তেতাল্লিশ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তিন বার। দেশে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব সামলেছেন চার দশকের বেশি সময় ধরে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে পাঁচবার কারাবরণ করেছেন। জীবন সায়াহ্নে কথিত দুর্নীতির মামলায় দুই বছরের অমানবিক নির্জন কারাবাসে জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়। ভাগ্য আর দেশের অগণিত মানুষের দোয়া ও ভালোবাসায় মুক্ত জীবন পেলেও স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরা হয়নি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। ৮০ বছরের ঘাত-প্রতিঘাতের সংগ্রামমুখর জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় তিনি লড়াই করেছেন গণতন্ত্র আর দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিকের খাতায় নাম লেখানোর ১০ বছরের মাথায় হন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী, একইসঙ্গে বিশ্বের দ্বিতীয় মুসলিম নারী প্রধানমন্ত্রী। নির্বাচনের মাঠে ছিলেন অপরাজেয় এক নেতা।
ফ্যাসিবাদী শাসনের সময়ে কারাবন্দি হওয়ার পর থেকে দলীয় সক্রিয় রাজনীতি থেকে অনেকটা বাইরে। কিন্তু তার ছায়ায়ই চলেছে বিএনপি’র গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম। গণতন্ত্রকামী দল ও শক্তির ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেন তিনি। সময়ে সময়ে তার নির্মোহ আহ্বান ও ঐক্যের বার্তা শক্তি, সাহস আর রসদ যুগিয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে। আপসহীন চরিত্রের দ্যুতি ছড়িয়ে তিনি কুড়িয়েছেন দলমত নির্বিশেষে দেশের আপামর মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। দেশ ও দেশের মানুষের প্রতি নিজের দায়িত্ববোধ ও ভালোবাসা দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্য একটি ব্যক্তিত্বে। আর এ কারণে দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীর শ্রদ্ধার পাত্র তিনি। সাধারণ মানুষের আস্থা আর ভরসার স্থল। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক বাতিঘর। আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের সময়ে সীমাহীন জুলুমের শিকার বেগম খালেদা জিয়া অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঘুণাক্ষরেও প্রতিশোধ প্রতিহিংসার একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনের জরুরি জমানায় তার বিরুদ্ধে আজগুবি অভিযোগ এনে কারারুদ্ধ করা, পুরো পরিবারকে বিপর্যস্ত করার ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়েও প্রতিহিংসার কোনো আলোচনা শোনা যায়নি তার মুখে।
শালীন রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে ঐক্য, সংহতি আর সম্প্রীতির বার্তা দিয়েছেন বার বার। নানা কৌশলে টানা ক্ষমতা ধরে রাখা শেখ হাসিনা সময়ে নানা অশালীন মন্তব্য করেছেন বেগম জিয়াকে নিয়ে। নানা কুৎসিত শব্দ চয়ন করেছেন ব্যক্তি ও পরিবার নিয়ে। প্রয়াত স্বামীর স্মৃতি বিজড়িত ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করে হাসিনা চরম জিঘাংসা চরিতার্থ করেছেন। বেগম জিয়ার রাজনৈতিক সংগ্রাম থামিয়ে দিতে করা হয় গৃহবন্দি। এই বন্দিদশা থেকেই নিজের প্রিয় সন্তান আরাফাত রহমান কোকোকে হারাতে হয়। কথিত মামলায় সাজা দিয়ে নির্জন কারাগারে রাখা হয় দীর্ঘ সময়। পরিত্যক্ত কারাগারের স্যাঁতস্যাঁতে প্রকোষ্ঠে থাকতে থাকতে বেগম জিয়ার জীবন বিপন্ন হওয়ার উপক্রম হয়। করোনা মহামারিতে যখন পুরো বিশ্ব মানবিকতার এক ক্যানভাস তখনো বেগম জিয়া অমানবিক এক বন্দিদশায়। জীবন সংকটেও উন্নত চিকিৎসার জন্য পাননি বিদেশ যাওয়ার অনুমতি।
রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে এত অপমান, নির্যাতন আর নিষ্পেষণের পরও বেগম জিয়া এক মুহূর্তের জন্য ধৈর্যহারা হননি। প্রতিশোধ প্রতিহিংসাপরায়ণ কোনো শব্দ উচ্চারণ করেননি। যে শেখ হাসিনা তাকে নিয়ে রাত-দিন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে বেড়াতেন হরহামেশা ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের পর বেগম জিয়া সেই হাসিনার নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেননি একটি বারের জন্যও।
সংলাপ, সমঝোতা আর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলোচনাই রাজনৈতিক সৌন্দর্য, বেগম জিয়া এই নীতি ধারণ করেই রাজনীতি করেছেন। দল ও সরকার পরিচালনা করেছেন। সংলাপ চালিয়েছেন সবার সঙ্গে। এ কারণে ডান-বাম, মধ্যপন্থি প্রায় সব দলের নেতাদের সঙ্গেই তার সুসম্পর্ক ছিল সব সময়। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করেন, সমীহ করেন। দল পরিচালনায় তিনি অবাধ প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন সব সময়। দলের নানা দৈব, দুর্বিপাকে তিনি ত্রাতা হয়ে হাজির হয়েছেন। নিজের প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্তে তৈরি করেছেন সমাধানের পথ। রাজনীতিতে আসার পর থেকে দেশের প্রায় সব বড় রাজনৈতিক সংকটে বেগম খালেদা জিয়াই ছিলেন আশার আলো। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রধান চরিত্র। সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের এই অবদান ও অর্জন খালেদা জিয়াকে পৌঁছে দিয়েছে অন্যন্য উচ্চতায়। শুধু দেশে নয়, উপমহাদেশ তথা সারা বিশ্বের গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক চরিত্রের মধ্যে তিনি এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। বিশ্ব নেতাদের সম্মান ও সমীহের পাত্র।
সর্বশেষ গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে বেগম জিয়ার প্রতি মানুষের যে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে তা নজিরবিহীন। কোনো রাজনৈতিক দলের নেতার সুস্থতা ও ফিরে আসার জন্য এত মানুষের দোয়া, প্রার্থনার নজির এর আগে নিকট অতীতে দেখা যায়নি। বেগম জিয়ার এই অসুস্থতায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পুরো জাতি। মসজিদে মসজিদে হচ্ছে দোয়া। মন্দির, গির্জা, প্যাগোডায় হচ্ছে প্রার্র্থনা। বেগম জিয়ার সুস্থতা কামনা করে গণ-রোজা ও গণ-ইফতার আয়োজনও হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে তার খোঁজ নিতে ছুটে গেছেন প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতা, বিশিষ্ট নাগরিক এবং সাধারণ মানুষ। গণ-দোয়ার আয়োজনও দেখা গেছে সেখানে। বেগম জিয়ার প্রতি মানুষের এই সম্মান এবং ভালোবাসা প্রমাণ করেছে সংকট আর দুঃসময়ে তিনি এখনো দেশের রাজনীতিতে পরম নির্ভরযোগ্য এক অভিভাবক। গণতন্ত্রে উত্তরণের এই দুঃসময়ে তার উপস্থিতি বড্ড প্রয়োজন।
বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রথাগত রাজনীতির বাইরে এক ব্যতিক্রম চরিত্র। একেবারে গৃহকোণ থেকে তিনি রাজনীতির ময়দানে আসেন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের ঘটনার হতবিহ্বলতা কাটতে না কাটতেই রাজনীতির মাঠে প্রয়োজন দেখা দেয় তার। নেতারা বেগম জিয়াকে দলের হাল ধরার পরামর্শ দিতে থাকেন। কিন্তু বেগম জিয়া শুরুতে রাজি হননি। পারিবারিক চাপ আর স্বামী হারানোর শোক এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা থেকে তিনি নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে এক পর্যায়ে তিনি সাড়া দেন।
১৯৮২ সালের তেসরা জানুয়ারি রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বেগম জিয়ার অভিষেক। একই বছরের ৭ই নভেম্বর প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। ১৯৮২ সালের ২৮শে জানুয়ারি শেরেবাংলা নগরে বর্তমান জাতীয় সংসদের নতুন ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তার এবং প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমানের সঙ্গে বেগম খালেদা জিয়াও অংশ নেন।
১৯৮২ সালের জানুয়ারিতে বিএনপি’র চেয়ারম্যান নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হলে এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিএনপি’র দলীয় তথ্য অনুযায়ী ওই সময় দলের নেতাকর্মীরা বেগম জিয়াকে দলের নেতৃত্ব দেয়ার পক্ষে ছিলেন কিন্তু তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ চাইছিলেন প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারই যেন বিএনপি’র প্রেসিডেন্ট হন। কারণ আব্দুস সাত্তার ছিলেন ক্ষমতাহীন, দুর্বল চিত্তের এক ব্যক্তি। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাত্তারের সঙ্গে বেগম জিয়াও প্রার্থী হন। পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে না থাকায় বিচারপতি সাত্তার দু’বার বেগম খালেদা জিয়ার বাসায় যান। বেগম খালেদা জিয়াকে দলের সহ-সভাপতির পদ এবং দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। কিন্তু বেগম জিয়া ব্যক্তিগত কারণে তা গ্রহণ করতে রাজি হননি। পরে আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে বেগম জিয়া তার প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। তৎকালীন নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী দলের ঐক্যের স্বার্থে বেগম জিয়া সেসময় এই প্রাজ্ঞ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু সেনাপ্রধানের সমর্থন পাওয়া বিচারপতি সাত্তার ওই বছরের ২৪শে মার্চ ক্ষমতাচ্যুত হন। সেনাপ্রধান এইচএম এরশাদ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন।
এরপর থেকেই মূলত বিএনপি’র দলীয় রাজনীতির জিয়নকাঠি হয়ে উঠেন বেগম খালেদা জিয়া। ওই বছরের মার্চে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হওয়ার পর এপ্রিলে দলীয় বর্ধিত সভায় ভাষণ দেন। সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কয়েক মাসের মধ্যেই খালেদা জিয়া দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন। ১৯৮৪ সালের ১০ই মে বেগম খালেদা জিয়া দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সেনাশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলন জোরালো হলে বিএনপি এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের অনুরোধেই বেগম জিয়া দলের নেতৃত্ব কাঁধে তুলে নেন। আবির্ভূত হন এক আপসহীন নেত্রী হিসেবে। সেনাশাসক এরশাদের প্রলোভনে শেখ হাসিনাসহ অনেকে সাড়া দিলেও বেগম জিয়া ছিলেন অনড়। এরশাদের পাতানো নির্বাচনে শেখ হাসিনা অংশ নিতে রাজি হলেও খালেদা জিয়া ছিলেন আন্দোলনের মাঠে।
এরশাদের পতনে বৃহৎ আন্দোলনে টানা নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনদফা তাকে আটক করা হয়। মূলত বেগম জিয়ার নেতৃত্বে সেই আপসহীন আন্দোলনের জেরেই ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এরশাদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচন হলে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। রাজনীতিতে আসার ঠিক ১০ বছরের মাথায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন বেগম খালেদা জিয়া। দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজনৈতিক ইতিহাসে এক মাইলফলকের সূচনা করেন তিনি। একইসঙ্গে বিশ্বে দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ডও তার। পাঁচ বছরের সফল শাসনের পর স্বাভাবিক নিয়মে নির্বাচন দেন বেগম জিয়া। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে। যথারীতি বিরোধীদলের টেবিলে সোচ্চার বেগম জিয়া। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট করে নির্বাচন করে আবারো ক্ষমতায় আসে বিএনপি। আবারো প্রধানমন্ত্রী হন বেগম জিয়া। ওই সরকারের সফল মেয়াদের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং নির্বাচন নিয়ে জটিলতার জেরে জরুরি অবস্থা জারি এবং এক/ এগারোর সরকার আসে। আবার রাজনৈতিক ঘূর্ণিপাকে পড়ে জিয়া পরিবার। খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোকে গ্রেপ্তার করা হয় প্রথমে। পরে বেগম জিয়াকেও গ্রেপ্তার করে সংসদ এলাকায় স্থাপিত সাব-জেলে বন্দি করা হয়। কারাগারে বেগম জিয়ার দুই ছেলের ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়া তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়া হয় বিদেশে। পরিবারের এই বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে বেগম জিয়াকে দেয়া হয় নানা প্রস্তাব। মাইনাস টু ফর্মুলার অংশ হিসেবে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয় বেগম জিয়াকে। কিন্তু দৃঢ়চিত্তে বেগম জিয়া সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। শুধু তাই না, একই ধরনের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হলে বেগম খালেদা জিয়া তারও বিরোধিতা করেন এবং রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে নিজের শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করেন। সেই সময় চিকিৎসার নামে শেখ হাসিনা বাইরে চলে গেলেও বেগম জিয়া কোনোভাবেই দেশ ছাড়তে চাননি।
বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে জরুরি সরকার যেসব অভিযোগ এনেছিল তা প্রমাণ করতে না পারায় এবং জনসমর্থনের চাপে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় জরুরি সরকার। পরে ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীন সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলে বিরোধী দলের নেতা হয়ে সংসদে যান বেগম খালেদা জিয়া। কিন্তু সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা স্বস্তিদায়ক হয়নি এক মুহূর্তের জন্যও। আওয়ামী লীগ সরকারের নানা কূটকৈৗশল আর একের পর এক দমনমূলক সিদ্ধান্ত বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপি’র জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করে হাসিনা সরকার। বেগম জিয়া এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে ফের আন্দোলনে নামেন।
২০১৩ সালের ২৯শে ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র কর্মসূচিকে ঘিরে তাকে গুলশানের বাসায় কার্যত গৃহবন্দি করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন বর্জনের ডাক দেন খালেদা জিয়া। তার ডাকে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সাড়া দিয়ে ওই নির্বাচন বর্জন করে। ১৫৪টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী পায়নি আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার একতরফা একটি সংসদ গঠনের পর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ফের আন্দোলনের ডাক দেন খালেদা জিয়া। এর জেরে তাকে আবারো অবরুদ্ধ করা হয় গুলশানের কার্যালয়ে। কার্যালয়ে অবরুদ্ধ অবস্থায় হারান ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে। অবরুদ্ধ কার্যালয় থেকেই প্রিয় সন্তানকে শেষ বিদায় জানান বেগম জিয়া। শোক জানাতে সেখানে যাওয়া শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ক্ষোভ আর প্রতিবাদ থেকে।
২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি কথিত দুর্নীতির দুই মামলায় সাজা দিয়ে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের নির্জন কারাগারে তাকে পাঠানো হয়। প্রায় দুই বছর পরিত্যক্ত ওই কারাগারের স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে থেকে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন শঙ্কায় পড়েন তিন বারের এই প্রধানমন্ত্রী।
কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে বাইরে রেখে ’১৮ সালে সাজানো নির্বাচন হয় সেটি পরে আখ্যা পায় রাতের ভোট হিসেবে।
২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হলে শর্তসাপেক্ষে বাসায় থাকার অনুমতি দেয়া হয় তাকে। গুরুতর শারীরিক অবস্থার কারণে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে নিতে বার বার আবেদন করা হয় পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে। কিন্তু হাসিনা সরকার এতে সাড়া দেয়নি। উল্টো তাকে এবং তার অসুস্থতা নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দলের লোকজন নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছেন সময়ে সময়ে। বাধ্য হয়ে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে দফায় দফায় চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হলেও পুরো সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। ৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন নেয়া হয়। সেখানে চার মাসের চিকিৎসায় অনেকটা সুস্থ হয়ে দেশে ফিরেন মাটির টানে। এরপর থেকে গুলশানের ভাড়া বাড়িতেই সময় কাটে বেগম জিয়ার। সর্বশেষ ২১শে নভেম্বর সশস্ত্রবাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে অংশ নেন। গুরুতর অসুস্থতার কারণে গত ২৩শে নভেম্বর ফের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় খালেদা জিয়াকে। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয় বেগম জিয়ার অবস্থা সংকটাপন্ন। দলের এই ঘোষণার পর উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দেখা দেয় সর্বত্র। পুরো দেশ প্রার্থনায়, আপসহীন এই নেত্রীর ফিরে আসার অপেক্ষায়। Í