ফি রে দে খা

খালেদা জিয়াকে প্রথম যেভাবে দেখা

শামীমুল হক | মতামত
ডিসেম্বর ৭, ২০২৫
খালেদা জিয়াকে প্রথম যেভাবে দেখা

পুরো ঢাকা শহর পানিতে তলিয়ে আছে। মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। কোনো ভবনের নিচতলা পানির নিচে। আবার কোনো ভবনের দু’তলায় পানি। ১৯৮৮ সালে এমন বন্যা দেশ স্বাধীনের আগেও দেখেনি ঢাকাবাসী। ’৮৮ সালের পরেও আর এমন বন্যা হয়নি। রাস্তায় রাস্তায় ক্ষুধার্ত মুখ। পানিতে সয়লাব থাকায় বিদ্যুৎ, গ্যাস লাইনও বন্ধ। হাহাকার চারদিকে। বিশ্বের তাবৎ দেশ থেকে আসা শুকনো খাবার তখন একমাত্র ভরসা। ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় এসব শুকনো খাবার মানুষের হাতে তুলে দেয়া হতো। যাত্রাবাড়ী এলাকায় অন্য এক দৃশ্য। ডিএনডি বাঁধের ভেতরে বসবাসকারীরা মহাআতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। যাত্রাবাড়ী থেকে জুরাইন হয়ে নারায়ণগঞ্জ সড়কটি ডিএনডি বাঁধ। এ রাস্তার পশ্চিম পাশে পানি এসে ঠেকেছে। একদিনেই রাস্তা সমান পানি। যদি পানি এ সড়ক অতিক্রম করে পূর্ব পাশে বাঁধের ভেতরে প্রবেশ করতে পারে তাহলে এক ধাক্কায় দু’তলা পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যাবে। বাঁধের ভেতরটা অনেক নিচু। এজন্যই ডিএনডি’র ভেতরে বসবাসকারীরা ছিল আতঙ্কিত। তাদের দিন-রাত এক। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই। ক্ষণে ক্ষণে মসজিদের মাইকে ঘোষণা সড়কে ফাটল দেখা দিয়েছে। যে যেখানে আছেন দ্রুত সড়কে আসুন। বস্তায় বস্তায় মাটি নিয়ে আসুন। যাত্রাবাড়ী থেকে জুরাইন পর্যন্ত সড়কে বালির বস্তা ফেলা হয়েছে পানি আটকানোর জন্য। তারপরও বন্যার পানি বাড়ছেই। সে সময় দেখা গেছে ডিএনডি বাঁধের অভ্যন্তরে খালি জায়গা থেকে মানুষ মাটি কেটে বস্তায় ভরে সড়কে ফেলছে। এ করুণ পরিস্থিতিতে একদিন যাত্রাবাড়ীতে বেগম খালেদা জিয়া গিয়ে হাজির। সঙ্গে কয়েকজন নারী নেত্রী। খালেদা জিয়া যাত্রাবাড়ীতে পৌঁছামাত্রই উপস্থিত মানুষজন তাকে ঘিরে ধরেন। হালকা পাতলা খালেদা সেদিন উপস্থিত মানুষের উদ্দেশ্যে বললেন, আজ এখানে বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমি আসিনি। আমি এসেছি আপনাদের সহযোগী হতে। আপনাদের এই দুঃখ-কষ্টের সাথী হতে। তিনি যাত্রাবাড়ী থেকে হাঁটতে হাঁটতে ধোলাইরপাড় পর্যন্ত যান। সেখানে গিয়ে একটি রিকশায় করে জুরাইনের দিকে চলে যান। প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এখনো মাঝে মাঝে সেদিনের কথা মনে পড়ে। ’৮৮ সালের বন্যায় খালেদা গোটা ঢাকা চষে বেড়িয়েছেন। কোথাও নৌকায়, কোথাও হাঁটু পানি মাড়িয়ে মানুষের কাছে ছুটে গেছেন। সান্ত্বনা দিয়েছেন। দলের পক্ষ থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেই যে মানুষের মনে নিজেকে গেঁথে দিয়েছেন তা এখনো অটুট। তার ভাষাজ্ঞান ছিল অনেক ঊর্ধ্বে। তাই তো তিনি কথা বলতেন মেপে মেপে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে তার দল বিএনপি জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। বেগম খালেদা জিয়া হন সরকার প্রধান। এটা আওয়ামী লীগসহ অনেক মানুষই মেনে নিতে পারেনি। তাই তো তাকে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। তারপরও ধৈর্য ধরে সরকার চালিয়েছেন। 

 

এ সময়েই আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের  দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে হরতালের পর হরতাল হয়। হয় জনতার মঞ্চ। সেই মঞ্চে যোগ দেন সরকারি আমলা, সচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তারপরের ইতিহাস অনেকেই জানেন। কিন্তু সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার পর গৃহবধূ খালেদা জিয়া কাঁটা বিছানো পথে হেঁটে আজকের এ পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি তিনি। দেশের সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, দলমত নির্বিশেষে সবার পথ যেন একটি। সবার নজর এভারকেয়ার হাসপাতাল। সারা দেশে মানুষ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার দু’হাত সৃষ্টিকর্তার কাছে মেলে ধরেছেন। দেশের অভিভাবক খালেদা জিয়াকে যেন সুস্থ করে দেন। এমন ইতিহাস বাংলাদেশে বিরল। রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের পাশাপাশি তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভিভিআইপি মর্যাদা পেয়েছেন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে তিনি বিশ্ববাসীর যে ভালোবাসা পাচ্ছেন, তাকে ফিরে পেতে যে আকুলতা তা এক ইতিহাস। শুক্রবার লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে উন্নত চিকিৎসার জন্য। মহান রব যেন তাকে দেশবাসীর কাছে ফিরিয়ে দেন সুস্থ দেহে। ১৯৮৮ সালে প্রথম যেদিন খালেদা জিয়াকে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা মোড়ে দেখেছিলাম সাধারণ রাজনীতিক হিসেবে, এখনো তিনি দেশের মানুষের কাছে সাধারণই। কিন্তু এই সাধারণের মাঝে এক অসাধারণ খালেদা জিয়া মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন। যা বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেল। সত্যিই খালেদা জিয়া এক অনন্য ইতিহাস। 

 

 

মতামত'র অন্যান্য খবর