেয়া হয়।
এই প্রক্রিয়ার কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো-
সামরিক প্রভাব আর ব্যতিক্রম নয়; এটি সংবিধানসম্মত নিয়মে পরিণত হয়েছে।
বেসামরিক কর্তৃত্বের সার্বভৌম কেন্দ্রকে দুর্বল করে সামরিক প্রতিষ্ঠানের দিকে ক্ষমতার ভারসাম্য সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
সংবিধানকে সামরিক স্বার্থ ও নির্বাহী সুবিধার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এতে জন্ম নিচ্ছে Sovereignty Erosion-যেখানে জনগণ-নির্ভর সার্বভৌমত্ব ক্রমেই প্রাতিষ্ঠানিক সামরিক কর্তৃত্বের কাছে স্থান হারাচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের উদাহরণ-মিশর, থাইল্যান্ড বা মিয়ানমার-সামরিক দখল বা গোলামি-ধরনের শাসনের নজির দেখালেও, পাকিস্তানের ঘটনা ভিন্ন; এখানে সামরিকীকরণ প্রকাশ্য অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নয়, বরং সংবিধান সংশোধনের সাংবিধানিক ভাষায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই কারণেই এটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক অভূতপূর্ব এবং বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত।
দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বিপজ্জনক
পাকিস্তানের ২৭তম সংশোধনী শুধু একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সাংবিধানিক পুনর্গঠন নয়-এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভঙ্গুর গণতন্ত্রগুলোর জন্য এক বিপজ্জনক রাজনৈতিক নকশা। যেখানে প্রতিষ্ঠান দুর্বল, নাগরিক সমাজ সীমিত, আর নিরাপত্তা-অজুহাত সবসময়ই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার হাতিয়ার।
১. রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার নামে সামরিক নেতৃত্বকে সাংবিধানিক ক্ষমতা দেয়া হলে সেটি পরবর্তীতে প্রথা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। যা, মূলত জনগণের মতামতকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে উপেক্ষা করার উপলক্ষ্যমাত্র। অর্থাৎ, নির্বাচিত নেতৃত্বের ব্যর্থতা দেখিয়ে “আইনের ভেতর সামরিক নেতৃত্ব”-এমন ধারণাকে রাজনৈতিকভাবে বৈধ বলে প্রতিস্থাপন করার পথ খুলে যায়।
২. যখন সামরিক কাঠামো দেখায় যে, “আমরাই স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা”, তখন বেসামরিক রাজনীতির প্রতি জনআস্থা হ্রাস পেয়ে অবিশ্বাস বেড়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে জনগণের হতাশা সামরিকীকরণের পক্ষে সামাজিকসম্মতি তৈরি করে-যা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি।
৩. বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল-সহ একাধিক দেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি এবং প্রতিষ্ঠানগত দুর্বলতা রয়েছে। উক্ত দেশগুলোকে পাকিস্তানের ২৭তম সংশোধনী দেখালো-আবশ্যক মনে হলে সংবিধান-কেন্দ্রিক সামরিক পুনর্গঠন পুরোপুরি সম্ভব। এটি ভবিষ্যতে সামরিকপন্থি রাজনীতির জন্য এক প্রমিত বাইবেল হয়ে উঠতে পারে।
যখন সামরিক সিদ্ধান্তগুলো বিচারিক পরীক্ষা, সাংবিধানিক পর্যালোচনা ও বেসামরিক তদারকি থেকে মুক্ত হয়, তখন জন লকের সেই সতর্কবাণী বাস্তব হয়ে ওঠে-‘‘Where the lwa ends, tyranû begins.” অর্থাৎ, ‘‘আইনের সীমা শেষ হলে ক্ষমতার সীমাহীনতা শুরু হয়।’’
২৭তম সংশোধনীর ভয়ঙ্কর উদাহরণের মাধ্যমে পাকিস্তান দেখালো-রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে কেন্দ্র করে সংবিধান বদলে সামরিক নেতৃত্বকে আইনের মাধ্যমে অপ্রতিরোধ্য করা যায়। এমন পদক্ষেপ শুধু রাজনৈতিক সংকটই নয়-রাষ্ট্রতত্ত্বের মূল নৈতিক ভিত্তির বিরুদ্ধ পদক্ষেপ। কারণ-রাষ্ট্রের নৈতিকতা শক্তির কেন্দ্রীভবনে নয়, বরং শক্তির জবাবদিহিতে। সংবিধান তখনই নৈতিক থাকে, যখন এটি ক্ষমতার সীমারেখা নির্ধারণ করে। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংবিধানই এখন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের হাতিয়ার। ২৭তম সংশোধনী তাই কেবল একটি পাকিস্তানি সাংবিধানিক পরিবর্তন নয়-এটি দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি বিপজ্জনক মতাদর্শের জন্ম দিলো। 
এটি গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জনগণের সার্বভৌমত্ব এবং নৈতিক রাষ্ট্রের সর্বত্রই বহুমাত্রিক হুমকি। 
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক
faraiæees@gmail.com

 

 

 

মতামত'র অন্যান্য খবর