সা ম্প্র তি ক

ঐক্য নিয়ে শঙ্কা

মোজাম্মেল হোসেন | মতামত
জুলাই ১৯, ২০২৫
ঐক্য নিয়ে শঙ্কা

মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতাসহ নানা কারণে বহু নিন্দিত, বহু বিতর্কিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর এক কেন্দ্রীয় নেতার অতি সামপ্রতিক একটি উক্তি দিয়ে এই লেখা শুরু করতে চাই। কারণ তিনি সত্য বলেছেন। সম্ভবত এই সত্যের গভীরতা ও সঠিক তাৎপর্য তিনি ঐ মুহূর্তে পুরোপুরি উপলব্ধিও করেননি বা খোলাখুলি ব্যক্ত করেননি।


নতুন একটি নিউজ পোর্টাল উদ্বোধনের এক অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে শুভেচ্ছা ভাষণ দেয়ার সময় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের গত বছরের জুলাই ছাত্র আন্দোলনের পরবর্তী বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে বলেন, “আমাদের যদি শক্তিশালী জাতীয় ঐক্য না থাকে তবে কোনো কিছুই থাকবে না। আমাদের এইসব সংস্কার, আমাদের সত্তা সবই হারিয়ে যাবে” (এটিএন নিউজ টিভির খবর, ১৬ই জুলাই ২০২৫)। গত বছর শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন উৎখাতকারী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের প্রথম শাহাদাত বার্ষিকী ও সরকার ঘোষিত ‘জুলাই শহীদ দিবস’ গত বুধবার ১৬ই জুলাই ওই সংবাদ পোর্টালটির উদ্বোধন হয় রাজধানীর একটি বিলাসবহুল হোটেলে। পোর্টালটির উদ্যোক্তা মশহুর তিন প্রবাসী ইউটিউবার বা অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট বা ইনফ্লুয়েন্সার বা প্রপাগান্ডিস্ট যারা গত কয়েক বছর আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারপূর্ণ প্রচার চালিয়ে পরিচিতি ও অনেকটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। ‘বাংলা এডিশন’ নামের পোর্টালটির চেয়ারম্যান নিউ ইয়র্ক প্রবাসী ইলিয়াস হোসাইন এবং দুই উপদেষ্টা হলেন প্যারিস প্রবাসী পিনাকী ভট্টাচার্য ও নিউ ইয়র্ক প্রবাসী কনক সারোয়ার। অনুষ্ঠানটিতে এরা তিনজনই বিদেশ থেকে অনলাইন ডিজিটাল পর্দায় আবির্ভূত হয়ে ভাষণ দেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরকারের উপদেষ্টা শারমীন মুরশিদ, বিএনপি ও জামায়াতসহ কয়েকটি দলের কয়েকজন শীর্ষ নেতা, বর্তমানে রাজনীতিতে খুব  সোচ্চার চিন্তক ফরহাদ মজহার এবং কয়েকজন সাবেক সামরিক-বেসামরিক আমলা উপস্থিত ছিলেন। অতিথি উপস্থিতি ও  জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান থেকে পোর্টালটির পেছনে শক্ত সমর্থন আঁচ করা যায়। ইলিয়াস হোসাইন তার বক্তব্যে পোর্টালটি জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনার ধারক বলে অঙ্গীকার জানান। কনক সারোয়ার জুলাইয়ের ঐক্য শিথিল হওয়ায় খেদ প্রকাশ করেন ও ঐক্যের আবেদন জানান। অন্যান্য বক্তাদের বক্তব্যেও ‘জুলাইয়ের ঐক্য’ প্রাধান্য পায়। বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেও একটু ভিন্ন সুরে বলেন যে, সব বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্য কি সম্ভব? তাহলে তো ভিন্ন ভিন্ন দল হতো না, একটিই দল থাকতো। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর  ইউনূসের সভাপতিত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি প্রফেসর আলী রীয়াজ ৩০টি দলের সঙ্গে যে সাংবিধানিক সংস্কারে একমত হওয়ার লক্ষ্যে ধারাবাহিক দীর্ঘ আলোচনা চালাচ্ছেন তার প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, চাপ দিয়ে ঐক্য করতে চাইলে তো বাকশালের মতো ব্যাপার হবে। 


জুলাই আন্দোলনের এক বছর পূর্তির সময় ঐ আন্দোলনের পক্ষে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য ধরে রাখার তাগিদ বেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ সংস্কার আলোচনায় কাঙ্ক্ষিত ঐক্য হচ্ছে না এবং  বিএনপি, নবগঠিত এনসিপি ও জামায়াতে ইসলামীর ত্রিমুখী-দ্বিমুখী স্লোগান-বাদানুবাদ যাচ্ছে।
ইলিয়াসদের পোর্টাল উদ্বোধনের দিনেই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র ফ্রন্ট ইসলামী ছাত্রশিবিরের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জাতীয় প্রেস ক্লাবের একটি মিলনায়তনে এক সেমিনারের আয়োজন করে। সেখানে বলা হয়, “জুলাই অভ্যুত্থানের জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরেছে” (প্রথম আলোর প্রতিবেদনের শিরোনাম, ১৭ই জুলাই ২০২৫)। 
সেমিনারে প্রধান বক্তা যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মীর্জা গালিব বলেন, “জাতীয় ঐক্যে আজকে আমরা ফাটল দেখছি। এই অনৈক্য যদি চলতে থাকে এবং আমরা যদি জাতীয় স্বার্থকে আমাদের সবকিছুর উপরে স্থান দিতে না পারি, তাহলে এই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আমাদের যে স্বপ্ন ছিল, সেই স্বপ্ন কিন্তু ব্যর্থ হবে।” 


এই হুঁশিয়ারি তুলনামূলক জামায়াতের পক্ষ থেকেই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী তাদের ৮৪ বছরের দলীয় ইতিহাসে এখনই ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করছে সবচেয়ে বেশি। এবং সেটা নির্বাচিত ও আইনি সরকার না হয়েই। সারা দুনিয়ায় শরিয়া শাসন কায়েমের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত দলটি ভারতে জন্ম নেয় ১৯৪১ সালে। পরে পাকিস্তানের দল পূর্ব পাকিস্তানে প্রাদেশিক শাখা রাখে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে শত্রুদের সাহায্য করার কারণে এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় প্রথম কয়েক বছর তারা প্রকাশ্যে কাজ করতে পারেনি। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনামলে দলটি আইনসিদ্ধ হয়। সুসংগঠিত ক্যাডারভিত্তিক দল ধর্মীয় আদর্শ থেকেই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। তবে কৌশল হিসেবে নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে অংশ নেয় এবং নির্বাচনে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জামায়াতের প্রকৃত কৌশল হলো রাষ্ট্র ও সমাজের সব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ক্যাডার ঢুকিয়ে  উপযুক্ত সময়ে ক্ষমতা দখল করে একচ্ছত্র শরিয়া শাসন কায়েম করা। এ যাবৎ বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনে তাদের সর্বোচ্চ ভোট প্রাপ্তি ১৯৯১ সালে ১২.১৩ শতাংশ ও আসন ১৮টি। অন্য সব নির্বাচনে এর চেয়ে কম। ইতিহাস ও রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন না যে, তারা কখনো গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসতে পারবে। জুলাই ’২৪ ছাত্র আন্দোলনের নেপথ্যে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে, অংশত নিজেদের ক্যাডার ছাত্রনেতাদের মধ্যে ঢুকিয়ে এবার তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসলামী শক্তিগুলোর বড় জোট তৈরি করে নির্বাচনে সরকার গঠনের মতো জয়ী হওয়া যায় কি-না। সেটা তাদের শরিয়া শাসন কায়েমের পথ তৈরি করবে এবং অতঃপর দেশে গণতন্ত্রের অবসান ঘটবে। 


এহেন পরিস্থিতিতে জামায়াত যত্নবান জুলাই-উত্তর ‘জাতীয় ঐক্য’ ধরে রাখতে। অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হয়ে প্রফেসর ইউনূস প্রথমেই ক্ষমতাচ্যুত পলাতক আওয়ামী লীগ বাদে অন্য সকল দলকে ডেকে ‘জাতীয় ঐক্যের’ উদাত্ত আহ্বান জানান। সে প্রক্রিয়া এখনো চলছে। গত বছর ৫ই ডিসেম্বর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ডান-বাম-মধ্য সকল কিসিমের ৩৬টি রাজনৈতিক দলের ৬৮ জন নেতার সমাবেশ ঘটিয়ে যে আলোচনা ও ফটোসেশন করেছিলেন তা ছিল চমকপ্রদ। তবে সে ‘জাতীয় ঐক্যের’ মূল সুরটি ছিল আওয়ামী লীগ ও ভারতের বিরুদ্ধে। যা সংকীর্ণ ও সাময়িক হতে বাধ্য। হয়েছেও তাই। কিন্তু নির্বাচন পর্যন্ত একটি যৌক্তিক জায়গায় যাওয়ার আগে এই ঐক্য ভেঙে গেলে আওয়ামী-বিরোধী কথিত রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য সমূহ বিপদ। তাই প্রকাশ্য নানা মতবিরোধের মধ্যেও ঐক্য নিয়ে বিভিন্ন জনের শঙ্কা প্রকাশ ও হুঁশিয়ারি।


ঐক্য নিয়ে জামায়াত নেতার উদ্বেগের যে গভীরতর তাৎপর্যের কথা এই নিবন্ধের শুরুতেই বলেছি তা হলো এর উপর ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা বা লেজিটিমেসি নির্ভরশীল। সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলেও এই সরকারের সাংবিধানিক ও আইনি  বৈধতা নেই বা থাকলেও ঠুনকো। সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার বলে কোনো শব্দ নেই। প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের বিধান রয়েছে। সংসদ ভাঙলে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের বিধান রয়েছে। কিন্তু হাসিনা সরকারের অপশাসনে ধূমায়িত জনরোষকে উস্কিয়ে এমন এক রক্তাক্ত ও হিংসাত্মক পরিস্থিতিতে সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে যে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও অন্যান্য সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণের সুযোগ পাওয়া যায়নি। নিরাপত্তাহীনতায় প্রধানমন্ত্রী দেশত্যাগ করেন এবং রাষ্ট্রপতি কার্যত গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। তখন সেনাপ্রধানের উদ্যোগে রাষ্ট্রপতি এবং জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা, প্রফেসর আসিফ নজরুলের মতো ছাত্র আন্দোলনে ভূমিকা পালনকারী ব্যক্তিদের বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। রাজনৈতিক কুশিলবরা হয়তো এগুলো আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। 
উদ্ভূত অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে  রেফারেন্স পাঠিয়ে মতামত নেয়া যে বর্তমানে একমাত্র আইনি বৈধতার ভিত্তি তা-ও সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। কারণ পরবর্তী সময়ে প্রকাশ পেয়েছে যে, ঐ সময়ে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের দুইজন বিচারপতি নিরাপত্তাজনিত কারণে সেনা ক্যান্টনমেন্টে আশ্রিত ছিলেন। তার মানে কি এই সরকার বৈধ নয়? 


অবশ্যই বৈধ। পরিস্থিতি অনুযায়ী আইনি বৈধতার চেয়ে অনেক গুণ বেশি শক্ত ও গ্রহণযোগ্য হচ্ছে রাজনৈতিক বৈধতা। তা হচ্ছে জনগণের সম্মতি। তবে জনগণের এই সম্মতি শর্তসাপেক্ষ। পরবর্তী নির্বাচিত সংসদ এই সরকারের বৈধতা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে অর্থাৎ এই কার্যকাল অনুমোদিত হয়ে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা পাবে। তার আগে জনগণের সম্মতির শর্ত হচ্ছে ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক ঐক্য। অনুপস্থিত আওয়ামী লীগ বাদে অন্য সকল দলের ঐকমত্য হচ্ছে সেই শর্ত। এই ঐক্য ছাড়া জনগণের সম্মতি মিলতো না এবং চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলায় দেশ শাসন-অনুপযুক্ত হয়ে পড়তে পারতো। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ দেখেই জনগণ সম্মত হয়েছে। তাই নির্বাচন পর্যন্ত দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। নইলে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক বৈধতাও হারাবে। তখন কী হবে ঈশ্বর জানেন। তাই ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত সংস্কারের জন্য চাপাচাপি করে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য নষ্ট করা এবং নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোরও ক্ষমতার জন্য আগাম কামড়াকামড়ি করা দুটোই বিপজ্জনক। আপাতত নির্বাচনই মনজিলে মকসুদ। 

মতামত'র অন্যান্য খবর