কলকাতার চিঠি

বেগম জিয়ার সুস্থতা কামনায় বার্তা, মোদির মাস্টারস্ট্রোক?

পরিতোষ পাল | মতামত
ডিসেম্বর ৭, ২০২৫
বেগম জিয়ার সুস্থতা কামনায় বার্তা, মোদির মাস্টারস্ট্রোক?

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হাসপাতালে সংকটজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন সময়ে বেগম জিয়ার সুস্থতা কামনা করে বার্তা দিয়েছেন বিশ্বের অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। তবে ভারতের পক্ষ থেকে বেগম জিয়ার সুস্থতা কামনা করে প্রধানমন্ত্রী মোদির বার্তাটি এসেছে ঠিক নয় দিনের মাথায়। তবে মোদি  সেই বার্তায় বেগম জিয়ার দ্রুত আরোগ্যের জন্য আন্তরিক প্রার্থনা এবং শুভকামনা জানানোর পাশাপাশি বেগম জিয়ার বহু বছর ধরে বাংলাদেশের জনজীবনে অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। বেগম জিয়ার চিকিৎসায় সবরকম সহায়তার কথাও জানিয়েছেন।  বিএনপি’র পক্ষ থেকে তৎপরতার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ‘সুচিন্তিত বার্তার জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশ করা হয়েছে। 
সেই সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ‘সদিচ্ছার ইঙ্গিত’ এবং সহায়তা প্রদানের  প্রকাশকে গভীরভাবে প্রশংসা করা হয়েছে। 
মোদির বার্তা এবং বিএনপি’র কৃতজ্ঞতা জানানোর বার্তার ভাষা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক  যখন  সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তখন মোদির ‘সুচিন্তিত বার্তা’ পাঠানোকে বিশেষজ্ঞদের অনেকে মাস্টারস্ট্রোক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। 
 

ঠিক দেড় বছর আগে বাংলাদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে ক্ষমতা হারাতে হয়। একরকম নাটকীয়ভাবে পালিয়ে এসে তিনি আশ্রয় নেন ভারতে। ভারত অবশ্য এই আশ্রয় দেয়ার ব্যাপারে আগে থেকেই সবুজ সংকেত দিয়ে রেখেছিল বলে ভারতীয় সাংবাদিকরা জানিয়েছেন। এর পর থেকেই ভারত ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক   শেখ হাসিনার পূর্ববর্তী “সোনালী” যুগ থেকে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে অনিশ্চয়তা এবং শীতল সম্পর্কের যুগে প্রবেশ করে। বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি এবং রাজনীতিবিদদের বড় অংশের ধারণা, ভারত পূর্ববর্তী “স্বৈরাচারী” শাসনের খুব কাছাকাছি  থেকেছে। ফলে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি। বাংলাদেশের মানুষের একটি বড় অংশ ও রাজনীতিকদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব এর ফলে তীব্র থেকে তীব্র হয়ে উঠেছিল। ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাবের প্রতিফলন বারে বারে দেখা গিয়েছে। হাসিনাকে আশ্রয় দেয়া এবং সেখানে বসে রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে ভারতের নীরব সমর্থন সম্পর্কে  টানাপড়েন আরও তীব্র করেছে। বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান নেতৃত্ব এটিকে “শত্রুতাপূর্ণ কাজ” বলে মনে করেছে। এ ছাড়া দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলো, তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে অচলাবস্থা ও সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফের হাতে বাংলাদেশের নাগরিকদের হত্যা সংক্রান্ত অভিযোগ বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় অংশের মধ্যে অসন্তোষ এবং “বিশ্বাসের ঘাটতি” তৈরি করেছে। 
ভারত অবশ্য হিন্দুদের ওপর আক্রমণ নিয়ে প্রথমে সোচ্চার হলেও পরবর্তী সময়ে বর্তমান সরকার সম্পর্কে একরকম নীরবতা বজায় রেখেছে। গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্বের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তার বার্তা দিলেও কূটনীতির ক্ষেত্রে ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ নীতি নিয়ে চলেছে। অবশ্য বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বৈরিতার জবাব হিসেবে ভারত নানা অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে দেয়া সব সুবিধাকেই বন্ধ করে দিয়েছে। 
 

দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের নানা সুবিধা ছাঁটাই করার পাশাপাশি ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধাও বাতিল করেছে। এর ফলে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অর্থনীতি, ক্ষৃদ্র ও মাঝারি শিল্প সংকটে পড়েছে। 
তবে বাংলাদেশ ভারতের পাল্টা হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার পথে হাঁটছে। অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছে। বিশেষ করে ইসলামপন্থিদের সহযোগিতায় পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আনাগোনা, বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন এবং ভিসা ও বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধা প্রদান ভারতকে চিন্তায় রেখেছে। অন্যদিকে চীন বাংলাদেশে সামরিক সরঞ্জামের প্রধান সরবরাহকারী এবং বাংলাদেশের প্রধান বাণিজ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে।  অবশ্য হাসিনার শাসনকালের শেষদিক থেকেই এর সূচনা হয়েছিল। 
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার অর্থনৈতিক সম্পর্কও স্থবির হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের কয়েক বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হলেও অধিকাংশ প্রকল্প হাসিনার বিদায়ের পর থেকে একরকম বন্ধ হয়ে রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রায় ৭০টি চলমান দ্বিপক্ষীয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, পরিবহন ও সংযোগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, নদী এবং সামুদ্রিক বিষয়। ভারত বাংলাদেশের অবকাঠামো, নিরাপত্তা আধুনিকীকরণ, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং সন্ত্রাস দমনেও ধারাবাহিকভাবে কাজ করে আসছিল।
ভারতের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ তার অংশীদারিত্বকে বৈচিত্র্যময় করতে চাইলেও অন্য ভৌগোলিক বাস্তবতার স্বার্থে পারস্পরিক সুবিধার জন্য ভারতের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি সে পথে হাঁটতে প্রস্তুত নয় সেখানকার রাজনীতির কারণে। 
 

বিশেষজ্ঞরা উভয় পক্ষের সংলাপ, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং বাস্তবসম্মত কূটনীতির প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়ে জানিয়েছেন, কেবল পূর্ববর্তী সরকার নয়, বরং বাংলাদেশি সমাজ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর বিস্তৃত পরিসরের সঙ্গে ভারতের জড়িত হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশের জনমতের প্রতি আরও সংবেদনশীল হওয়ার কথাও বলেছেন সাবেক কূটনীতিবিদদের একাংশ। তারা জানিয়েছেন,  বর্তমান পরিস্থিতিকে সম্পর্ক পুনঃনির্মাণ এবং সমান মর্যাদা এবং ভাগ করা স্বার্থের উপর ভিত্তি করে আরও স্থিতিশীল অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার সুযোগ হিসেবে দেখা উচিত ।
সাম্প্রতিক সময়ে তারই কি প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের মিশ্র মনোভাবে। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ আমলের সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের যেভাবে নানা আদালতে বিচার চলছে তাতে উদ্বেগ বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লেও প্রতিবেশী হয়েও ভারত চুপ রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পরও ভারত  সংক্ষিপ্ত ও সতর্ক প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। তবে ঠিক এক বছর আগে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশ নোট ভারবাল পাঠালেও ভারত চিঠির স্বীকৃতি ছাড়া কোনো উত্তর দেয়নি দীর্ঘ সময়ে। তবে সম্প্রতি দ্বিতীয়বার অনুরোধ পাওয়ার পর ভারত স্পষ্ট করে জানিয়েছে, বিষয়টি বিবেচনাধীন। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, চলমান বিচারিক এবং অভ্যন্তরীণ আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের সর্বোত্তম স্বার্থের প্রতি ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যার মধ্যে রয়েছে শান্তি, গণতন্ত্র, অন্তর্ভুক্তি এবং স্থিতিশীলতা। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘোষণা করেছে ভারত যে,  নয়াদিল্লি “সকল অংশীদারদের সঙ্গে এই বিষয়ে গঠনমূলকভাবে জড়িত থাকবে”।
 

তবে ভারত হাসিনাকে ফাঁসিকাষ্ঠে তোলার ব্যাপারে সহযোগিতা করবে কিনা তা নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তবে প্রচুর আলোচনা চলছে। কিন্তু প্রত্যর্পণ চুক্তির ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হওয়া বিচারকে মান্যতা দিয়ে ভারতের হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশও এটা জানে বলেই সম্প্রতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, হাসিনাকে ফেরত দিক বা না দিক ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আটকে থাকবে না। সম্প্রতি কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম রিয়াজ হামিদুল্লাহ  বলেছেন, আমাদের কিছু ভিন্নমত ও সংবেদনশীল বিষয় আছে। কিন্তু এটাই সম্পর্কের স্বাভাবিক চরিত্র। আমরা যদি পটভূমির কেবল একটি দিক নিয়ে ব্যস্ত থাকি, তাহলে পুরো বিষয়টির প্রতি সুবিচার করা হবে না। বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক ‘ওতপ্রোতভাবে জড়িত’ (অর্গানিক) উল্লেখ করে হামিদুল্লাহ দাবি করেন, দুই দেশই দ্রুত উন্নতি করছে। দুই দেশের বর্তমান ‘অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার’ পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি।
 

সোজা কথায় বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের সামনে বড় বাধা অতীতে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। সেই হ্যাংওভার কাটানোর কোনো সহজ সুযোগ ভারতের সামনে ছিল না। তবে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত সম্পর্কের টানাপড়েন বা উত্তেজনা চায় না। অবশ্য তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে কথা বলার ক্ষেত্রে ‘মনোযোগী হওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ‘ভারত যেকোনো ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম, যদিও আমাদের লক্ষ্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।’ ভারতের নৌসেনা প্রধান দীনেশ কুমার ত্রিপাঠি বাংলাদেশের সম্পর্ককে আন্তরিকতাপূর্ণ বর্ণনা  করেছেন। তিনি বাংলাদেশকে বন্ধু বলে মনে করেন বলে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। এর আগে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে ভারত সফরে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার আলোচনা নতুন ইঙ্গিত বহন করেছে বলেই অনেকের ধারণা। তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির অসুস্থ বেগম জিয়াকে নিয়ে দেয়া বার্তা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার দরজা খোলার ক্ষেত্রে মাস্টারস্ট্রোক বলেই মনে করা হচ্ছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারতের রাজনৈতিক সম্পর্ক মেরামতের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ভারত এটা মেনে নিয়েছেÑ বাংলাদেশে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকারই আসুক বাস্তব পরিস্থিতির নিরিখে তার সঙ্গে ভারতের আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতা ও আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক কারণেই ভারতকে এখনই তৎপরতা শুরু করতে হবে। ভারতের থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলো এভাবেই বিষয়টি দেখছেন। তবে ভারতের বিদেশনীতির রূপকাররা কীভাবে এগোতে চাইছেন সেটাই দেখার বিষয়। Í

 

 

মতামত'র অন্যান্য খবর